মুক্ত গদ্য (কোলাজ) : ড. মীনা মুখার্জী
প্রকাশিত:
১ নভেম্বর ২০১৯ ২২:২৫
আপডেট:
৪ মে ২০২০ ১৩:৪৩

এক চিলতে রোদ
বাইরে ব্যস্ত হাওয়ার চপল ডাক,আনীল আকাশে মেঘেদের দিনান্ত ভ্রমণ,খোলা আকাশে মেঘেদের নীরব পায়চারি আবার কখনও বা ইশারায় ডাক,হয়তো বা কথা বলা পাখিদের সাথে৷কি সুন্দর বসে আছে তারা ন্যাড়া মহুলের ডালে৷বুঝি বা মেঘের ইশারা বুঝল তারা জনান্তিকে৷
টানটান বিছানায় শুয়ে খোলা দরজার ফাঁকে বাইরে তাকিয়ে দেখি মেঘেদের মন্ত্রণার বিভিন্ন আকার৷পাখিদের দেখাদেখি আমারও মস্তিষ্কে যেন রক্তক্ষরণ—কোনও অভিপ্রায় মাথা চাড়া দেয় —যদি বা ফুঁ মন্তর ছুঁ ড়ে দিয়ে আকাশের বুক থেকে ছুঁয়ে ছেনে আনা যায় অমতময় বৃষ্টির আশ্চর্য্য শান্তির স্বচ্ছ জল৷
" তখন তৃষিত প্রেম "
" ঠিক তখনই এক চিলতে মিস্টি রোদ
নেমে আসে পায়ে পায়ে,
নিবিড় অন্তরঙ্গতায় !".......
স্বপ্নের মত পসরা সাজিয়ে চলে গেল আরও সপ্তাহ দুই৷তারপর ??
রক্তপ্রবাহে তখন তৃষিত প্রেম যেন প্রায়শ্চিত্ত্য সেরে একমুঠো আলো চায়—অন্তরের নিবিড় তাগিদে,তারপর সেই এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে বহুকাল জাগা৷চোখে ঘুম নেই৷কেউ বলে না আর— "এত রাত জাগা?আর না,চলো এবার শুতে চলো৷শরীর ভেঙ্গে যাবে যে!"ডাকে শুধু অন্ধকার আর গভীর নীরবতা ! ওৎ পেতে চেয়ে আছে খোলা জানলাটা৷কিছু জোনাকির দাপাদাপি বুকের অন্ধকারে৷অাচমকা জ্বলে ওঠে অতীতের স্মৃতি৷উপেক্ষিত প্রেমের বিরহ যন্রণা এখনও বুকের পাশে টনটন করে৷বোবা কান্নারা মনকে ঝাঁঝরা করে ফেলছে৷অনুভবগুলো তীব্রদাহে মরুভূমিতে যেন শুষ্ক বারিবিন্দু৷বিষাদে যন্ত্রণায় আত্মহত্যার কথা ভাবি৷আর ঠিক তখনই অরূপ তার অপরিমেয় আনন্দরাশি চোখের সামনে ঝুলিয়ে আমাকে লোভাতুর করে৷চমকে উঠে আমি বিচার করতে বসি মর্ত্যের অমত ছেড়ে হতভাগা আমি কোন্ নরকের বিষপানের কথা ভাবি!আর ঠিক তখনই বাঁচার আনন্দে উদ্বেল হয়ে পুরনো হিসেব নিকেশ নস্যাৎ করে দিই; ধূর যা,ব্যর্থ প্রেমের ,ছন্নছাড়া স্মৃতিরা ছারখার হয়ে 'বিষম অগ্নি দাহেরে'—আর মজা কি জানো অরূপ—ঠিক যেন স্বপ্নের পসরা হাতে তুমি বলে ওঠো—"আরে!আমি তো এই খানেই৷সেই কৃষ্ণচূড়ার শিরীষ শাখে বসে তোমার প্রেমের প্রগাঢ়তা মাপছিলাম৷"
বাইরে নিস্তব্ধ চরাচরে ঝিঁ ঝিঁ পোকারা আমার সাথী হয়ে আনন্দগান গাইতে থাকে,মহুলের ডালের জোনাকিগুলো আমার কানে নতুন করে বাঁচার মন্র শুনিয়ে আনন্দদীপ
শিখাটিকে জ্বালায় দপ্ দপ্ করে৷আমি আবার নতুন ভোরে মৌমাছিদের আনন্দ কাহিনী শোনার অপেক্ষায়!
"মাতাল স্মৃতিরাও মদির অপেক্ষায়"
এই তো সেদিন ছোট মামার মৃত্যুর পর সব ভাইবোনেরা একসাথে হওয়ায় পুরনো বাড়ির গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছিলাম—সেই আমড়া তলা,সেই চাতাল,সেই শান বাঁধানো পুকুর ঘাট,আঙিনা,দিদিমণির আচার পাঁপড় শুকোনোর প্রিয় ঝুল বারান্দা,বৈঠক খানায় হরিণের শিং,রবীন্দ্রনাথের সেই লাইভ ছবি খান,দাদুর তানপুরা,বাঁশি,বেহালাদি;কত স্মৃতি বিজড়িত বাঁশ বনের ধারে দাদুর চিলে কোঠাটির হাতছানি,স্নিগ্ধ বাতাসের অফুরান মুগ্ধতা!স্মৃতির
ক্যানভাসে ভেসে ওঠে কত চিত্রকল্প,হৃদয় ছুঁয়ে যায় এলোমেলো কত সুর,সে সুরের তানে কখনও বা চোখের কোণে বর্ষিত হয় সন্তপ্ত অশ্রুর প্লাবন,নিথর নিঃশব্দ রাতের অন্ধকারে দেখি,দেখি দাদু এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে—"সোনা দাদা পারবে কি.......?"হঠাৎ অনাবিল সে স্পর্শে সুখের কাতরতা!মোহময় স্বপ্নালী চোখে আকাশচুম্বী আকাঙ্খার বিপুল বিস্তার—ঝুল বারান্দার গ্রিলের সে রঙ্গীন স্বপ্নেরা অপেক্ষায়!অলৌকিক বার্তালাপ শেষে সে অফুরান ভাল লাগারা জেগে থাকে জনম ভোর!
খুঁজেই চলেছি আজও আমি মায়ের নিবিড় সে কোল!শিশুত্বে ফিরে যেতে চাই মাগো!চুলের বিলি কাটা নখের সে ভিতরে!কতকাল চুমোর গন্ধ আকঁড়ে আমিধুইনি কপালের এ ভাঁজ৷চড়াই পাখিদের সাথে জোড় শালিখটাও ইলেকট্রিকের তার পেরোচ্ছে৷মহুলের ডালগুলো কিশলয় ও কুসুমের অপেক্ষায় ন্যাড়া৷পরিযায়ী পাখিরা উড়ে চলেছে দখিণের পথে,বসন্ত বাতাস খোঁজে!হয়তো বা প্রেমের অপেক্ষায় শুভ শালিখেরা!
"এবং অপেক্ষায়"
দুরারোগ্য ক্যান্সারাগ্রস্ত পিসী মৃত্যু শয্যায়
যখন করুণ দিনাতিপাত করছেন তখন হয়তো বা মৃত্যুর হাতছানি টের পেয়ে সরবে ডাক দিলেন আমাকে —"বৌমা আমার ব্যাগখানা আনো তো"৷
সেখানি হস্তগত হলে কম্পিত হস্তে পন্জিকা দেখে নাতির পৈতের দিন স্থির করলেন৷তারপর ব্যাগ থেকে কাশ্মীরি শাল,কাঁসার থালা,বাটি,পাঁচ টাকা ও একটি রূপোর কয়েন পরিপাটি সহকারে রেখে থালখানিতে ফল ও আতপ চাল সাজিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়ে আদরের দাদুভাইকে ডেকে আর্শীবাদ করে নাতিকে দ্বিজত্বের সম্মান প্রর্দশন করে মাধুকরী দান করলেন—
পিসীর দু'চোখে তপ্ত অশ্রুধারা.....
করুণ চোখে তাকালেন মাথার একপার্শ্বে
সুসংরক্ষিত তাঁর মনে না থাকা ন'বছর দশ মাস বয়সের হৃত প্রয়াত স্বামীর প্রতিকৃতির দিকে৷
স্তূপীভূত শ্রান্তির পাহাড় বেয়ে দূরের কুয়াশার ঝাঁক যেন এগোলো খানিকটা,বক্র হাসি মেখে গুটি গুটি পায়......
দিন কয় পরে বাল্য বিধবা সতী,সাধ্বী,পিসী শেষ দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন—তাঁর ছোট ভাই ও ভাসুরপোকে৷ভাইকে দেখার ইচ্ছে অপূর্ণ রইল৷কিন্তু 'ভাগ্যমন্তী' স্বাধী রমণী 'সুখী পিসীর'শ্বশ্রূ কূলের পোলার হাতে মুখে আগুন ও দুধ গঙ্গা জলের সাধ মিটেছিল৷
ফেলে আসা মুহূর্ত গুলি জীর্ণ,ক্লান্ত আর স্থবির!আচমকা আমার হাত দু'খানি ধরে গীতা পাঠের করুণ আবেদন .....
এবং অপেক্ষায়.....
"হরি ওঁ তৎসৎ"......
সুখী পিসীর মুক্তিলাভ ও স্বর্গে স্বামী দর্শন!!
"উড্ বী"
— শুনছ গো......
—শুভ আসছে দশই ফাল্গুন ও যখন ল্যান্ড করবে ডেকে নিই কনক,মিসেস ঘোষ আর অনন্যাকে৷কিবলো ইলা?
—ঠিক আছে৷
নির্দ্দিষ্ট দিনে এয়ার পোর্টের নিষিদ্ধ এলাকায় ভাবী বৈবাহিক মহাশয় ও বৈবাহিকা মহাশয়াকে ও ভাবী পুত্রবধূকে নিয়ে অধীর আগ্রহে ডাঃ জি.সি.রায় ও ইলা রায় তারায় ভরা এক টুকরো উজ্জ্বল আকাশের নীচে অপেক্ষারত৷সময়মত কিংফিশার জেট এসে দাঁড়াল ৷জেটটির বিকট আওয়াজের মধ্যে ঈশ্বর প্রদত্ত কোনও ইঙ্গিত হয়তো বা কটাক্ষ হানলো৷বহু যাত্রীর ভিড়ের মাঝে সুদীর্ঘ পাঁচ
বছর পর ছেলেকে দেখতে পেয়ে মা একান্ত আনন্দিত,আপ্লুত৷মাকে জড়িয়ে ধরে খোকনের কি আদর!তারপর মা-বাবাকে প্রণাম নিবেদন৷
—শুভ ,ইনি মিঃ কনক সরকার ,রিটায়ার্ড মেজর সাহেব আমার বাল্যবন্ধু৷ইনি মিসেস সরকার ও এ অনন্যা৷
—ইয়েস উই আর ইগারলি ওয়েটিং ফর ইউ৷আই য়্যাম ইওর উড্ বী৷
—ডাডা,সী ইজ মাই লাইফ পার্টনার ন্যানসী৷
—মা ভয় পেওনা,ন্যানু বাংলা পড়তে পারে,ঠাকুর পুজো করে৷ইন্ডিয়াকে ভালবাসে ৷মা ও শাড়ী পরতেও পারে৷
—সরি আঙ্কল,নো চান্স৷অলরেডি এনগেজড৷
অপরপক্ষ যেন বিদ্যুৎপিষ্ট হলেন!ডাঃ রায় বিহ্বল,নির্বাক ও স্তম্ভিত!!
প্রকৃতির রূপ সজ্জায় বসন্তবরণ সমারোহ৷পতঝড়্ মাদকতায় ছড়ায় বসন্ত সমীর৷
বসন্ত ছোঁওয়া নিয়ে জেটের ককপিট থেকে ঐ দূরে দেখা যায় এক আকাশ লাল পলাশ৷বেহায়া আকাশটার নীচে নগ্ন আলোয় স্বপ্নের অলিন্দ বেয়ে ,প্রজাপতি পাখ্নায় আঁকা সে মাঙ্গলিক চিহ্ন বুঝি বা অলক্ষ্যে বিধুর বসন্ত অপেক্ষায়..........!!!
দূরে মাইকে গান ভেসে আসে ......
"হায় গো ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়,
যায় গো!........."!!
ড. মীনা মুখার্জী
লেখক ও সংগঠক
বিষয়: মীনা মুখার্জী
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: