দেশের সর্ববৃহৎ কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু


প্রকাশিত:
১৫ জানুয়ারী ২০২০ ০০:০২

আপডেট:
১৫ জানুয়ারী ২০২০ ০০:৩১

ফাইল ছবি

প্রভাত ফেরী ডেস্ক: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বেঁধে দেওয়া তারিখের আগেই উৎপাদন শুরু করেছে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। সোমবার বেলা ১১টায় কেন্দ্রটিকে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুধাবি থেকে দেশে ফেরার পরপরই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এই কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। আগামী ২৭ জানুয়ারি কেন্দ্রটি প্রথম ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট পূর্ণক্ষমতায় চালানো হবে। এছাড়া ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সমান দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করবে আগামী মে মাসে।

এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, প্রাথমিকভাবে পায়রা কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরুর পাশাপাশি জাতীয় গ্রিডে ১০০ মেগাওয়াট লোডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। ক্রমান্বয়ে কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদনের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মাওলা জানান, সোমবার বেশ কিছুক্ষণ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালানো হয়েছে। শুরুতে ৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন হলেও আস্তে আস্তে উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে।

আমরা সারাদিনই ১২০ মেগাওয়াট উৎপাদন করেছি। এর মধ্যে কেন্দ্রটির নিজস্ব ব্যবহার বাদে ১০০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে ক্রমান্বয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। প্রতিদিন অল্প অল্প করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এরপর বাড়ানো হবে। পাশাপাশি যন্ত্রপাতিগুলোও চলবে এই মাসজুড়েই। চাইলে এই পর্যায়ে উৎপাদন করা যায় না। ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়াতে হয়। তিনি বলেন, আশা করছি আগামী ২৭ জানুয়ারি গ্রিডে ৬৬০ মেগাওয়াটই সরবরাহ করতে পারব। এজন্য অনেক ধরনের পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ রয়েছে। আশা করছি আগামী মাস ফেব্রুয়ারির শেষদিকে আমরা কেন্দ্রটির প্রাথমিক বাণিজ্যিক অপারেশনের দিন নির্ধারণ করতে পারব।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে পায়রার উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী পায়রা গিয়ে কেন্দ্রটি উদ্বোধনের বিষয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এর আগেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্প উদ্বোধন করতে যান প্রধানমন্ত্রী।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ৩ বছর ৯ মাস ২৩ দিন পেরিয়ে সোমবার আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রায় ১০ হাজার চীনা এবং বাংলাদেশি শ্রমিক ও প্রকৌশলীর দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এটি। ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নতুন এক ইতিহাসের সূচনাকে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম বড় অর্জন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রটির সমান অংশীদার চীন এবং বাংলাদেশ। চীনের এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারের যেসব মেগা প্রকল্প রয়েছে তার মধ্যে পায়রা অন্যতম। সরকারের অগ্রাধিকার ১০ মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকলেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সুপার ফাস্ট তকমা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসায় অন্তত ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমানো যাবে। এতে করে বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ সাশ্রয় হবে বলে আমরা আশা করছি। এখন তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ফার্নেস তেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৩ দশমিক ৬২ এবং ডিজেলে ২৭ দশমিক ২১ টাকায় উৎপাদন করা হয়। এর বিপরীতে পায়রার উৎপাদন খরচ থাকবে সাড়ে ৬ টাকার নিচে। ফলে প্রতিবছর বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ সাশ্রয় হবে। তিনি বলেন, সরকার প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনের সঙ্গে ব্যয় সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেয়। এজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে মিশ্র জ্বালানি ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই উদ্যোগের প্রথম বাস্তবায়ন হলো পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র।

জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে মধ্যভাগের চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালনে এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। পায়রা-রামপাল-রূপপুরের বিদ্যুৎ নেওয়া হবে গোপালগঞ্জে। সেখান থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হবে। জিরো লোডশেডিং আওয়ার বা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এই মেগা প্রকল্পটির কাজ শুরু করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৯ জুন চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) বাংলাদেশে একটি ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করে। এরপর সমঝোতা স্মারক, যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠন আর ক্রোড়পত্র আহ্বানের পর ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয়।

চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান এনইপিসি কেন্দ্রটির ঠিকাদার নিযুক্ত হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আর্থিক সংস্থানের আগেই ঠিকাদারকে ২০ ভাগ অর্থ ব্যয়ের শর্ত দেওয়া হয়। এতে করে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চুক্তি সইর পরের দিন থেকেই কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে এনইপিসি, যাতে কেন্দ্রটির কাজ দ্রুততার সঙ্গে শেষ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেন্দ্রটি নির্মাণে বিসিপিসিএল সর্বাধুনিক আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এছাড়া একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় সবধরনের সতর্কতা মেনে চলা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীন কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়লাচালিত কেন্দ্রে উন্মুক্ত অবস্থায় কয়লা রেখে দিলেও পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা রাখার জন্য যে কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করেছে তা পুরোপুরি ঢাকনাযুক্ত।

জাহাজ থেকে কয়লা ওঠার সময়ও ঢাকনাযুক্ত কনভেয়ার বেল্টে আনা হবে। প্রতিটি ১ লাখ ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার চারটি কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করা হচ্ছে, যা দিয়ে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৫৭ দিনের কয়লা মজুদ রাখতে পারবে। নির্গত গ্যাস ধরতে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার ইউনিট (এফজিডি) নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রটির ৯৬ ভাগ ফ্লু গ্যাস ধরা হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ছাই ‘এ্যাশ হপারে’ ধরা হবে। এর বাইরেও কেন্দ্রটির ২২০ মিটার উচ্চতার চিমনি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ৭৫ তলা ভবনের সমান উঁচু চিমনি দিয়ে বাতাসের নির্দিষ্ট স্তরে ধোঁয়া ছাড়ার ফলে দূষণ নিয়ন্ত্রিত মাত্রার মধ্যেই থাকবে।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top