সেলিব্রেটির ঈদ : অয়েজুল হক
প্রকাশিত:
৮ আগস্ট ২০২০ ২৩:৪৬
আপডেট:
৮ আগস্ট ২০২০ ২৩:৫০
আজিজুরের ফেসবুক ফ্রেন্ড চার হাজার নয়শত নিরানব্বই। ফলোয়ার দশ হাজারের উপরে। একপ্রকার সেলিব্রিটি বলা চলে। রাস্তা দিয়ে হাটা চলার সময় লাইক, ফ্রেন্ড, কমেন্ট, ফলোয়ার, আনফ্রেন্ড, ব্লক, আন ব্লক, গ্রুপ, পেজ এগুলো নিয়েই চলে। হাবিব সাহেব এ বেচারা কে নিয়ে গরুর হাঁটে গিয়ে পড়েছে মহাবিপাকে। গরুর হাঁটে বড় বড় ষাড় সারি সারি দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে টেনে সরাতে হচ্ছে।
- এই ছাগল একটা গুতা খেলে ফেসবুক ছুটে যাবে।
আজিজুর দাঁত বের করে হাসে। ‘কি যে বলেন! ছাগল হলে তো ছাগলের সারিতে দড়ি বাধা অবস্থায় থাকতাম। আমি তো সেলিব্রিটি। অবশ্য এটা অনেকের সহ্য হয়না’
রশিদ চাচা মুরব্বি মানুষ। আজিজুরের কথা, আচরনে ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলেন,‘ ইস সেলিব্রিটি! তা তুমি একখান গরু কিনে দেও।’
‘পাবেন। একদিন......’ কথা শেষ হয়না একটা বড় গরু একেবারে আজিজুরের গা ঘেষে ঘড়ঘড় করতে করতে চলে যায়। আজিজুর তড়িঘড়ি করে লাফ দিয়ে সরে। হাবিব সাহেব রশিকতা মিশিয়ে বলে, সরে না গেলে কি হতো না? শিং বাধিয়ে আকাশে চ্যাংদোলা করে ছুড়ে মারলে কি দারুন কান্ডই না হতো।
আজিজুর হাসে, নাসিম ভাই ক্যামেরা রেড়ি রাইখেন। যদি সত্যিই এমন কিছু ঘটে, আকাশে থাকতে একটা ছবি চাই।
রশিদ চাচার মুখ গোমরা। হয়তো মনে মনে ভাবেন এই বদ টাকে সাথে আনার মানে কি! গরুর হাটে গিয়ে অল্প সময়ের ভেতরই হারিয়ে যায় আজিজুর ও নাসিম। একপ্রকার ইচ্ছা করেই। মুরব্বিদের সাথে জমে না। ঘুরতে ঘুরতে সারা হাট চষে হাটের সবচেয়ে বড় গরুর সাথে একটা ছবি। আপলোড ইন ফেসবুক। ক্যাপশন - আমি ও গরু । লাইক কমেন্টের বন্যা। আজিজুর ভাবে এ বন্যা যদি বৃষ্টির বন্যা হতো তাহলে এক পোষ্টের লাইক, কমেন্টের বন্যায় এলাকা সাফ হয়ে যেত। লাইক কমেন্ট চলুক। গরু কেনাটা আগে শেষ হোক পরে রিপ্লাই দেয়া যাবে। গরুর হাটে যে পরিমান গরু মেলে তার চাইতে বেশি মেলে দালাল। আজিজুরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দালালী কার্যক্রম এড়ায় না। গরু বিক্রি করতে এসেছে নুর আলী। দালাল কুব্বত গিয়ে প্রশ্ন করে, কতো তে ছাড়বি?
- পঞ্চাশ হাজার।
- এই ব্যাটা গরুর দাম কেমন আপ ডাউন করে দেখিসনা! আজ ডাউন। এই গরু পঞ্চাশ হাজারে কোন ছাগলে নেবে?
নুর আলী গ্রাম থেকে আসা সরল মনের মানুষ। সে আপ বোঝে না ডাউন বোঝে না। কাকুতি মিনতি করে বলে, ভাই আপ আর ডাউন যাই হোক পঁয়তাল্লিশ না হলে আমার যে চালান থাকেনা।
- আচ্ছা দেখি কি করা যায়। তুই চুপ করে দাঁড়ায় থাকবি। বাদবাকি আমি দেখবো। তবে পঁয়তাল্লিশের বেশি যা সেটা কিন্তু আমার।
নুর আলী সায় দেয়, আচ্ছা।
দালাল গরুর সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্রেতা দাম জিজ্ঞেস করতেই বলে পচাত্তর। কেউ পঞ্চাশ, কেউ ষাট পয়ষট্টি পর্যন্ত দাম বলে। দালাল নাছোড়বান্দা। একজন সত্তর বলাতে পেছনে তা দেয়া মুরগির মতো ঝিম পাড়া নুর আলী বলে ওঠে, দেন ভাই। দিয়ে দেন। কুব্বত খেকিয়ে ওঠে। গর্দভ, গরু তোর না আমার। সারা বছর কষ্ট করে এইডারে বড় বানাইছি। চার মন গোশ নির্ঘাত। তোর কথা মতো ছাগলের দামে গরু দিয়ে দেই। ছাগল কোথাকার।
নুর আলী থমকে যায়। সারা বছর কষ্ট করে বড় করেছে! চার মন গোশ! আড়াই মন হয় কিনা সন্দেহ। তবু তার কিছু করার নেই, বলার নেই।
নাসিমের মোবাইল বাজে। রিসিভ করতেই হাবিব সাহেবের গলা, কই তোরা?
- এই তো হাঁটে।
- সারা হাট ঘেটে ঘেটে হাট সিলিন্ডারের শরবত হয়ে গেল। প্রায় দুই ঘন্টা পর গরু কিনলাম। তোরা মজা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! গেটে আয়।
নাসিম আজিজুর জোর পায়ে গেটে যায়। সত্তর হাজার টাকার গরু। আর দেরি করা যাবেনা। যেতে হবে সাত কিলোমিটার পথ। আজিজুর আর নাসিম সামনে, হাবিব সাহেব আর রশিদ চাচা পেছনে। গরু নিয়ে হাটা শুরু। সামান্য পথ পেরিয়ে আজিজুর বলে, নাসিম ভাই নিজেদের গরুর সাথে একটা সেলফি তুলতে হবে না?
- তোমার ইচ্ছা।
- আচ্ছা আমি পোজ দিয়ে হাটছি। আপনি সামনে গিয়ে একটা ছবি তোলেন।
নাসিম গলার দড়িটা ছেড়ে দিয়ে সামনে যায়। ক্যামেরার ক্লিক। আলোর ঝলকানি। গরুর দৌড়। নাসিম সরে গেলেও আজিজুর দড়ি ধরে দৌড়ায়। পেছনে সমানে দৌড়াচ্ছেন রশিদ চাচা আর হাবিব সাহেব। ওপাশের দড়িতে বাধা না থাকায় সামান্য পরেই মাথার প্রচন্ড আঘাতে রাস্তায় ছিটকে পড়ে আজিজুর। গরু দৌড়ের গতি বাড়ায়। শেষমেশ পেরে ওঠেন না। দড়ি সহ হুড়মুড় করে রাস্তার ওপর পড়ে যান হাবিব সাহেব ও রশিদ চাচা। দড়ি ছাড়া যাবেনা। দড়ির সাথে সত্তর হাজার টাকা! গরুটা তীব্র গতিতে তাদের ছ্যাড়াব্যাড়া করতে করতে সামনে এগোয়। সর্বশক্তি ব্যয় করে দুজন মানুষ চিৎকার করতে থাকে। কিছু লোক চিৎকার শুনে এগিয়ে আসে। কিছু লোক গরুর সাথে রাস্তা দিয়ে সড় সড়িয়ে যাওয়া মানুষ দুজনের ছবি তোলে। শেষ পর্যাপ্ত কিছু মানুষের সহযোগিতায় বড় বাচা বেচে যান। ক্ষতবিক্ষত দেহে গরু নিয়ে বাড়ি পৌঁছালেও অন্যদুটো গরুর খবর জানেন না হাবিব সাহেব ও রশিদ চাচা। রশিদ চাচা রাগে গদগদ করতে করতে বলেন, হাত পা ওয়ালা লেজবিহীন গরু দুটোর জন্যই যতো বিপদ। হাবিব সাহেব কিছু বলেন না।
আঘাত প্রাপ্ত আজিজুর রাস্তার পাশে পড়েছিল। পেছন থেকে অনেক দূর হেটে এসে আজিজুর কে পড়ে থাকতে দেখে নাসিম অবাক! গায় হাত দিতেই নড়েচড়ে ওঠে।
- কে?
- আমি নাসিম। ওনারা কই!
- জানিনা ভাই, আমি বড় বিপদগ্রস্ত। একটা ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দেন। ক্যাপশন দেবেন, আজিজুর দোয়া চায়।
- তোর ফেসবুকের গুল্লিমারি। ওঠ। নাসিমের মেজাজ গরম হয়।
- ওঠার মতো অবস্থা থাকলে কি পড়ে থাকতাম। নড়তে পারছি না। আস্ত একটা গরু যেন আমার শরীরের উপর চেপে বসেছে। রশিদ চাচার মোবাইলে কয়েকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায় না। টেনেটুনে আজিজুর কে ডাক্তার দেখিয়ে যখন এলাকায় ফেরে তখন রাত দুটো। প্রথম দেখা হাবিব সাহেবের সাথে। ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরছেন। ওদের দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।
- এই তোরা কি মানুষ!
আজিজুর ক্যা কা নো গলায় জবাব দেয়, সেলিব্রিটি ভাই সাহেব।
হাবিব সাহেব রাগ নিয়ে চলে যান। বাড়ি ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ফেসবুকের পাতায় মনোযোগ দেয়। সেরা গরুটার সাথে তোলা ছবি। আমি ও গরু।
কমেন্ট দেখে শরীরের ব্যথার সাথে মনের আরেক ব্যথা যোগ হয়। প্রথমেই লিখেছে, আপনিও গরু! দেইখেন কেউ কুরবানী করে না দেয়!
আরেকজন লিখেছে, ভাই আপনারে তো মানুষ মানুষ লাগে।
আজিজুর রিপ্লাই দেয়, শুধু কি মানুষ! আমি একজন সেলিব্রিটি।
লোকটা উত্তরে লেখে, ও সেলিব্রিটি গরু। যাক গরুর নতুন এক প্রজাতির নাম জানলাম।
আজিজুরের মেজাজ গরম হয়, এই মিয়া চেহারাটা দেখছেন।
দেখছি ভাই শুধু একটা লেজ থাকলেই একেবারে খাপের খাপ মিলে যেত।
আজিজুর রাগে মোবাইল টা ছুড়ে ফেলে। মনটাই খারাপ হয়ে যায়। আবার নিজেকে প্রবোধ দেয়, সেলিব্রিটি হলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। নড়াচড়া করতে গেলেই শরীর জানান দেয় তার অসুস্থতার কথা। পরদিন জ্বর আসে। অসুস্থতা বেড়ে ঈদ পর্যন্ত পৌঁছে। আজিজুরের এবারের ঈদটা ফেসবুকীয়। ফেসবুকে সবাই মজার, আনন্দের ছবি দিচ্ছে। আজিজুর কি দেবে। অনেক চিন্তা করে পোস্ট দেয়, ফেসবুকীয় ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ টা নিরেট ফেসবুকীয়। সবার ঈদ এমন সুন্দর ও অনাবিল হোক।
অনেকে কমেন্ট করে, আমীন। আমীন।
আজিজুর মনে মনে হাসে। আমীন বলো! কবুল হলে আগামী বার বুঝবে ফেসবুকীয় ঈদ কাকে বলে।
বিষয়: অয়েজুল হক
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: