সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


সিডনিতে জীবনের গল্প শোনালেন ইয়াসমিন হক ও জাফর ইকবাল


প্রকাশিত:
১ মে ২০১৯ ১৩:২৩

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০৪:২০

সিডনিতে জীবনের গল্প শোনালেন ইয়াসমিন হক ও জাফর ইকবাল

কোন গান কিংবা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নয়, শুধু কথা দিয়েই সিডনি প্রবাসীদের মুগ্ধ করলেন দুই জন শিক্ষক। একজন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক এবং অন্যজন তার স্বামী  জনপ্রিয় লেখক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল । 

 

গত  ২৮ এপ্রিল রবিবার সন্ধ্যায় অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রাকাশিত মাসিক বাংলা পত্রিকা “প্রভাত ফেরী”র পরিবেশনায় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট) এলামনাই অস্ট্রেলিয়া ও রেমিয়েনস অস্ট্রেলিয়া'র  যৌথ উদ্যোগে নাগরিক সন্ধ্যায় সিডনির  ব্যাংকসটাউন  ব্রায়ান ব্রাউন থিয়েটার ছিল দর্শকের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ। উদ্দেশ্য একটাই খ্যাতিমান এই দুই ব্যক্তিত্বকে এক নজর দেখা এবং তাদের বক্তব্য শোনা।





আড্ডার ছলে-গল্পের ছলে  জীবনের চরম বাস্তবতার কথা শোনালেন এই শিক্ষক দম্পতি। রসিকতা করলেন বন্ধুর মতো। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা ব্যাপ্তিকালের এই আলাপনে গল্পের ঢঙ্গে শোনালেন তাদের জীবন-বাস্তবতা, শিক্ষকতা, বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড  এবং তাদের সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম সহ বিভিন্ন বিষয়ের কথা।





এই দুই গুনী ব্যক্তিত্বদ্বয়কে সিডনি প্রবাসীদের কাছে নিয়ে  আসতে এবং এই ধরনের একটি মনোরম সন্ধ্যা উপহার দিতে মূখ্য ভুমিকা পালন করে প্রভাত ফেরী। তাদের সহযোগীতায় ছিল রেইন ফরেস্ট ফিউশন রেস্টুরেন্ট এবং অমরাবতী ফ্যামিলি ট্রাস্ট। পুরো অনুষ্ঠানটিতে কোন টিকেটের ব্যবস্থা ছিল না। প্রায় ২০০০ আবেদনকারী থেকে দৈব চয়ন পদ্ধতিতে ৩০০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

 





সালেহ আহমেদ জামীর প্রানবন্ত সঞ্চালনায় প্রথমে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রভাত ফেরীর সম্পাদক ও অস্ট্রেলেশিয়ান ইণ্টারন্যাশনাল কলেজের পরিচালক শ্রাবন্তী কাজী আশরাফী। এই সময় তিনি বলেন, মহান টাইটানদের দেবতা প্রমিথিউস মানুষকে ভালবেসে আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং তার জন্য দেবতাদের রাজা জিউস তাকে কঠিন শাস্তি দেন। প্রমিথিউসরা কখনো মরে যান না বা হারিয়ে যান না। তারা বার বার যুগে যুগে মানুষের সমাজে ফিরে আসেন। জাফর ইকবাল আমাদের প্রজন্মের কাছে একজন প্রমিথিউস, যিনি কিনা আমাদেরকে তার জ্ঞানের মশাল দিয়ে শত প্রতিকূলতা সত্বে ও আলোর পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আমাদের প্রজন্মকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে পিছপা হননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাফর ইকবাল স্যারের বাবাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। স্যারের সঙ্গে আমার একটি আত্মিক সম্পর্ক খুঁজে পাই কারন আমার বাবা কাজী জাকির হাসান ছিলেন একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভুমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদকে ভুষিত করেন। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা লালন করাই আমার স্বপ্ন। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়  উদ্বুদ্ধ হয়েই প্রভাত ফেরীর অগ্রযাত্রা। প্রভাত ফেরী ও অস্ট্রেলেশিয়ান ইণ্টারন্যাশনাল একাডেমি যেটি ইউনিভার্সিটি অব সাদার্ন কুইন্সল্যান্ডের সাথে যৌথ ভাবে প্রায় ৩৫ টি দেশ থেকে আগত অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীদেরকে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, ইয়াসমিন হক ও  জাফর ইকবালের মতো গুণীজনদের  নিয়ে আজকের এই নাগরিক সন্ধ্যা আয়োজন করতে পেরে গর্ব বোধ করছি। 





এই সময় প্রভাত ফেরীর  প্রকাশক বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক এবং বিখ্যাত দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের নাতি এবং সিলেটের মরমী কবি দেওয়ান হাসন রাজার প্রপৌত্র সোলায়মান দেওয়ান আশরাফী, উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য, বিশিষ্ট  কথা সাহিত্যিক ও বাংলাদেশ বেতারের নাট্যকার শাহান আরা জাকির, ইমিগ্রেশন আইনজীবি ডঃ ফয়সাল আহমেদ ও ডাঃ একরাম চৌধুরীকে আগত অতিথিদের সামনে  পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সোলায়মান দেওয়ান আশরাফী তার বক্তব্যে ইয়াসমিন হক, জাফর ইকবাল আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এবং আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। এছাড়া এই শিক্ষক দম্পতি সম্পর্কে স্মতিচারন করেন তাদের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছাত্র মোঃ জে এ সিদ্দিকী। 

 

 

জীবনের গল্প বলতে প্রথমে শুরু করেন ড. ইয়াসমিন হক , তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে পাকিস্থানে ইয়াসমিন হকের জন্ম, বেড়ে ওঠা, প্রবাসের স্কুলে বাংলা শিখতে না পারার আকুলতা, জাফর ইকবালের সঙ্গে তার পরিচয় বিয়ে, সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে তাদের প্রবাসের জীবন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান, পরবর্তী সময়ে প্রতিকুল পরিস্হিতির সঙ্গে লড়ে যাওয়া দিনগুলির কথা । তবে সবকিছু ছাপিয়ে এই কাহিনীতে মূর্ত হয়ে আছে  ইয়াসমিন হক ও  জাফর ইকবালের ভালবাসার কয়েক দশক, এবং একসঙ্গে পথচলার গল্পটি।

 

 

জাফর ইকবাল তার বক্তব্যে শুরতেই মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ঘটনার কথা স্মৃতি চারন করে বলেন আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি তারা হয়ত জেনেটিক্যালি পরিবর্তন হয়ে গেছি, এটি একি সঙ্গে বীরত্বের ইতিহাস, কষ্ঠের ইতিহাস এবং অর্জনের ইতিহাস। 



লেখালেখি এবং সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার কাছে যা সত্যি মনে হয় আমি সেটাই লেখি, আমি সাংবাদিক বা সম্পাদক না যে আমাকে প্রত্যেকটি বিষয় নিয়েই  লিখতে হবে। 





সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অপরকে ব্যাক্তিগত ভাবে আক্রমনের প্রবনতা নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেন, যে কথাটি আমি সামনা সামনি বলতে পারব না সে কথাটি কেন আমি লিখে অনলাইনে দেব? প্রবাসে চাকচিক্য ও নিরাপদ জীবনে সব থাকলেও দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধই তাকে দেশে ফিরে আসার প্রেরনা যোগায়।   

 

প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, দেশে পড়াশুনা করে বিদেশে বসাবাস করা বা স্থায়ী হওয়ার কারনে কোন হীনমন্যতায় ভোগা উচিৎ নয়। তিনি আরো বলেন যারা বিদেশে থাকে তারা অনেক ভাবে দেশকে সাহায্য করতে পারে।

 

বাংলাদেশ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন সহস্রাব্দের সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান, আমরা যদি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো  লেখাপড়া করাতে পারি তাহলে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। 

আলাপচারিতার এক পর্যায়ে ইয়াসমিন হক  জানান জাফর ইকবাল তার উপর হামলাকারী   ফয়জুর রহমানের সাথে পরিবারের অজান্তেই জেলে দেখা করেছেন এই সময় দর্শক সারিতে থেকে ব্যাপারটি নিয়ে তাকে কিছু বলার অনুরোধ করা হয়। এই সময় তিনি জানান, হামলাকারীর মোটিভ জানতে তার সাথে দেখা করি , হত্যা প্রচেষ্টা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায় ভূতের বাচ্চা সোলায়মান বই লেখার কারনে তার উপর হামলা করছে। অথচ সে বইটি না পড়ে ধরে নিয়েছে এই বইতে  ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে। পরে  যখন সে বইটি পড়ে  তখন ইসলাম বিরোধী কিছু পাইনি বলে আমার কাছে স্বীকার করলে ও তার ভিতর কোন অনুশোচনা বোধ দেখতে পাইনি।   





,  

জাফর ইকবাল এবং ইয়াসমিন হক  আরো বলেন যে, বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো কাজ হচ্ছে কিন্তু এগুলোর কোনটারই আই পি (ইন্টেলেকচুয়েল প্রপার্টি) সুরক্ষা নেই। ফলে আই পি (ইন্টেলেকচুয়েল প্রপার্টি) বাবদ বাংলাদেশ হাজার কোটি ডলার হারাচ্ছে। চীন তাদের বৈদেশিক আয়ের ৪০% আয় করছে শুধু মাত্র আই পি থেকে। কিন্তু দেশে ১৯৭২ সাল থেকে পেটেন্ট অফিস আছে। তাই বাংলাদেশকে আই পি এবং কপি রাইটের জন্য সঠিক নীতিমালা প্রয়োগ করে তার যথাযত বাস্তবায়ন করতে হবে। 

 

 

মঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে আয়োজকদের পক্ষ থেকে তাদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন প্রভাত ফেরীর প্রকাশক সোলায়মান দেওয়ান আশরাফী এবং রেইন ফরেষ্ট ফিউসনের স্বতাধিকারী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মিরাজ হোসেন। 

 

বক্তব্য শেষে স্বল্প পরিসরে আয়োজিত সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় গান পরিবেশন করেন জিয়াউল হক তমাল, পলাশ বসাক,মুশফিক, স্রোতস্বিনী নাবিলা, তমালিকা তামান্না,

প্রসঙ্গত  শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট) এলামনাই অস্ট্রেলিয়া 'র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মোঃ সায়েম মোর্শেদ লিপু,  এনামুল কবির খান সুদান, মোঃ সাজ্জাদ সিদ্দিকী , রেমিয়েনস অস্ট্রেলিয়া'র প্রেসিডেন্ট  ডাঃ একরাম চৌধুরী  সাধারণ সম্পাদক পলাশ বসাক, ফয়সাল হোসেন সহ আরো অনেকের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় স্বনামধন্য এই শিক্ষাবিদ দম্পতিকে নিয়ে প্রানবন্ত  নাগরিক সন্ধ্যাটি অনুষ্ঠিত হয়। 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top