সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


বিউটি সার্কাস - সার্কাসের মোড়কে মুক্তিযুদ্ধের সার্বজনীন গল্প : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৮ অক্টোবর ২০২২ ২৩:৪৭

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০১:৩১

 

“হৈ হৈ কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার”

একসময় বাংলাদেশের শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জ শীতকালীন সময়ে এই ঘোষণায় মুখরিত থাকতো। কোন নতুন সার্কাস বা যাত্রাদল পারফর্ম করতে আসলেই এলাকাগুলোতে যেন সাজ সাজ রব পড়ে যেতো। এলাকাগুলো যেন নব উদ্যোমে জেগে উঠতো। কখনও মাসব্যাপী আবার কখনও আরও দীর্ঘ সময় ধরে চলতো এই সার্কাস বা যাত্রাপালা। জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে এ ছিল এক চাঞ্চল্যকর আয়োজন বিশেষকরে সার্কাসের সব দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডগুলো মানুষ প্রাণভরে উপভোগ করতো। যারা ছোটবেলায় এটা দেখেছেন সারাজীবন তাদের স্মৃতিতে এটা থেকে যায়। গল্পের আড্ডায় স্থান পায় সার্কাসের গল্প। সার্কাস আসলে এক পরিপূর্ণ বিনোদনের কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন এক্রোবেটিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও একসময় ছিল প্রাণীদের দিয়ে মজার মজার কর্মকাণ্ড। এখন কোন প্রাণীকে কষ্ট না দেয়ার আইন হয়ে যাওয়ায় সার্কাসে প্রাণীদের দিয়ে আর তেমন কিছুই করা হয় না। তবু্ও এর আকর্ষণ একটুও কমেনি। আর বাড়তি অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে ভাঁড়দের ভাঁড়ামি যেটা যেকোনো বয়সী দর্শককে কিছু সময়ের জন্য দৈনন্দিন দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। আর থাকে তাক লাগিয়ে দেয়া বিভিন্ন ধরনের জাদুবিদ্যার প্রদর্শনী। সার্কাস বড় ছোট ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবাই পারফর্ম করে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই যুদ্ধ অত্র অঞ্চলের ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতি বদলে দিয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ২৪ বছরের শাসন শোষনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল বাংলাদেশের মানুষ। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই শুরু করেছিল শুধু বুকের সাহস আর দৃঢ় মনোবল সম্বল করে। নয়মাস এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জন করেছিল এক নতুন দেশ - বাংলাদেশ। এই লড়াইয়ে সবাই তার নিজের সামর্থ্যের বাইরে যেয়ে চেষ্টা করেছিল। দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণে যুদ্ধটা পরিণত হয়েছিল একটা গণযুদ্ধে। অবশেষে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং তিন লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা।

মুক্তিযুদ্ধের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। সবাই সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য মানসিকভাবে ছিলেন প্রস্তুত। এই যুদ্ধে সার্কাসের দলগুলোও অংশগ্রহণ করেছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করতো। তাদেরকে বিভিন্ন তথ্য দিয়েও সাহায্য করতো। এমন আরও বহু নজির আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। দি বেঙ্গল সার্কাস ঠিক এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যায় স্থানীয় রাজাকারদের রোষানলে পড়ে। স্থানীয় রাজাকারেরা বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু যখন কোন কিছুতেই কাজ হয় না তখন তারা সার্কাসের মালিককে নির্মমভাবে হত্যা করে, পুড়িয়ে দেয় সার্কাসের প্যান্ডেল। এরপর পেরিয়ে যায় বহু বছর। এতসব অপকর্ম করেও একসময় মুক্তিযুদ্ধের এই বিরোধী চক্র বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয়। কিন্তু তাদের চরিত্র বদলায় না। পুনর্বাসিত হয়ে আবারও তারা তাদের আসল চেহারা ফিরে পায়।

অপরদিকে বেঙ্গল সার্কাসের উত্তরাধিকার হিসেবে বিউটি আবারও প্রতিষ্ঠা করেন 'বিউটি সার্কাস'। খুঁজতে থাকেন নিজের শেকড়ের পরিচয়। প্রতিদিন তার ঘুম ভাঙে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। এভাবেই চিত্রায়িত হয়েছে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ছবি দি বিউটি সার্কাস। আমি কোন সিনেমা বোদ্ধা নয় তাই সিনেমার কারিগরি বিষয় নিয়ে কোন প্রকার মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু আমার কাছে কাহিনীটা দুর্দান্ত লেগেছে। আর প্রত্যেকের অভিনয়ও ভালো লেগেছে। ডায়লগগুলোও ছিল সময়োপযোগী। সার্কাসের ভিতরের বিষয়গুলো এই প্রথম দেখলাম। তারা বিভিন্ন ধরনের কসরত করে মানুষকে আনন্দ দিলেও তারা আমাদেরই মতো রক্ত মাংসের মানুষ। তাদেরও কাজের শেষে টেলিভিশন সেটের সামনে বসতে হয়। তাদেরও দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে হয় অন্য সবার মতো। আবার সবকিছু ভুলে মুখে রঙ মেখে হাজির হতে হয় সার্কাসের মঞ্চে।

চলচ্চিত্রটা মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই অপেক্ষায় ছিলাম কবে দেখতে পারবো।অস্ট্রেলিয়াতে বিউটি সার্কাস চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে এসেছে পথ প্রোডাকশন এবং দেশী ইভেন্টেস। তাই তারা যখন ফেসবুকে পোস্ট করলো এই খবরটা তখন আর দেরি করিনি টিকেট কাটতে। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন অস্ট্রেলিয়াতেও শীতকালীন অন্যান্য উৎসবের সাথে নিয়মিত আয়োজন করা হয়ে থাকে সার্কাসের৷ এমনই একটা সার্কাস আমরা মানে আমি এবং আমাদের পুত্র ও কন্যা গতমাসে দেখতে গিয়েছিলাম সিডনির লিভারপুলে৷ উদ্দেশ্য ছিল নিজের শৈশবের স্মৃতিচারণ আর প্রবাসী প্রজন্মের মধ্যে সেটার বিস্তার। 'স্টারডাস্ট' সার্কাসের সেই পরিবেশনা আমাদের মনপ্রাণ ছুঁয়ে গেলো বিশেষকরে রায়ানের খুব পছন্দ হলো ভাঁড়দের ভাঁড়ামি। এরপর সে বাসায় ফিরে তাদের নকল করে বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়াকলাপ করে আমাদের মুগ্ধ করে যাচ্ছে৷ তাই এবারও 'দি বিউটি সার্কাস' এর টিকেট করার সময় ওদের জন্যও টিকেট করেছিলাম। 

ক্যাম্বেলটাউনে মাত্র একটা শো রাখা হয়েছিল। সিনেমাটা দেখা শেষে আমি আমার মেয়েকে বললাম দেখো মানুষের জীবনযাপন কত সার্বজনীন! 'দি বিউটি সার্কাস'র চাঁদোয়াটা একদম 'স্টারডাস্ট' সার্কাসের মতো না? উত্তরে সে বলল, সেটাতো হবেই কারণ দুটোই তো সার্কাস। এরপর বললাম কিন্তু স্টারডাস্ট সার্কাসে কত 'সেফটি মিজার' ছিল কিন্তু আমাদের দেশে পারফর্মাররা কোন ধরনের সেফটি মিজার ছাড়াই পারফর্ম  করেন তাই সেটা হয় আরও বেশি উপভোগ্য। আর ওরা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়িটাও জানে 'ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল'র মাধ্যমে যেখানে প্রতি রবিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শেখানো হয় বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি।

আমাদের পরিবারকে আমরা নাম দিয়েছি "দি নিউ অপেরা সার্কাস'। যেখানে গিন্নী হলেন রিং মাস্টার, আমি ভাঁড় আর ছেলেমেয়ে দুজন পারফর্মার। আর আমি আমাদের জীবনটাকে বলি সার্কাসের মঞ্চ। সার্কাসে সবাই যেমন রিং মাস্টারের ইশারায় বিভিন্ন ধরনের পারফরম্যান্স করে আবার ফিরে যায়। মানব জীবনেও আমরাও যেন পৃথিবী নামক মঞ্চে পারফর্ম করে আবার ফিরে যায় সেই অদৃশ্য রিং মাস্টারের কাছে। যাইহোক 'বিউটি সার্কাস'র সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ। সার্কাসের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধতো আসলে ছিল একটা সার্বজনীন গণযুদ্ধ। তাই এমন সিনেমা আরও বেশি বেশি হওয়া দরকার।

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top