নার্গিস পারভীন: নিভৃতেই হারিয়ে যাওয়া এক কন্ঠ সঙ্গীত শিল্পীর নাম : অশ্রু বড়ুয়া
প্রকাশিত:
১৬ নভেম্বর ২০২০ ২১:২৬
আপডেট:
৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৯:৩৩
১৫ই নভেম্বর ছিল কালজয়ী এই কন্ঠশিল্পীর ১৩তম প্রয়াণবার্ষিকী।
বাংলাদেশের সোনালী যুগের তিনি ছিলেন শেষ জাদু- কন্ঠগুলোর একটি। যাঁর কন্ঠে উপমহাদেশের কিংবদন্তী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছায়া খুঁজে পেতেন ওই সময়ের সঙ্গীতপ্রেমীরা। যদিও এই অদ্ভুত সাদৃশ্যের ব্যাপারটি অন্ধ অনুকরণের কোনো বিষয় ছিল না। যা ছিল নিতান্তই প্রকৃতিগত এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত। যাঁর গান মানুষকে স্বপ্ন জাগাতো-ভালোবাসতে শেখাতো কখনো-সখনো ভোলাতো নিদারুণ কষ্ট।মাতাল করা কন্ঠের মাদকতায় মোহাবিষ্ট হতো এ দেশের লক্ষ কোটি দর্শকশ্রোতা।
অসাধারন গীতিকবিতায় শ্রুতিমধুর সুর আর গায়কীমদির বিহ্বলতায় তাঁরই গাওয়া গানগুলো পায় আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। অন্যদিকে তিনি হয়ে উঠলেন দিনে দিনে বাংলা মৌলিক গানের এক অপরিহার্য্য কন্ঠ সঙ্গীত শিল্পী। হ্যাঁ-নাম তাঁর নার্গিস পারভীন।
আজ স্বর্নকন্ঠী এই সঙ্গীত শিল্পীর ১৩তম প্রয়াণবার্ষিকী। আজকের এদিনে বরেণ্য শিল্পীর প্রতি রইল এক হৃদয়ের অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
বাংলাদেশের সঙ্গীতের অসংখ্য কাব্য সৌন্দর্যময় জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা,দেশের অন্যতম মেধাবি এবং শক্তিমান গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান'র লেখা এবং বাংলাদেশের সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ, বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ, সুরের বরপুত্র-খোন্দকার নুরুল আলম'র সুর-সঙ্গীতে বেশ কয়েকটি গান ওইসময় শিল্পী নার্গিস পারভীন-কে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়।
০১. যে আমার হৃদয় করলো চুরি
কথা-মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান সুর: খোন্দকার নুরুল আলম
০২. সবাই বলে-যত সর্বনাশের মন
কথা: মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান সুর: খোন্দকার নুরুল আলম
০৩. পোড়া চোখ কেনো তুই অন্ধ
কথা: মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান সুর: খোন্দকার নুরুল আলম
০৪. অন্তরে কাঁদন আমার চোখে
কথা: মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান সুর: খোন্দকার নুরুল আলম
-এমনই অসংখ্য কালজয়ী গানের শিল্পী নার্গিস পারভীন। যে গানগুলো ওই সময় রেডিও-টেলিভিশনে প্রতিনিয়ত বাজতো। দর্শকশ্রোতারাও মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনতো তাঁর গান। আজও জাদু-মাখা সেই কন্ঠ যেন সুরে সুরে মুগ্ধতা ছড়িয়ে মাতিয়ে তোলে বাংলা মৌলিক গানের শুদ্ধ শ্রোতাদের হৃদয়-মন।
ইংরেজি উনিশ'শ সাতচল্লিশ সাল। কুষ্টিয়ার আড়ুয়াপাড়ায় তের আগষ্ট জন্মগ্রহন করেন নার্গিস পারভীন। এই কুষ্টিয়ায় কেটেছে শিল্পীর শৈশব-কৈশোর।
বাবা-ছিলেন পেশায় একজন নামকরা আইনজীবী। নার্গিস পারভীন'র বাবা এবং ভাই গান করতেন শখের বশে। মূলত তাদের অনুপ্রেরণায় শৈশব থেকেই সংগীত চর্চার সঙ্গে বেড়ে ওঠেন নার্গিস পারভীন। আড়ুয়াপাড়ায় গাছাপালা ঘেরা লাল ইটের দোতলা বাড়িটিতে ছিল সঙ্গীতের এক অন্যরকম আবহ। এছাড়া কুষ্টিয়ায় একদিকে লালন আর অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ এ যেনো সোনায় সোহাগায় কেটেছে নার্গিস পারভীন'র
সঙ্গীত জীবন।খুব অল্প সময়েই ছড়িয়ে পড়ে সঙ্গীত প্রতিভা নার্গিস পারভীন এর নাম।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই গান করছেন বেতারে। রাজশাহী বেতারে গান রের্কডিংয়ের মধ্য দিয়েই সঙ্গীতে শিল্পী নার্গিস পারভীন'র শুরু হয় পথচলা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন শিল্পী নার্গিস পারভীন। পরবর্তীতে যোগ দেন-বিসিআইসিতে। উচ্চ শিক্ষিত নার্গিস যদিও বিসিআইসিতে উচ্চ পদে নিয়োজিত ছিলেন কিন্তু সঙ্গীত-ই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান এবং সাধনা।
ইংরেজি উনিশ'শ বাহাত্তর সাল। কথা দিয়েছিলেন দুজনই। ভালোবাসার ভেলায় চড়ে পথ চলবেন দুজন একসঙ্গে।
এমনই আত্মবিশ্বাসে একই সালের ৮ অক্টোবর ভালোবেসে বিয়ে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষককে।
ইংরেজি উনিশ'শ চুয়াত্তর সাল। ঢাকা বেতারে গান গাওয়া শুরু করেন নার্গিস পারভীন। ঢাকা বেতারে এবং পরবর্তীতে টেলিভিশনে একের পর এক গান গেয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন নিজেকে। ওই সময়টাতে রেডিও- টেলিভিশনে গান গেয়ে দর্শকশ্রোতার মন জয় করে নিয়েছিলেন যে ক'জন গুণী কন্ঠশিল্পী
তন্মধ্যে-নার্গিস পারভীন অন্যতম। বিশেষ করে বেতারে আধুনিক গানে এই শিল্পীর সতেজ কন্ঠের আওয়াজ শোনা যেতো সর্বত্র। শ্রোতারাও মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনতো তাঁর গান।
বাংলাদেশ বেতারে শিল্পীর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে 'কন্যা বদল' ছায়াছবিতে শিল্পী নার্গিস পারভীন-কে চলচ্চিত্রে নেপথ্যে কন্ঠ দেয়ার সুযোগ করে দেন-দেশের প্রখ্যাত সুরস্রষ্টা আলম খান।
- ভালোবাসা দিয়ে মোরে এতো সুখ দিয়েছো
কথা : গাজী মাজহারুল আনোয়ার সুর-সঙ্গীত : আলম খান
যে গানের মধ্য দিয়ে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তীতে ঢাকা বেতার-টেলিভিশন হয়ে চলচ্চিত্র সর্বত্রই নার্গিস পারভীন গান গেয়ে হয়েছেন সমাদৃত। সতন্ত্র গায়নশৈলীতে শিল্পী নার্গিস পারভীন'র
গাওয়া গানগুলো ছিল যেমন বাণী প্রধান তেমনি সুরগুলোও ছিল বেশ ব্যতিক্রম।দিনে দিনে নার্গিস পারভীন হয়ে উঠলেন-বাংলা গানের এক আস্থাভাজন জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী।
পঁচিশটির মতো চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্যে কন্ঠ দিয়েছেন স্বর্নকন্ঠী এ শিল্পী। নন্দিত এই কণ্ঠশিল্পী চলচ্চিত্রের গান গেয়েই পেয়েছেন অসামান্য খ্যাতি। নিভৃতচারী, বরেণ্য শিল্পী নার্গিস পারভীন গান গাওয়াটাকেই জীবনের ধ্যান ও জ্ঞান হিসেবে নিয়েছিলেন। তাইতো সোনালী সময়ের ওইসব গান যে কারো মনকে সহজেই নাড়া দিয়ে যায় এখনও। তাঁর মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে কালজয়ী হয়েছে অনেক গান। এর মধ্যে-
- তোমাকে ভালবাসি সে আমার অহংকার
- পোড়া চোখ কেন তুই অন্ধ থাকিস না
- আমার চোখে রাত্রি থাকুক
- ময়ুর মহলেও আমার মন বসবে না
- মনে আমার এ কোন ভাবনা
- যে আমার হৃদয় করলো চুরি
- তোমার দেয়া ভালোবাসা
- চলো না কোথাও নিরিবিলি
- মাধবী রাতে সুনীল মায়া
- মিথ্যে সুখের গান গেয়ে
- কংলক আর বেঁচে রবে কতদিন
- এদেশ আমার সবুজে
- আমি তো কেবলই এক
- তোমাকে বিদায় দিয়ে শ্রাবনের
- অমাবস্যা পূর্ণিমা কোনটা ভালো
- পাখির কন্ঠে গান
- কাগজের ফুল নয় দু'চোখের ভূল নয়
- চাইনা কিছু চাইনা আমার আছে লক্ষী সোনা
- বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে
- বুঝিনা তার নীরব মনের কিসে এমন বায়না
এছাড়াও শিল্পী নার্গিস পারভীন'র কয়েকটি দ্বৈত গান বেশ শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। তন্মধ্যে-
- বন বাতাসের ছন্দে দোলানো : প্রবাল চৌধুরী ও নার্গিস পারভীন
- সজনী প্রেম হলো বেদনা : সৈয়দ আব্দুল হাদী ও নার্গিস পারভীন
- দুটি মন আর দুটি জীবন : সুবীর নন্দী ও নার্গিস পারভীন
- এই পথ যদি হতো শান্ত নদী : প্রবাল চৌধুরী ও নার্গিস পারভীন
এই রকম অসংখ্য গানের শিল্পী নার্গিস পারভীন বাংলা মৌলিক গানকে পৌঁছে দিয়েছে অন্য এক উচ্চতায়। এছাড়া বেতার-টেলিভিশনের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন চিত্রের জিঙ্গেলেও কন্ঠ দিয়েছিলেন গানের পাখি নার্গিস পারভীন। আর মায়াময় সেই সুরেলা কন্ঠ পৌঁছে যেত বাংলার ঘরে ঘরে।
সত্তর-আশি দশকে বাংলা গানের অপরিহার্য্য এই কন্ঠশিল্পী তখনও তুমুল জনপ্রিয়। এমনি এক সময় জীবনের প্রয়োজনে একমাত্র পুত্র সন্তানসহ স্বামীর সাথে বিদেশে পাড়ি জমান শিল্পী নার্গিস পারভীন। স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে গেলেও জীবনের সুর ও ছন্দের অন্ত্যমিল-এর ভাবনা শিল্পীকে করে তোলে বড় বেশি ব্যাকুল। জীবনের অংক মিলাতে গিয়ে শিল্পী যেন ভুলের পাহাড়ই গড়েছেন-এমনই ভাবনায় পেয়ে বসে শিল্পীকে খুব বেশি। যন্ত্রনাকাতর সব কথার সুরে যাঁর গানে থাকতো ছেয়ে আজ যেন তারই ছায়া পড়েছে শিল্পীর জীবনে।
নাহ্। অবশেষে কোনো একদিন এক পৃথিবী অভিমান নিয়ে সন্তানসহ ফিরে আসেন স্বদেশে। ফিরলেন সপ্তস্বরের মোহময় সুরের ভূবনে। সব ভূলে সঙ্গীতের মাঝেই সমর্পিত করলেন নিজেকে। সেই মায়াময় সুরেলা কন্ঠের জাদুতে ছুঁয়ে দিলেন শ্রোতাদের আবারও। সাত সুরে জীবনকে জড়ালেও শেষতক ছিঁড়েই গেলো স্বামীর সাথে সম্পর্কের বিনিসূতো। যে ছিল কাছে সে সন্তানও চলে গেলো বিদেশে। যেন ধরে রাখা গেলো না কাউকেই-কিছুতেই।
নব্বইয়ের দশক। বদলে যেতে থাকে বাংলা গানের ধারা। গানের এই হাওয়া বদলে খুবই ব্যথিত হন কালজয়ী শিল্পী নার্গিস পারভীন। কারণ এই গানের জন্যই তো জীবনের এতো ত্যাগ। এই গানই তো তাঁর প্রান। একে একে সব হারানোর বেদনা আর স্বপ্ন ভাঙ্গা মন নিয়ে চলতে থাকেন নার্গিস পারভীন। হাওয়ায় বদলে যাওয়া গান থেকেও ধীরে ধীরে সরে আসেন অভিমানি এ
শিল্পী।
দিন আসে রাত ফুরোয়। তবুও যেন নার্গিস পারভীন'র জীবনে আসে না নতুন ভোর। কেবলই অন্ধকার আর অন্ধকার। শিল্পীর জীবনে দেখা দেয় নতুন আরেক অধ্যায়। একাকি নিসঙ্গ জীবনে শরীরে ঠাঁই নিলো মরনব্যাধি ক্যানসার। সেই জীবনের বোঝা যেন অনেকটাই ভার ছিল। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি যেন একেবারেই নিরব নিথর হয়ে রইলেন। সেই সময় শিল্পীর পাশে ছিলনা কেউ-ই। পুত্রসম একজনই শিল্পীর কাছে ছিলেন জীবনের শেষ দিনগুলোতে।
পুরো সঙ্গীত জীবনে যাঁর পরিচ্ছন্ন, মায়াময়, সতন্ত্র মধুঝরা কন্ঠে কালজয়ী হয়ে আছে অসংখ্য গান। শুধু গান দিয়েই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মানুষের মনে সুরের মূর্চ্ছনায় যিনি ছুঁয়ে দিতে পারতেন-তেমনি একজন ক্ষণজন্মা প্রতিভাময়ী শিল্পী নার্গিস পারভীন। আহা! কী নিদারুণ শিল্পী জীবন।
ইংরেজি দু'হাজার সাত। এভাবেই ক্যানসারের সাথে লড়াই করতে করতে আসে পনের নভেম্বর। কুষ্টিয়ার নিজ বাসভবনে চিরদিনের জন্য সকলের দৃষ্টি সীমানার অন্তরালে হারিয়ে গেলেন সুরেলা কন্ঠী নার্গিস পারভীন।
জীবন যেমন সত্য-মৃত্যু তেমন শাশ্বত। তবুও বাংলা গানের ইতিহাসে তাঁর নাম লেখা থাকবে অনন্তকাল। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর অনবদ্য সব সৃষ্টির মাঝে। নার্গিস পারভীন নামে আমাদের একজন কন্ঠশিল্পী ছিলেন –একথা জানেন না আজ এই প্রজন্মের অধিকাংশ শিল্পী-ই। তবুও আমরা গর্বিত-আমাদের দেশে জন্মেছিলেন নার্গিস পারভীন'র মতো গুণী শিল্পী। কিন্তু দুর্ভাগ্য জীবতাবস্থায় শিল্পী নার্গিস পারভীন পাননি তাঁর যোগ্য সন্মান।
এতো আমাদেরই লজ্জ্বা- আমাদেরই ব্যর্থতা।
অশ্রু বড়ুয়া
গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন
বিষয়: অশ্রু বড়ুয়া
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: