সিডনী বুধবার, ৮ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

লকাইয়ের মৃত্যু : তন্ময় চট্টোপাধ্যায়    


প্রকাশিত:
১৬ জুন ২০২০ ২২:৩৭

আপডেট:
১৬ জুন ২০২০ ২২:৪০

 

পাড়ায় ঢোকার মুখেই দেখলাম চারপাশে বেশ জটলা। রাস্তার মোড়ে একদল, শঙ্করের চায়ের দোকানে একদল, খেলার মাঠে একদল। এই অবেলায় এত মানুষ একসঙ্গে এখানে থাকার কথা না। নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে। বেশ বড় রকমের কিছু।

অনেক লোকজন একসাথে দেখলে আমার ভেতরটা আবার বড্ড আনচান করে। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বড় বড় বিপ্লবের কথা পড়েছি। একটারও সাক্ষী হওয়ার সুযোগ হয়নি। আমরা  জন্ম নিলাম নেহাত এক অবিপ্লবের যুগে। দু চারটে নেতা নেত্রীর অনশন ছাড়া তেমন কিচ্ছু চোখে পড়ল না। তাও নিন্দুকে বলে গোপনে পেট পুজো সেরে অনশন। মনে বড্ড ইচ্ছে অন্ততঃ একটা লোক্যাল বিপ্লবের সাক্ষী হই।

সুযোগ এসে গেল কিনা ভেবে বেশ রোমাঞ্চ লাগছে শরীরে। বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। রহস্য উদ্ঘাটন না হলে আমার ভেতরের খিদেটা আবার ঠিকমত মেটে না। খিদে মেটাতে পরিচিত কাউকে দরকার। জটলার মধ্যে চোখে পড়ল রতনকে। আমার বন্ধু রতন। তার কাছে জানা যায়। কিন্তু সমস্যাও আছে। রতনের কথা বরাবরই ইন্সটলমেন্টে বের হয়। মুখে গুলি রেখে ছোট বয়স থেকে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। লাভ তেমন হয় নি। বেশ কিছু গুলি পেটে গেছে বলে শুনেছি। অনন্যোপায় হয়ে তারই শরণাপন্ন হলাম - কী ব্যাপার রে রতন, জটলা কেন? রতন চোখ পাকিয়ে বলল, সুই...সআআআ...ই...ড।

আঁতকে উঠে বললাম, বলিস কী? কে সুইসাইড করল? এরপর হাত পা চোখ মুখ নেড়ে রতন যা বলল তাতে বুঝলাম ভয়ের কিছু নেই। সুইসাইড এখনও হয়নি, তবে হতে পারত। মিনিট দশেক লাগল পুরো ব্যাপারটা বুঝতে। দাস পাড়ার লকাই সুইসাইড এর চেষ্টা করেছিল। কেরোসিন ঢালছিল দেহে। এমন সময় কট রেড হ্যান্ডেড। দেখে ফেলেছে প্রতিবেশীর মেয়ে মঞ্জু। লকাই মরার জন্য মরিয়া। দেশলাই নিয়ে উদ্যত। মঞ্জু প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে রুখে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে দেশলাই।

উত্তেজিত হলে রতনের হাকলানোটা বেড়ে যায়। তখন মনে হয় পুওর সিগন্যালের মোবাইলে কথা বলছি কারো সাথে। বেশ বুঝতে পারছি যে মনের খিদেটা ঠিকঠাক মিটছে না। এমন সময় দেখা পেলাম স্বপনের। দেখা পেলাম না বলে সেই দেখা দিল বলা যায়। রতনের হাতে আমার দুরবস্থা টের পেয়ে ভীড়ের মধ্যে থেকে নিজেই এগিয়ে এল। জানা গেল আরও নতুন কথা - কেসটা সিম্পল না, রহস্য আছে। সুইসাইড স্বেচ্ছায় নয়। লকাইকে নাকি সুইসাইডে বাধ্য করা হয়েছে। আর পাড়ায় টেনশন সেই নিয়েই।

- বাধ্য করেছে কে?

- শোনা যাচ্ছে নাকি কোনও এক মন্টু।

 

কনফিউশনটা থেকেই গেল। পাড়ায় দুজন মন্টু। একটা কাবলে মন্টু আর একজন গ্যারেজ মন্টু। কাবলে মন্টু কাবলিওয়ালার কর্মচারী। কাবলিওয়ালার সুদের কারবারের লেনদেন হয় তার মাধ্যমে। দ্বিতীয় মন্টু মোটর মেকানিক। এদের মধ্যে কোন জন?   

প্রশ্নটা রাখতে স্বপন বললে, কাবলে মন্টুর সম্ভাবনাই বেশি। তার সাথে ইদানীং লকাইকে কথাবার্তা বলতে নাকি অনেকেই দেখেছে।

এলাকায় কাবলে মন্টুর রেপুটেশন ভালো না। চশমখোর বলে বদনাম। অন্যদিকে লকাইয়ের বেশ নামডাক। পাড়ার শক্তি সংঘের সে এক নামকরা সদস্য। ক্লাবের বিভিন্ন শক্তি প্রদর্শনের কাজে তার হাতযশ বড় কর্তাদের পর্যন্ত নজর টেনেছে। শক্তি সংঘের জনা পনেরো তাই মরিয়া। প্রমান পাওয়া গেলেই কাবলে মন্টুর বারোটা বাজানো হবে।

স্বপন আরো একটা জোরালো খবর দিলে। বললে, শ্যামবাবুর কাছেও খবর পাঠানো হয়েছে। শ্যামবাবু মানেই সিরিয়াস কেস, কেননা তিনি হেভিওয়েট নেতা। এ পাড়ার হর্তাকর্তা বিধাতা বলা যায়। তার হাতে কেস উঠেছে মানে অনেক দূর যাবে এ জিনিস।

সত্যি বলতে কি, শ্যামবাবুর সাথে "দূরত্ব"র একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। খবরে প্রচার তিনি হেসেলের ইস্যুকে বহুদূর - মানে বিধানসভায় বা লোকসভায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন । তবে মানুষ যে তার সাথে দূরত্ব রক্ষা করে - তার কারন পুরোপুরি আলাদা। আসলে তার কথা শুনতে গিয়ে তার "মাউথ - ওয়াটার"এ ভেজেন নি, এমন মানুষ এ এলাকায় অল্পই আছেন। তাই বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া জনসাধারণ তার কাছে বড় একটা ঘেঁসেন না। চামচা বেলচারা অবশ্য তার মুখামৃততে অভ্যস্থ।

নামমাহাত্ম্য আছে ভদ্রলোকের। রঙটা বেজায় কালো তবে অঢেল টাকা পয়সার জন্য তার গায়ে আলাদা একটা জেল্লা আছে। তিনি লকাই-কেসে নড়েচড়ে বসবেন - ব্যাপারটা অস্বাভাবিক না। কেননা তিনি শক্তি সংঘের নামকরা এক পৃষ্টপোষক।

শক্তি সংঘ এক ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। এ পাড়ার এককালের শক্তিমানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সেই শক্তিমানরা ইদানীং শক্তি হারিয়েছেন। তবে ক্লাবের শক্তি অটুট। আগের আমলে ক্লাবের বাইরে ছিল লাল রঙ। এখন রঙ হয়েছে সবুজ।

 শক্তি সংঘের সাথে আমারও একটা যোগাযোগ আছে। আমিও ক্লাবের এক সদস্য, তবে বিশেষ সক্রিয় না। কারন আমি বিশেষ শক্তিমান নই। ওজনে আমি পঞ্চাশের নীচে। ওজন ওপরে উঠবে এমন সম্ভাবনা বেশ কম। আমি তাই নীচু মানের সদস্য। তবে আমি শক্তিমানদের খোঁজ খবর রাখি। ন্যাশন্যাল, ইন্টারন্যাশন্যাল - সব ধরনের শক্তিমানদের ছবি আমার ঘরের দেওয়ালে। সিল্ভেস্টার স্ট্যালোন আছেন, আরনল্ড, ব্রুশলী - কে নেই? এই সমস্ত পেশীবহুল মানুষদের কথা ভাবলে আমার বেশ রোমাঞ্চ লাগে। মনে হয় বিপ্লব বুঝি দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে।

 

বিপ্লবের কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। ঘোর কাটল এক শক্তিমানের হাঁকডাকে। দেখলাম মনাদা নেমে পড়েছেন ফিল্ডে। মনাদা মানে অ্যাকশন অনিবার্য। দেখলাম মনাদার পিছনে জনা কুড়ি ভারী থেকে মাঝারি মাপের চেলা । শঙ্করের চায়ের দোকানে এসে উঠল তারা। অ্যাকশনের গন্ধে আমি তো বিভোর। পা ঘষে ঘষে দোকান মুখো হলাম।

চা দোকানী শঙ্করদা জ্বালানী যোগানোর মাস্টারমশাই। বলল, কিরে মনা ভাই, ব্যাপার কী? ঘরের ছেলেটার ওপর এমন অবিচার হবে আর তোরা বসে বসে দেখবি?"

মনাদা বললে, "চিন্তা নেই দাদা, একটু সময় দাও। খেলা আজই দেখাব। লকাই একটু ঝিমিয়ে আছে, মুখটা একবার খুলুক। তারপর ব্যবস্থা"

মাঝবয়সী হরি ঘোষ সুড়ুত করে চায়ে চুমুক দিতে দিয়ে বললেন, "তা হ্যাঁরে মনা, এ কোন লকাই? মদনের ব্যাটা?"

- সে ছাড়া আর কে? বাপ মরে যেতে পুরো সংসারটা ঘাড়ে এসে পড়েছে ছেলেটার। তবে খাটিয়ে ছেলে, ক্লাবেও কি কম সময় দেয়। কিসে নেই লকাই - পুজোতে, চাঁদা তোলায়, বিগ্রেডে।

- আহা হা! যাক কোনও ক্ষতি হয়নি এটাই রক্ষে।

মধু মিত্তির পাশ থেকে ফোড়ন কাটলেন, "শেষ রক্ষে হয় না রে ভাই। কত সুইসাইড কেস তো দেখলুম, এ লাইনে যে একবার নামে, তার শেষ এ লাইনেই লেখা আছে।"

মনাদা বললেন, " আরে না না, ভুলভাল বললেই হল। এ শালা সেসব কেস নয়। খামোকা মরতে যাবে কেন শুনি? বিয়ে হয়নি, সংসারে অশান্তি নেই। এ শালা নির্ঘাত অন্য কোনও কেস। শুনছি তো কোন মন্টুর বাচ্ছা নাকি জ্বালাতন করেছে। আগে পুরো কেসটা শুনি। তারপর দেখছি। কেরোসিন গেলাব ঐ মন্টুর বাচ্ছাকে"

মন্টুর দুর্ভাগ্যের একটা ছবি আমার মনে আঁকা হয়ে গেল। মনাদার চ্যালেঞ্জ যে সে জিনিস না। পাড়ায় তার একটা আলাদা ইমেজ। বে পাড়ার লোক পর্যন্ত আমাদের নেতাজী কলোনিকে এক ডাকে চেনে মনাদার জন্য। শক্তি সংঘের জাঁদরেল সেক্রেটারি।  মাস তিনেক আগে  দুই পকেটমারের দুর্দশা দেখেছিলাম মনাদার হাতে। ভীড় বাসে দুই পকেটমারকে চুলের মুঠি ধরে তুলে বার দুয়েক মাথা ঠুকে দিয়েছিল মনাদা। দুজনের কপালে তৈরী হয়েছিল দুটো বড়সড় আলু। ছেড়ে দিয়ে মনা দা দুজনকে অর্ধ চন্দ্র দিয়ে বলেছিলেন, "যা শালা ভাগ, ফ্রিতে দুটো চন্দ্রমুখী দিয়ে দিলাম। এর পরে যদি এ লাইনে দেখি তো কপালে গোপাল বসিয়ে দেব।"

তা সত্যিই পারেন মনাদা। তার হাতের পাঞ্জা দেখে সে বিশ্বাস আমার হয়েছে। আমার দুটো পাঞ্জা জড় করলে যা হয় তার চেয়েও হাফ ইঞ্চি চওড়া। সেই হাত আজ যদি মন্টুর ওপর নামে তবে তার কপালের নাম গোপাল হবেই           

 

চা এর দোকান থেকে সরে গিয়ে মাঠের দিকে এলাম। দেখলাম, ফিসফিসে গলায় আলোচনা চলছে। সদ্য রিটায়ার্ড শুভেন্দু পাল প্রায় সমবয়সী অসীম দত্তকে বলছেন, "সুইসাইড আরও বাড়বে দাদা, এবার দেখবেন শিক্ষিত ছেলেদের সুইসাইড। চাকরি বাকরি সব তো জাদুঘরে চলে গেল।" সাবধানী অসীম দও গলাটা আরও খাটো করে বললেন, "ঠিকই বলছেন তবে এসব আস্তে বলাই ভালো। খাতায় কলমে তো লাখ লাখ চাকরি হচ্ছে বলে শুনছি"।

একটা সাদা গাড়ী এসে দাঁড়াল মোড়ের মাথায়। এ গাড়ী সকলের চেনা। শ্যাম বাবুর গাড়ী। দেখলাম শ্যাম বাবুর গাড়ীর কাচ নেমে এল। দেখা গেল শ্যাম বাবুকে। তার গাড়ীর রং সাদা, পোশাক সাদা, মাথায় সাদা টুপি। ইন্দ্রলুপ্তির কারনে তিনি ক'বছর হল টুপি ধরেছেন। শুধু মানুষটাই যা বেজায় কালো। মনাদা শ্যামবাবুর খুব কাছের মানুষ। গাড়ীর কাচ সরিয়ে মনাদাকে কাছে ডাকলেন শ্যামবাবু। তার কানে কানে কিছু কথা বললেন। তারপর হুস করে বেরিয়ে গেল গাড়ীটা।

নিশ্চয়ই কিছু একটা আদেশ পেয়েছেন মনাদা। জনগণের প্রত্যাশা যে বেড়ে গেল তা বেশ বুঝলাম। মনাদা বলল, "চ এবার লকাই এর বাড়ী যাওয়া যাক।" কলোনির মোড় থেকে লকাইদের বাড়ী হেঁটে মিনিট তিনেকের পথ। মনাদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, "দাঁড়া, যাওয়ার আগে সুখটানটা একবার দিয়ে দিই।" চেলা চামুন্ডারাও বেশ কয়েকজন ধরাল একটা করে।

"পে... দা আআ...নি  আআ... জ  বাঁ...ধা, কী... ব... ল...ইই ইস?" দেখলুম রতন আমার পিছনে। চোখ চকচক করছে। উৎসাহ অনেকের চোখে মুখে। লকাইয়ের মুখ থেকে শুধু আসল নামটা জানার অপেক্ষা।

তবে না, অতটা অপেক্ষা করতে আমাদের হল না। দেখলাম কাবলে মন্টু বাইক নিয়ে হাজির। এ যেন মেঘ না চাইতে জল পাওয়া। ক্লাবের ছেলেরা তার বাইক ঘিরে ধরলে। সে মনাদার কাছে এসে বললে, "দাদা আপনার কাছেই আসা। এর ওর মুখে শুনছি সুইসাইড কেসে নাকি আমার নাম জড়িয়েছে। আমি তো মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।"

পাশ থেকে আওয়াজ এল, 'কিচ্ছু জানে না রে... ন্যাকা চণ্ডী"

মনাদা বললেন, "রাস্তায় কোনও কথা হবে না। ক্লাবে চলুন। বসে কথা হবে"

কমজোরি সদস্য হলে কী হবে, ক্লাব ঘরে এন্ট্রি পেয়ে গেলাম। দরজা বন্ধ করে আলোচনা শুরু হল। সকলের চোখ মন্টুর দিকে। বেঁটেখাটো চেহারা। ঠোটটা যেন ঈষৎ কাপছে। বাটারফ্লাই গোঁফ নড়ছে। এমন দুঃখী বাটারফ্লাই আমি জীবনে দেখিনি। মন্টুর মুখটা বেশ শুকনো।

 মনাদা বললেন, "আপনার সাথে লকাই কে এলাকায় কথা বার্তা বলতে প্রায়ই দেখা গেছে। ব্যাপারটা কী খোলসা করে বলুন তো?"

- ব্যাপার সামান্যই দাদা। হাজার কুড়ি টাকা ধার দিয়েছিলুম লকাই কে। তা সেই নিয়েই কথা আর কি।"

- সুদের টাকার তাগাদা দিতেন, তাই তো?

- হ্যাঁ মানে, মাঝে মাঝে বাকি পড়ে যায়, তখন একটু তাগাদা দিতেই হয়, সকলকে যেমন দিই, লকাইকেও তেমনি বলি, এই আর কি!

মনাদার চোখ দেখে মনে হল শিকারকে আস্তে আস্তে যেন চেপে ধরছেন তিনি। গলা চড়ালেন মনাদা, "শুধু তাগাদা দেন, নাকি জোর জুলুমও করেন?"

- না মানে, জুলুম কেন করবো? বুঝিয়ে বলি যে সুদ বাকী পড়া তো ভালো জিনিস না। নিজেরই তো ক্ষতি। 

- নিশ্চয়ই চাপা চাপি করেছেন, নয়ত এমনি এমনি কেউ গায়ে কেরোসিন ঢালে?

- না দাদা, বিশ্বাস করুন,  চাপটাপ নয়, একদমই নয়।

- কিন্তু আপনার নামটাই তো সে নিয়েছে বলে শুনছি। শুধু শুধু নাম নেবে কেন?

- দেখুন দাদা আমি নির্দোষ। টাকা তো আমার নয়, কাবলিওয়ালার টাকা। আমি তো মোটে কর্মচারী। শুধু দেওয়া নেওয়ার কাজ করি মাত্র।

- আপনি বসুন একটু। আমি লকাইকে ডেকে পাঠাচ্ছি। দুজনকে মুখোমুখি বসিয়ে জানব আসল কথা। দেখবেন তখন যেন কথা বার্তা বাঁকাচোরা না হয়।

কাবলে মন্টুর মুখটা আরও একটু শুকিয়ে গেল। স্পষ্ট দেখলুম তার কপালে বেশ ঘাম জমেছে। মনাদা পিকলু আর প্যান্টাকে পাঠাল লকাইকে ডেকে আনতে।

আমরা অপেক্ষায়। এমন সুযোগ খুব একটা আসে না। মনে পড়ছে মার্চেন্ট অব ভেনিস এর সাইলকের কথা। একের নম্বরের শয়তান সুদখোর। বলেছিল কিনা এক পাউন্ড মাংস কাটবে অ্যান্টনিওর বুক থেকে। সকলের কত অনুরোধ, ভাই আন্টনিও কে ছেড়ে দে। দ্বিগুণ টাকা নে, তিনগুন নে। নাঃ, শালা কোনও কিছুতেই গলে না সে জিনিস। দাবী সেই একটাই - এক পাউন্ড মাংস। শেষমেশ সব গেল। ধারের টাকা, সুদের টাকা, সম্পত্তি - সব গেল।

ছোট থেকে কতবার ভেবেছি সেই আদালতে যদি থাকতাম তাহলে কয়েক ঘা চাপিয়ে দিতাম শয়তানটাকে। আজ সেই  মাপের এক সুদখোরকে যেন দেখছি চোখের সামনে। এ নিশ্চয়ই চাপ মেরেছে। মনে হচ্ছে, এর একটা ভালো মত ব্যবস্থা হওয়া দরকার। মনে মনে ভাবলুম এও এক বিপ্লব, ফরাসী, রুশের মত বড় মাপের জিনিস আমাদের কালে আর হবে না। এই নেতিয়ে পড়া যুগে ঘোলের স্বাদেই দুধকে চিনে নিতে হবে।

বন্ধ ঘরে অনেকজন। সাফোকেশন হচ্ছে। মনা দা আরও একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। কচিকাঁচারা সিগারেট খেতে বাইরে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ঘরে মিনিট দশেক কেটে গেল। ওদিকে কাবলে মন্টু ঘামছে। হঠাৎ বাইরে থেকে আওয়াজ এল, "আসছে আসছে।"

 

মরা নদীতে যেন জোয়ার এল। বিচার সভা হয়ত জমে উঠবে এবার। কিন্তু না, চেয়ে দেখলুম শুধু পিকলু আর প্যান্টা এসেছে। লকাই আসেনি। পিকলু মনাদার কাছে গিয়ে কানে কানে ফিস ফিস করে কিছু একটা বলল। মনাদার মুখটা নিমেষের মধ্যে যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠল।

কিছুক্ষণ পিন-পড়া স্তব্ধতা। মনাদাই নীরবতা ভাঙলেন। বললেন, "মন্টু বাবু, আজ বরং আপনি বাড়ী যান। লকাই আজ অসুস্থ, আসলে মনটা ভেঙে আছে তো। আজ সে মুখ খুলছে না। ওর ওপরে আজ আর চাপ দেব না আমরা। কাল বা পরশু এ ব্যাপারে জানাব আপনাকে।"

মন্টুবাবু চলে গেলেন। আমরা যেন একটু হতাশ হয়ে গেলাম। এতবড় একটা আয়োজন ভেস্তে গেল। লকাইটাই বা কী? গায়ে নয় কেরোসিন ঢেলেছিস। আগুন তো আর লাগেনি। ইনজুরি তো নেই! পায়ে পায়ে ক্লাবে এলে কী আর হত?

সাত পাঁচ ভাবছি। হঠাৎ মনাদা বললেন "ধুর ধুর, যত সব কেচ্ছা। চ্যাংড়াদের কেস!"

- কেসটা তাহলে কী? সকলের প্রশ্ন যেন আছড়ে পড়ল তার ওপর

মনাদা বললেন, "ওরে প্রেমের কেস। মনকষাকষি হয়েছে। তাই তাকে শিক্ষা দিতে গায়ে ঢেলেছে কেরোসিন।"

- অ্যাঁ, তাহলে মন্টু মন্টু করছে কেন?

- মন্টু নয় রে, বলছে মঞ্জু মঞ্জু । তাকে নিয়েই তো আসল গল্প। আর সেই কিনা বাঁচিয়েছে।

- বল কী?

মনাদা বললেন, "এই তো আসল কথা স্বীকার করেছে বন্ধুদের কাছে। দেখলাম মনাদার পাশে বসে পিকলু আর প্যান্টা ফিক ফিক করে হাসছে

সে হাসিতে আমরাও যোগ দিলাম। তবে শেষমেশ মনাদা একটা ওয়ারনিং দিলেন। বললেন, "দেখিস কথাটা যেন পাঁচ কান না হয়। লকাইয়ের একটা মান সম্মান আছে তো নাকি!" 

ফিরে আসছি। রতন পিছন থেকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। বলল, ল...কা...ইয়ের লাআআক টা হেব ভি বল। প্রা আআআআ...নটা বাঁচল প্রে এ এ এ মটাও।

রতনের কথায় আমার বোধোদয় হল।  বিপ্লবের খোঁজে ছিলাম। তা ছোট মাপের এক বিপ্লব হল বৈকি। প্রেম বাঁচল, প্রাণ বাঁচল - এই বা কম কি পাওয়া? বিপ্লব আর প্রেম - দুটোই তো স্যাঙাতের মত।

 

তন্ময় চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top