সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

খোজকর : শ্যামল কান্তি ধর


প্রকাশিত:
১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৩১

আপডেট:
৭ মে ২০২৪ ০৩:০৩

ছবিঃ শ্যামল কান্তি ধর

 

ভুবন খালের সাঁকোর মাঝখানে এসে রাখালের মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা ভয় আরো বিস্তৃত হল। যতদূর চোখ যায় শুধুই ধানের শীষের  সোনালী ঢেউ, কোন মানুষের দেখা পাওয়া যায়না। আজ হাটবার, তাই কয়েক গ্রামের মানুষ হাটে চলে যাওয়ায়  বিস্তীর্ণ খেতে এ নির্জনতা। হেমন্তের শেষ দুপুরের বাতাসে ধানের শীষের  দোল খাওয়ার শব্দও  রাখালের ভয়কে আজ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে, কোনরকম ভাবে সাঁকো পেরিয়ে তার মনে হল, ফিরে যাওয়াটাই ভালো কিন্তু ফিরতে গেলেও অনেকখানি পথ পেরোতে হবে। দ্বিধান্বিত মন নিয়ে রাখাল তাই তার বাড়ির পথেই পা বাড়ায়। সর্বানন্দপুর থেকে চার গ্রাম পেরিয়ে তাদের গ্রাম। মাঝে আছে গাঙিনার হাওড়। রাখাল দুই গ্রাম পেরিয়ে এখন  গাঙিনার হাওড়ের সামনে। বর্ষায় যে হাওড় জলের ভারে ফুলে ফেঁপে ওঠে, হেমন্তে সে হাওড়ের বুকেই দোল খায় সোনালী ধানের শীষ। এই হাওড়ের জলে নৌকাডুবিতে মারা গিয়েছিলেন তার বাবা,তখন সে অনেক ছোট। বাবার মুখ সে কিছুতেই মনে করতে পারেনা।

রাখাল ধানখেতের আইল ধরে হাঁটতে থাকে। তাকে অবাক করে দিয়ে একঝাঁক চড়ুই পাখি নেমে আসে ধানখেতে, আরেক ঝাঁক উড়াল দেয় আকাশের দিকে। রাখাল মুগ্ধ হয়ে শোনে পাখিদের কিচির মিচির, তবু তার ভয় যায়না। এখন তার বারবার মনে হচ্ছে, মার কথা না শোনে সে বিরাট ভুল করে ফেলেছে। উত্তর  বাড়ির খুড়ার সাথে সে এসেছিল  সর্বানন্দপুরের  মাছের মেলায়। মা যদিও রাজি ছিলেননা, তার পীড়াপীড়িতেই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিলেন কিন্ত বারবার বলছিলেন, তোর খুড়ার হাত ছাড়িসনা বাবা। সে খুড়ার হাত ছাড়তে চায়নি কিন্তু যখন ষাঁড়ের লড়াইয়ের দুটো লাল ষাঁড় ক্ষেপে গিয়ে  মাঠ ছেড়ে বাইরে এলো, তখন লোকজনের হুড়োহুড়িতে সে খুড়ার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর মেলার কয়েকটি দোকানে আগুন লাগার ফলে হুড়াহুড়ি আরো বেড়ে যাওয়ায়, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে তার খুড়াকে  পেলনা।

দুই

রাখালদের গ্রামে কয়েকদিন আগ থেকে “খোজকর” বেরিয়েছে বলে একটা খবর রটেছে। সেই খোজকর নাকি ধানখেতের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এবং ছোট ছোট বাচ্ছাদের ধরে নিয়ে যায়। রাখাল  শুনেছে,  দীঘল নদীর উপর যে সেতু নির্মাণ হচ্ছে, সেই সেতুর কাজ অর্ধেক এসে থেমে গেছে। এরপর অনেকেই নাকি স্বপ্নে দেখেছে যে, অসম্পূর্ণ সেতুর কাজ সমাপ্ত করতে হলে  প্রয়োজন ছোট ছোট শিশুদের গলাকাটা মাথা। সাথে সাথে এই স্বপ্নের কথা দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । তাই আবার খোজকর বেরিয়েছে। কয়েকদিন আগে নদী পারে  একটা ছোট বাচ্ছার গলাকাটা মাথা পাওয়া গেছে। তাদের পাশের গ্রামের তারই সহপাঠী দু'জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

রাখালের মায়ের নিষেধের কারনে সে একা একা দূরে কোথাও যায়না, এমনকি স্কুলেও না। গুলতি হাতে নিয়ে বাড়ির আশে পাশে ঘুরে বেড়ায়, পাশের বাড়ির  “একলা বুড়ির”কাছে গল্প শুনতে যায়। দুপুর রোদে লাল ফড়িঙের পেছনে দৌড়তে দৌড়তে যখন ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ায়, তখন মা তার শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দেন। পুকুরের জলে চলে তার অবাধ সাঁতার। খোজকর দেখতে কেমন তার জানতে ইচ্ছে করে।তারা কি দেখতে মানুষের মত! একলা বুড়িকে জিজ্ঞেস করেছিল।

বুড়ি গল্পের মত করে বলেছিল, তা মানুষের মত হতে পারে আবার নাও হতে পারে। ভালো মানুষ যেমন আছে,খারাপ মানুষওতো আছে। অনেক অনেক বছর আগে এই অঞ্চলের এক রাজা ছোট ছোট বাচ্ছাদের ধরে নিয়ে গিয়ে পূণ্য লাভের আশায় বলি দিতেন। কাউকে কাউকে অনেক  নির্যাতন করে  ভিনদেশে পাচার করে দেয়া হত। তাই শিশুদের খোঁজে ছেলেধরাদের পাঠিয়ে দেয়া হত বিভিন্ন এলাকায় ।এরাই খোজকর।

বুড়ির গল্পের কথা মনে হতেই রাখালের  গা শিউরে ওঠে। সেই খোজকর আবার বেরিয়েছে। তার গলা শুকিয়ে যায়। স্কুলের যাবার পথের চালকলের মতিলালের কথা মনে পড়ে।  মতিলাল প্রায় সময়ই রাখালকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কিসব জানি বলে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেয়,ব্যাথা দেয়। রাখালের তা একদম ভালো লাগেনা। মতিলাল কেন এরকম করে তা সে বুঝতে পারেনা। সে এখনো কাউকে কিছু বলেনি। একদিন মাকে বলতে হবে। খোজকর দেখতে নিশ্চয়ই মতিলালের মত। মতিলাল খুব খারাপ মানুষ।

তিন

উত্তর বাড়ির শৈলেন্দ্র খুড়া আজ সর্বানন্দপুরের মেলায় যাচ্ছেন জেনে রাখাল ভয়কে উপেক্ষা করে মেলায় যাবার জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরেছিল কিন্তু এভাবে একা ফিরতে হবে তা সে ভাবেনি। দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল হতে চলল। রাখাল বিস্তীর্ণ ধানখেতের আইল ধরে ভীরু ভীরু পায়ে এগিয়ে চলে। মনে তার খোজকরের ভয়, যদি হঠাৎ ধানখেতের আড়াল থেকে দা হাত খোজকর বেরিয়ে আসে! খোজকর কি তাকে বস্তাবন্দি করে ধরে নিয়ে যাবে, না তার মাথাটা শুধু কেটে নিয়ে  সেতুতে ঝুলিয়ে রাখবে, নাকি মতিলালের মত তাকে কষ্ট দেবে।তার মা আর তাকে দেখতে পাবেননা। মাথাহীন তার এই শরীর দেখে  মা কি তাকে চিনতে পারবেন। এইসব ভেবে রাখালের ভীষণ কান্না পায়। মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। এবার হাওড়ের বাম্পার ফলন হয়েছে। উঁচু উঁচু ধানগাছ রাখালের মাথা ছাড়িয়ে গেছে। ধানখেতের আইল ধরে, ধানের শীষের আড়ালে  রাখাল একটু যেন ভরসা পায়। তাকে কেউ দেখতে পাবেনা। কেউ আসলেও সে আইল ছেড়ে খেতের মধ্যে দিয়ে  চুপিচুপি মায়ের কাছে চলে যাবে কিন্তু তার ঘ্রান শুনে খোজকর যদি তাকে খোঁজে বের করে? একলা বুড়ির কাছে সে জেনেছে, খোজকরের ঘ্রানশক্তি খুব প্রখর হয়।

ছড়িয়ে পড়া গুজবের ফলস্বরূপ কিছু  বিকারগ্রস্ত ও হিংস্রতম মানুষ  ছোট ছোট শিশুদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। কেউ কেউ সত্যি বিশ্বাস করে সেতুতে গলা কাটা মাথা নিয়ে দিতে পারলে পূন্য লাভ হবে, সাথে প্রতিপত্তি, কেউবা আবার অপহরণ করে নিয়ে মুক্তিপন দাবি করে। গত কয়েকদিন ধরে কয়েকটি শিশু নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে। রাখাল যে হাওড়ের বিস্তীর্ণ ধানখেতের আইল ধরে হেঁটে চলছে, সেখানে এই রকম কিছু লোকের উপস্থিতি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না। কিছুদূর হাঁটার পর রাখাল দূরে আইলের উপর এরকমই  তিনজন লোককেই যেন বসে থাকতে দেখল,তবে তারা  রাখালকে এখনো দেখেনি। মাথা ঘুরালেই তারা তাকে দেখতে পাবে। ভয়ে কাঁপতে থাকে রাখাল। তাকে চমকে দিয়ে আরো একঝাঁক পাখি আকাশপানে উড়াল দিল।পাখিগুলো উড়াল দেবার সাথে সাথে এক  নিঃসঙ্গতার বোধ যেন রাখালকে ঘিরে ধরল। সে আরো একঝাঁক পাখির অপেক্ষা করছে। রাখাল আর সামনে না এগিয়ে একটা বড় ধানক্ষেতের আড়ালে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে  পৌঁছে গেল খেতের মাঝখানে।

লুকিয়ে থাকা তো গেল কিন্তু একলা বুড়ির হিসেব মত খোজকরদের ঘ্রানশক্তি যদি প্রখর হয় তাহলে তো তারা তার ঘ্রান পেয়ে চলে আসতে পারে। রাখাল আর কিছু ভাবতে পারেনা, কেবলি তার মায়ের মুখ ভেসে আসে।প্রচণ্ড কান্না পায়।বিকেলের আলো কমে গিয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে। শৈলেন খুড়া তাকে না পেয়ে মেলা থেকে নিশ্চয় এ পথ দিয়ে ফিরবেন। বাজার ফেরত মানুষরাও  ফিরবে। মা হয়তো এতক্ষনে হারিকেন হাতে একলা বুড়িকে নিয়ে তার খোঁজে  বেরিয়ে গেছেন। সন্ধ্যার অন্ধকারের আগেই কয়েকটি সাদা বক উড়ে গেল। দূরে কোথাও একটা ডাহুক ছানা ডেকে চলছে। আহারে! ডাহুক ছানাও কি রাখালের মত কোন বিপদে পড়েছে,তাই ভীরুমনে ডেকে চলেছে তার মা পাখিকে। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের সুর, জেলেপাড়া থেকে ভেসে আসে নারীদের উলুধ্বনি। রাখাল ধানখেতের আড়ালে বসে থাকে একা, বাঁচার অপেক্ষায়।

 

শ্যামল কান্তি ধর
লেখক ও ব্যাংকার

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top