সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

রাজা শলোমনের হিতোপদেশ ও মনুষ্যত্বের শিক্ষা : প্রফেসর এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ


প্রকাশিত:
২৪ জুন ২০২১ ১৯:৩৮

আপডেট:
৭ মে ২০২৪ ১৮:৪০

ছবিঃ : প্রফেসর এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ

 

হিতোপদেশ পুস্তকটি উপদেশ, প্রবাদ ও আপ্তবাক্যের আকার বা শৈলীতে নীতিশিক্ষা ও ধর্মীয় উপদেশের একটি সংকলন। এর অধিকাংশই দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিষয় নিয়ে লিখিত। "সদাপ্রভুর ভয় জ্ঞানের আরম্ভ"- এই কথা স্মরণ করিয়ে হিতোপদেশের উপদেশাবলী আরম্ভ হয়েছে। শুধু ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয় নিয়েই নয়, বাস্তব ক্ষেত্রেও সাধারণ বুদ্ধি ও সৌজন্যবোধ এর কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির আচরণ কেমন হওয়া উচিত- এই বিষয়ে হিতোপদেশের সংক্ষিপ্ত অথচ বুদ্ধিদীপ্ত প্রবচন প্রাচীন গুরুদের গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় বহন করে। এই পুস্তকের কতগুলো প্রবাদ পারিবারিক বিষয় লইয়া রচিত এবং কতকগুলি ব্যবসা সংক্রান্ত আদান-প্রদান লইয়া লিখিত। কিছু সংখ্যক উপদেশ সামাজিক সৌজন্য বিষয়ক ও অন্য কতকগুলি আত্মসংযম বিষয়ক। নম্রতা, সহিষ্ণুতা, দরিদ্রের প্রতি সম্মানবােধ এবং বন্ধুদের প্রতি আনুগত্যের কথা পুস্তকটিতে খুব বেশী বলা হয়েছে।

মানুষকে সর্বপ্রথম মনুষ্যত্ব লাভের জন্য যত্নশীল হতে হবে। মনুষ্যত্ব লাভের পথ কখনও কুসুমাস্তীর্ণ নয়; বরং পিচ্ছিল ও কন্টকাকীর্ণ। মানুষের মত মানুষ হতে হলে সেই দুর্গম পথেই অগ্রসর হতে হবে। পার্বত্য নদী বাধার পর বাধা অতিক্রম করে বৃহৎ হতে বৃহত্তর হয়; উভয় কূল উর্বর ও শস্যশ্যামলা করে জীব-জগতের অপ্রমেয় হিতসাধন করে এবং শেষে আপন লক্ষ্য মহাসমুদ্রে মিশে যায়। মানুষকেও তেমন জীবন-পথের সকল বাধা অতিক্রম করে আত্ম-পরহিতের মাধ্যমে মহৎ হতে মহত্তর হতে হবে এবং শেষে শান্তি-সমুদ্রে মিশে যেতে হবে। প্রজ্ঞাবান এবং বীর্যবান না হলে মনুষ্যত্বের এ দুর্গম পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। অতএব মানুষের মত মানুষ হতে হলে প্রত্যেককে যেমন প্রাজ্ঞ হতে হবে তেমন মানসিক বলে বলীয়ান হতে হবে।

সৌভাগ্যক্রমে অক্ষণমুক্ত শ্রেষ্ঠ মানবজীবন লাভ করলেও ইহার সদ্ব্যবহার করতে পারে তেমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত অল্প। কর্মানুসারে মানুষ যেমন অধ্যাপক ডাক্তার উকিল ও কুলি-মজুর নামে পরিচিত, তেমন মানুষের কর্মানুযায়ী বুদ্ধ মানুষকে তমতমপরায়ণ, জ্যোতিমতপরায়ণ, তমজ্যোতি পরায়ণ ও জ্যোতিজ্যোতিপরায়ণ রূপে ভাগ করে দেখিয়েছেন। প্রথম দুই শ্রেণীর মানুষ অধোগামী এবং দ্বিতীয় দুই শ্রেণী ঊর্ধ্বগামী। অন্যস্থানে ঊর্ধ্বগামী মানুষকে “পরমার্থ মানব” এবং অধোগামীকে তাদের কর্মানুসারে “পশু” “প্রেত” ও নারকী মানব বলে অভিহিত করেছেন। জীবন সম্বন্ধে অজ্ঞ ব্যক্তি উচ্চ ডিগ্রী এবং বিপুল ধনের অধিকারী হলেও পশু প্রেত বা নারকী মানবের জীবনই যাপন করে থাকে। জগতের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে তেমন শত শত দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে।

সাধারণ মানুষের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডিগ্রী পেলেই মানুষ জ্ঞানী হয়। সে-ধারণা সত্য নয়। ধনীদের অনেকে ভাল ভাল খাদ্য খেয়ে অজীর্ণ রোগাদিতে আক্রান্ত হয়ে যেমন বেশী দুর্বল হয়ে যায়, তেমন শিক্ষিতদের অনেকও ভাল ভাল বই পড়ে সার গ্রহণ করতে অক্ষম হয়ে বেশী মূর্খ বা অসৎ ও পাপী হয়। প্রকৃতপক্ষে ধন যেমন একটা শক্তি, শিক্ষাও তেমন একটা শক্তিমাত্র। ধন মূর্খের (অসতের) নিকট উৎপন্ন হলে তার দ্বারা যেমন নিজের ও মানব সমাজের বিপুল অহিত হয়, তেমন মূর্খ শিক্ষার অধিকারী হলে নিজের ও পরের মহা অমঙ্গল করে থাকে। তাই বিজ্ঞজনের উপদেশ-মণিদ্বারা ভূষিত হলেও বিষাক্ত সর্প যেমন ভয়ঙ্কর, তেমন বিদ্যার দ্বারা অলঙ্কৃত হলেও দুর্জন পরিত্যাজ্য।

দুশ্চিন্তাকারী, দুর্বাক্যভাষী ও দুষ্কর্মকারী হয়। তেমন না হলে পণ্ডিতগণ কিরূপে জানতেন যে, এ ব্যক্তি মূর্খ-অসৎ পুরুষ? উক্ত কাজের দ্বারা মূর্খ অব্যক্ত অসৎ নিজেকে ক্ষত উপহত করে দোষণীয় বিজ্ঞনিন্দিত জীবন যাপন করে। ইহাতে সে বিপুল পাপ সঞ্চয় করে।” তৎবিপরীতই পণ্ডিতের লক্ষণ কৃত্য। ধনীদের অনেকে রোগগ্রস্ত এবং দুর্বল হলেও যেমন সবাই ধনী হতে চায়, তেমন শিক্ষিতদের মধ্যে মূর্খ বা অসতের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও সকলকে শিক্ষিত হবার চেষ্টা করতে হবে।

সারকথা মানুষকে ধনী যেমন হতে হবে, তেমন সুস্থও হতে হবে। সেরূপ শিক্ষিত যেমন হতে হবে তেমন জ্ঞানীও (সৎ) হতে হবে। এ জ্ঞানী হওয়া অর্থ জীবন সম্বন্ধে জ্ঞানী হওয়া। জীবন নিয়ে যত সাধনা গবেষণা হয়েছে তাদের লিপিবদ্ধ রূপই ধর্মশাস্ত্র। অতএব ধর্মশাস্ত্রই জীবনশাস্ত্র জীবনবেদ, জীবনদর্শন ও জীবন-বিজ্ঞান। তাই ধর্ম বা জীবন সম্বন্ধে অজ্ঞ ব্যক্তিই ইতর-মানবের জীবন যাপন করে থাকে। মানুষের মত মানুষ হতে হলে প্রথম জীবন হতেই ধর্মশিক্ষা লাভ করতে হবে এবং ধর্মশীল হতে হবে।

জীবন সম্বন্ধে জ্ঞানী ব্যক্তিই ধার্মিক ও চরিত্রবান হন। তিনি কোন প্রকার প্রলোভন এবং বাধা বিপত্তিতে বিচলিত হন না। প্রয়োজন হলে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্টকে বরণ করেও তিনি ন্যায়-সত্যে স্থির থেকে মনুষ্যত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত ও সুশোভিত হন। এমন মানুষের সংখ্যা আকাশের অগণিত জ্যোতিষ্কের মধ্যে বিশেষ জ্যোতিষ্ক শুকতারাদির ন্যায় কম হলেও তাঁরাই সর্বজনপূজ্য মানবরত্ন। এমন মানুষের আদর্শে জীবন গঠনের জন্য সকলে যত্নবান হওয়া উচিত।

 

প্রফেসর এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ
পায়রা ট্রাস্ট এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top