সিডনী বুধবার, ৮ই মে ২০২৪, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১

জয়ীতা : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০২২ ০১:৩৯

আপডেট:
৩১ আগস্ট ২০২২ ০১:৪৫

 

ডানপিটে জয়ীতা। সারাদিন শুধু ছেলেদের সাথে খেলে বেড়ায়। ক্রিকেট, ফুটবল, মারবেল, একাদোক্কা- আরও কত কী। স্কুল থেকে ফিরেই গ্রামের পুকুরে ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে এপার ওপার সাঁতার কাটা। চোখ লাল করে বাড়ি ফেরা।
দুপুরের খাওয়াটা কোনোরকমে পেটে চালান করে আবার ছেলেদের সাথে সাইকেল চালানো। সাইকেল চালানোটা ভালো করে শেখেনি, তবুও সাইকেলের পিঠে তাকে উঠতেই হবে। কতবার সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে হাত-পা ছিঁড়েছে তার ঠিক নেই।
বাবার রক্তচক্ষু, মায়ের বকুনি-কোনোকিছুকে পাত্তা দেয় না জয়ীতা।
মা বলেন, ‘তুই মেয়ে হয়ে জন্মেছিস-সারাদিন ছেলেদের সাথে খেলে বেড়ালে চলবে? আমি একা ঘরের কাজ করে মরি-আমাকেও তো একটু সাহায্য করতে পারিস।’
বাবা বলেন, ‘তুই বড়ো হচ্ছিস, এসব করে বেড়ালে লোকে মন্দ বলবে।’
পাড়াপ্রতিবেশীরা বলেন, ‘মেয়ে তো নয় যেন একটা গেছোবানর। সারাদিন শুধু পাড়ার ছেলেদের সাথে তার খেলাধুলা। ছেলেদের মতো সাইকেল চালানো। ঘরের কাজে মন নেই। ওই মেয়েকে আর বিয়ে দিতে হবে না। কে বিয়ে করবে ওই গেছো মেয়েকে?’
কোনোকিছুতে পরোয়া নেই জয়ীতার।
বাবাকে অনেক বলেছিল তাকে একটা সাইকেল কিনে দিতে। বাবার সামর্থে কুলোয়নি। পাড়ার ছেলেদের সাইকেল নিয়েই দিনে দিনে সাইকেল চালানোটা বেশ ভালোভাবেই শিখে ফেলেছে জয়ীতা। সে এখন সাইকেলের ক্যারিয়ারে ছেলেদের চাপিয়ে এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে বেড়ায়। ইশকুলে যাওয়ার সময়ও সুমনের সাইকেল কেড়ে নিয়ে ওকে পেছনে বসিয়ে নিজে চালিয়ে যাবে।
বাবা-মা এখন আর কিছু বলেন না। তারাও মেনে নিয়েছেন তার দস্যিপনা। ওকে আর শাসন করে লাভ নেই।
পাড়াপ্রতিবেশী ও গ্রামের লোকজনেরও জয়ীতার ডানপিটেপনা গা-সওয়া হয়ে গেছে। ও এখন ইচ্ছেমতো খেলে। যেখানে খুশি সেখানে যায়। নিজের খেয়ালে সবকিছু করে।
২.
চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরোর চৌকাঠে পা রেখেছে জয়ীতা। তার নেতৃত্বে গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওরা একটা দল তৈরি করেছে। এ দলের সদস্যরা সবসময় মানুষের উপকার করে। কেউ বিপদে পড়লে তাদের সাহায্য করে। কারও চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ডাক্তার ডেকে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। গরিব-দুঃখিদের কোনো সমস্যা হলে এই দলটি তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়।
জয়ীতার বাবা গরিব রিকশাচালক। ডানপিটে জয়ীতা একসময় বুঝতে পারে অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে চলছে তাদের সংসার। আর সেই অভাবের তাড়নায় একসময় ওর লেখাপড়াটা বন্ধ হয়ে যায়। ক্লাস এইটের পর ও স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়। তারপর থেকেই সে চুপচাপ। বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, পুকুরে সাঁতারকাটা, সাইকেল চালানোটাও একটু একটু করে বন্ধ করে দেয়।
স্কুল ছেড়ে পরিবারের ছোটখাটো কাজে মন দিতে হয় জয়ীতাকে। মা আর পাঁচ ভাইবোনের সংসারে বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম। জয়ীতার বাবা মোহন পেশওয়ান রাজধানী নয়াদিল্লির কাছাকাছি গুরুগাঁও শহরে রিকশা চালান। বিহারের দরভাঙ্গা গ্রামে থাকে জয়ীতাদের পরিবার। বাবার রিকশা চালানোর উপার্জন দিয়েই সংসার চলে। খেয়ে না খেয়ে টেনেটুনে কোনোরকমে চলছিল তাদের জীবন।

বিধির ইচ্ছে অন্যরকম। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন মোহন। বাবার সেবা করতে গ্রাম থেকে শহরের হাসপাতালে আসে জয়ীতা। ডাক্তারের চিকিৎসা ও মেয়ের সেবায় একটু একটু করে জয়ীতার বাবা মোহন পেশওয়ান সুস্থ হয়ে ওঠেন।
বিপদ পিছু ছাড়ে না। এরই মাঝে মহামারী করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সারা পৃথিবীর মতো স্তব্ধ হয়ে পড়ে ভারতীয় উপমহাদেশ। ভারতজুড়ে মার্চের শেষে ঘোষণা করা হয় লকডাউন। বন্ধ হয়ে যায় বাস-ট্রেনের চাকা। শহরে আটকে পড়েন গ্রাম থেকে কাজ করতে আসা হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক। পায়ে হেঁটেই কেউ কেউ রওনা হয় নিজ নিজ বাড়ির ঠিকানায়। পথে মারা যান অনেকেই। তেলেঙ্গানা রাজ্যের মরিচ খেতে কাজ করতে আসা এক কিশোরী চামলো মাকদোম পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছানোর সময় নিজ বাড়ি থেকে মাত্র চৌদ্দ কিলোমিটার দূরে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। এই ঘটনা ভারতজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। চামলো মাকদোমের মতো জয়ীতা আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় যেকোনোভাবেই হোক তার সদ্য সুস্থ্য হয়ে ওঠা বাবাকে নিয়ে গ্রামে পৌঁছবে। মোবাইলে মাকে জানিয়ে দেয়, ‘বাবাকে নিয়ে যেভাবে হোক যত কষ্টই হোক বাড়িতে ফিরবে সে।’
মা জানতে চান, ‘কীভাবে সম্ভব, বাস-ট্রেন তো চলছে না।’
জয়ীতা মাকে চিন্তামুক্ত থাকতে বলে।

৩.
লকডাউনের পাল্লায় পড়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকরা। খবরে পাওয়া যায় আটকেপড়া শ্রমিকরা হাঁটছেন শত-শত কিলোমিটার। পথে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে অনেকে। দুর্ঘটনায়। খিদের জ্বালায়। ক্লান্তিতে। পনেরো বছরের কিশোরী জয়ীতা সিদ্ধান্ত নেয় অসুস্থ বাবাকে সাইকেলে চাপিয়ে পেরিয়ে যাবে বারোশো কিলোমিটার পথ! অসম্ভব? আমাদের কাছে এমনটা মনে হতেই পারে।
গন্তব্য বারোশো কিলোমিটারের পথ পেরিয়ে বাড়িতে পৌঁছানো। সম্বল বলতে বারোশো টাকায় কেনা পিংক কালারের একটা বাইসাইকেল। অল্পকিছু টাকাপয়সা। আর কিছু শুকনো খাবার। জয়ীতা আগেই অঙ্ক কষে নিয়েছিল যে দশ দিনে সে বাড়িতে ফিরবে। তার মানে প্রতিদিন তাকে গড়ে একশো বিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। বাবা মেয়েকে নিষেধ করেছিলেন। তিনি জানেন এটা অসম্ভব। কিন্তু মেয়ের অদম্য মনোবালের কাছে পরাজিত হয় বাবার অভিজ্ঞতা।

৪.
জয়ীতা সাইকেলটাকে চুমু খেয়ে বাবাকে পিছনে বসিয়ে প্যাডেলে পা রাখে। শুরু হয় জার্নি। ঘরে ফেরার সংগ্রাম। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য। সাইকেলের পেছনে বসা অসুস্থ বাবা। তিনি জানেন সাইকেলের প্যাডেল ঘোরানো কত কষ্টের। জয়ীতা প্রথমে ভেবেছিল গ্রামের পথে, স্কুলের পথে সে তো কতবারই বন্ধুদের নিয়ে সাইকেল চালিয়েছে- সাইকেল চালানো তেমন কঠিন কিছু না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে দীর্ঘ সময় ধরে সাইকেল চালানোটা কতো কষ্টের। সাথে অনুভব করছে, তার বাবা কত কষ্ট করে রিকশা চালিয়ে তাদের সংসার চালায়।
প্রথম ঘণ্টায় জয়ীতা প্রায় পনেরো কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। কিন্তু দ্বিতীয় ঘণ্টায় এসে তেরো কিলোমিটারের বেশি যেতে পারে না। এভাবে একটানা ছয় ঘণ্টায় সে ষাট কিলোমিটার পথ পেরিয়েছে। এখন আর সে পারছে না। তার বিশ্রামের প্রয়োজন। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। সঙ্গে থাকা শুকনো পাউরুটি আর কলা খেয়ে আধাঘণ্টার বিশ্রাম।
আবার শুরু হয় জার্নি। জীবন বাজি রেখে ঘরে ফেরার সংগ্রাম। এ সংগ্রামে তাকে জয়ী হতেই হবে। সারাদিন জার্নির পর সন্ধ্যা সাতটার দিকে যখন মন্দিরে মন্দিরে শাক বাজানোর শব্দ ভেসে আসে, দূরের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসে তখন ওরা প্রথম দিনের একশো বিশ কিলোমিটারের চেয়েও কয়েক কিলোমিটার পথ বেশি অতিক্রম করেছে। এখন বিশ্রাম দরকার। পরিপূর্ণ বিশ্রাম। দরকার পর্যাপ্ত খাবার। কে দেবে খাবার? কোথায় পাবে বিশ্রামের জায়গা? বারোশো কিলোমিটারের পুরোটা জার্নিই যে অনিশ্চয়তার। জয়ীতার সম্বল শুধু অদম্য ইচ্ছেশক্তি। রাতটা ওরা একটা পেট্রোল পাম্পের বেঞ্চে কখনো শুয়ে কখনো বসে কাটিয়ে দেয়।

৫.
পরের দিন সকালভোরে আবার সাইকেলের পিঠে চেপে বসে জয়ীতা। সূর্য আলো ছড়ানোর আগেই ওরা ত্রিশ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসেছে। জয়ীতা আজকের অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নেয় যে সূর্য ওঠার আগেই এখন ওরা জার্নি শুরু করবে। জয়ীতা সাইকেলের প্যাডেল সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘুরিয়ে যাচ্ছে। অনিশ্চিত গন্তব্য তবুও তাকে এগিয়ে যেতে হবে। সে তার মাকে কথা দিয়েছে বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরবেই। মাথার উপরে উত্তপ্ত সূর্য। জয়ীতা ঘেমে নেয়ে একাকার। অদম্য ইচ্ছেশক্তি নিয়ে সে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সাইকেলের চেইনটা পড়ে যায়। সাইকেলটা আস্তে আস্তে একটা জায়গায় এসে থেমে যায়। জয়ীতার বাবা সাইকেল থেকে নেমে পাশে দাঁড়ালেন। কিন্তু না তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। দীর্ঘক্ষণ সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে থাকার কারণে তার পা দুটো অবশ হয়ে গেছে। তিনি থপ করে মাটিতে বসে পড়লেন। জয়ীতার সেদিকে খেয়াল নেই। সে সাইকেলের চেইন লাগানোয় ব্যস্ত। চেইন লাগানো হলে সে বাবার দিকে নজর দিতেই দ্যাখে বাবা মাটিতে আলুথালু হয়ে বসে পড়েছেন। বাবার পাশে জয়ীতাও আলুথালু হয়ে বসে পড়ে। তার পা দুটোও ফুলে বালিশ হয়েছে। শরীরটাও ঘেমে নেয়ে একাকার।
কিছুটা বিশ্রাম আর কিছুটা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আবার জয়ীতার জার্নি শুরু হয়। দ্বিতীয় দিনটাও বেশ ভালোভাবেই পার করে ওরা ওদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। বাবা-মেয়ের শরীরটা কালকের চেয়ে আজ আরও বেশি দুর্বল। কিছু করার নেই এসব মেনেই এগিয়ে যেতে হবে। দুই দিনে দুইশো পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। বাকি এখনো নয়শো পঞ্চাশ কিলোমিটার।

৬.
রাত নির্জন। পথে কোনো জনমানব নেই। সাথী দূর আকাশের তারা। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটা মালটানা লরি শাঁ শাঁ করে ওদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার শব্দ। রাতজাগা পাখিদের ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ। রাতের আকাশে সূর্যের প্রখর আলো না থাকলেও ভ্যাঁপসা গরম পড়ছে। বাবা-মেয়ে দুজনেই ঘামছেন। আজ ওদের জার্নি শুরু হয়েছে রাত তিনটার দিকে। একটানা সকাল সাতটা পর্যন্ত জার্নি শেষে একটা চায়ের দোকানে ওরা বিশ্রামের জন্য থামে। চায়ের দোকানের উৎসুক লোকজন একবার কিশোরী জয়ীতার দিকে আরেকবার জয়ীতার বাবার দিকে তাকায়। কিশোরী মেয়ে বাবাকে সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেখে কিছু মানুষ তো বলেই ফেলল, নিজের গতরটা তো বেশ ভালোই মনে হচ্ছে, অযথা মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন মশাই? এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই বাবা-মেয়ের কারও কাছে। জবাব তারা দেওয়ার প্রয়োজনও অনুভব করে না।
ওরা চা ও টোস্ট খেয়ে আবার জার্নি শুরু করে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পথ আজ ওদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও পথের অনিশ্চিত গন্তব্যে ওরা পৌঁছতে পারবে কিনা জানে না।
তৃতীয় দিনের জার্নি শেষে ওদের বিশ্রামের প্রয়োজন। আশপাশে আশ্রয়ের জন্য কোনো জায়গা খুঁজে পেল না। এতো বড় পৃথিবীতে দুটো মানুষের রাত কাটানোর মতো নিরাপদ জায়গা কোথাও নেই। অবশেষে ওরা রাস্তার ধারে কয়েকটা গাছের নিচে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
নির্জন রাত। চলার পথে দস্যুর ভয়। দানবেরও ভয়। বোনাস হিসেবে আছে করোনার ভয়। তবুও এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যাওয়ায় জীবনের ধর্ম। জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া।


চতুর্থ দিনের জার্নি শুরু। জয়ীতার শরীরটা আজ ভালো যাচ্ছে না। রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি। ঘুমচোখেই সূর্য ওঠার আগেই আজ সাইকেলের পিঠে চড়ে বসে। জয়ীতার বাবা নির্জীব পাথরের মতো। মুখে কোনো কথা নেই। মেয়ের ভালোবাসায় যেমনি তিনি মুগ্ধ, তেমনি মেয়ের কষ্টেও বাকরুদ্ধ। কথা শুরু করলেন বাবা। ভাবলেন কথায় কথায় মেয়ের কষ্ট ভুলিয়ে রাখবেন।
বাবা বললেন, ‘তুই একসময় আমার কাছে সাইকেল চেয়েছিলি। তখন কিনে দিতে পারিনি। সেই তোকে সাইকেল ঠিকই কিনে দিতে হলো। কিন্তু সাইকেল যে এভাবে তোকে কষ্ট দেবে ভাবতে পারিনি।’
জয়ীতা বাবার কথার পিঠে কথা বলে, ‘বাবা একদিন তোমাকে সাইকেল কিনে দিতে বলেছিলাম, তুমি কিনে দিতে পারনি। সেদিন তোমার উপর খুব অভিমান হয়েছিল, রাগ হয়েছিল আমার। পাড়ার ছেলেদের সাইকেল চড়ে সাইকেল চালানো শিখেছি। আজ আমি একটানা চারদিন ধরে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। অনেক কষ্ট হচ্ছে। সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে। তবুও আনন্দ। অনেক আনন্দ! তোমার কিনে দেওয়া সাইকেলে তোমাকে নিয়েই বাড়ি ফিরছি। এর চেয়ে আনন্দ আর কোথায় পাব বলো বাবা?’
বাবা বললেন, ‘এই সাইকেলটা কোনোদিন বিক্রি করব না। এই সাইকেলটা আমাদের জীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে।’

৮.
চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠদিন পার করেছে ওরা। মানে ছয় দিনে ছয়শো কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়েছে। দুজনের শরীর ক্লান্ত। অবসন্ন। শক্তিহীন। তবুও সপ্তম দিনের যাত্রা শুরু করবে জয়ীতা। রাতটা ওরা একটা গাছের গোড়া বাঁধানো চত্বরে কাটিয়েছে। সকাল সকাল বাবার ঘুম ভাঙলেও জয়ীতার ঘুম ভাঙছে না। বাবা জয়ীতাকে ডেকে ওঠালেন। জয়ীতা ঘুমজড়ানো কণ্ঠেই বাবাকে বললেন, ‘বাবা শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। আজ আর একটু ঘুমাই।’
বাবা কোনো কথা বললেন না।
জয়ীতা আরও কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নিলো। একসময় নিজে থেকেই প্রকৃতির ডাকে উঠে পড়ল। পিছনের গাছপালার মধ্যেই ও প্রকৃতির কাজ সারতে গেল। জয়ীতার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার অবস্থা। ওর শরীরের নিচের অংশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পাজামাটা রক্তে ভিজে গেছে। সে দ্রুত বাবার কাছে এসে বলল, বাবা তোমার গামছাটা দাও। জয়ীতার রজঃস্রাব হচ্ছে। সে ব্যাগ থেকে শুকনো পাজামা নিয়ে গামছাটাকে ন্যাপকিনের মতো ব্যবহার করল। আর অপরিষ্কার পাজামাটা পলিথিনের ভিতর রেখে ব্যাগের এক কোণায় রেখে দিলো।
জয়ীতা আজ জানে না সে সাইকেল চালাতে পারবে কিনা। কিন্তু বাবাকে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না। বাবাও জয়ীতার অবস্থা অনুমান করতে পেরে কিছুই বলছে না।
জয়ীতা এ অবস্থায় আগে কখনও সাইকেল চালায়নি। কিন্তু আজ তাকে সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে। নির্জন পথপরিক্রমায় তাদের সাহায্য করার কেউ নেই। যত সময় এখানে থাকবে ততই পথ আরও দীর্ঘ হবে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তবুও ভাবছে আকাশপাতাল।
ওরা ইতোমধ্যেই লখনৌ শহর ছেড়ে এসেছে। এখন নির্জন রাস্তার পাশে গাছের নিচে ওদের অবস্থান। হঠাৎ একটা লরি এসে ওদের কাছে থেমে গেল। ড্রাইভার জয়ীতার বাবার উদ্দেশে বললেন, এই যে মশাই কোথায় যাবেন?
জয়ীতার বাবা বললেন, আমরা বিহার যাব।
সেকি বিহার তো অনেক পথ যাবেন কীভাবে? তারচেয়ে লরিতে উঠুন আমরা ফয়জাবাদে কিছু মাল নামাব তারপর গোরাখপুর যাব। ওখানে আপনাদের নামিয়ে দেবক্ষণ।
জয়ীতা একবার বাবার মুখের দিকে একবার ড্রাইভারের মুখের দিকে চেয়ে রইল। সে তার বাবার সাথে কানে কানে কিছু একটা বলছে...
ড্রাইভার বললেন, বেটি কোনো চিন্তা করিস না, তুই আমার ছোট বোনের মতো। আসুন মশাই, আমরা নিরাপদে আপনাদের গোরাখপুর নামিয়ে দেবক্ষণ।
জয়ীতা বাবাকে বলল, চলো বাবা আমরা ট্রাকে উঠে যাই।
বাবা মাথা নাড়িয়ে সাই দিলো।
ওরা সাইকেল সহ লরিতে উঠে পড়ল।

৯.

মতিহারি, মতিপুর, মুজাফফরপুর পার হয়ে বিহারের ধড়ভাঙা গ্রামে পৌঁছায় জয়ীতা তার বাবাকে নিয়ে।
পথে পথে কত কষ্ট হয়েছে তা শুধু পথের দু’পাশের গাছপালা, পশুপাখি, দিনরাতের প্রকৃতি, পায়ের নিচের শক্ত মাটি, আকাশের নিঃসঙ্গ চাঁদ, গনগনে সূর্য- এরাই নিরব সাক্ষী। জয়ীতা কখনো ভুলতে পারবে না তার জীবনের এই কষ্ট ও আনন্দের স্মৃতিকে। সে তার মাকে কথা দিয়েছিল সে বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরবেই। অদম্য মনোবল তাকে গন্তব্যে পৌঁছতে সহায়তা করেছে।
জয়ীতা আরও ভুলবে না, লখনৌৗ থেকে ফয়জাবাদ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সাহায্য করা ট্রাক ড্রাইভার করিম মণ্ডলকে।

টানা দশদিন সাইকেল চালিয়েছে জয়ীতা। পথে সামান্য বিশ্রাম, আধপেটা খাবার। অনিশ্চয়তায় রাত কাটানো। অবশেষে গ্রামের বাড়ি। চূড়ান্ত দারিদ্রের মুখ দেখা এক কিশোরী অনাকাক্সিক্ষত, অনিশ্চিত প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। সেই যুদ্ধে জয়ী হয় সে। এবার নতুন লড়াই। পেট চালানোর লড়াই। সেই লড়াইয়েও নিশ্চয়ই জয়ী হবে জয়ীতা।
ছোট্ট মেয়ের পেছনে এভাবে বয়স্ক লোককে বসে থাকতে দেখে বিদ্রুপ করেছে অনেকে। কিন্তু তারা তো আর জানে না বাবা-মেয়ের ভেতরের করুণ কাহিনি। পথে অনেকে খাবার ও পানি দিয়ে সাহায্য করেছে। অনুপ্রেরণা দিয়েছে অনেকে। আবার অনেকে কটুক্তিও করেছে।

দিল্লি সংলগ্ন গুরুগাঁও থেকে বিহারের দড়ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় বারোশো কিলোমিটার পাড়ি দেয় বাবা-মেয়ে। টানা দশ দিন সাইকেলে চেপে বাবাকে নিয়ে নিরাপদে বাড়ির চৌকাঠে পা রাখে জয়িতা। দীর্ঘসময় সাইকেল চালানোর ধকলে কাতর ও বাসিফুলের মতো ক্লান্ত হলেও মায়ের কথা রাখতে পেরে মুখের হাসিটুকু অটুট ছিল তার। মা তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরেছে। যেন এক বুক শান্তির সন্ধান।

বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে জয়িতা। লকডাউনে সাইকেলে চেপে বাড়িতে পৌঁছানোর এই খবর, জয়ীতার এই অসাধ্য সাধনের বাস্তব জীবনগল্প পৌঁছে গেছে ভারতীয় সাইক্লিং ফেডারেশনের কাছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে জয়ীতার জয়গাথা। গণমাধ্যম তাকে ‘লায়ন হার্টেড’ অর্থাৎ সিংহ হৃদয় বা অসীম সাহসী বলে উল্লেখ করেছে। সাইক্লিং ফেডারেশনের চেয়ারম্যান জয়ীতাকে নয়াদিল্লিতে জাতীয় সাইক্লিস্ট দলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাংবাদিক, ফটোগ্রাফারদের তোলা ছবি, সবার এত সম্ভাষণ আর ভালোবাসার মধ্যেও জয়ীতা নিচুকণ্ঠে নিষ্পাপ সৌন্দর্য প্রকাশ করেছে। সে বলেছে, ‘আমার মনে হয় আমি মেয়ে বলে সবাই এত অবাক হচ্ছে। কিন্তু আমি শুধু আমার বাবাকে নিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরতে চেয়েছি। আর কিছু চাইনি। আমার মাকে দেওয়া কথা রাখতে চেয়েছি। আপনারা সবাই আমাকে আশীর্বাদ করবেন, আমি যেন সারাজীবন আমার মায়ের কথা রাখতে পারি।’

পরিশিষ্ট : এই গল্পটি জয়ীতা ও তার বাবার জীবন ট্রাজেডি অবলম্বনে রচিত। ছোটগল্পের কাঠামো নির্মাণের জন্য সত্য ঘটনার সাথে কিছু কাল্পনিক কাহিনি টেনে ঘটনাটিকে গল্পে রূপান্তর করা হয়েছে মাত্র। জীবনট্রাজেডির সাথে কাল্পনিক ঘটনার কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাবেন না।

 

মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড (২০১৬) এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
প্রকাশক, সৃজনী, অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top