সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

মরমি কবি হাসন রাজা এবং দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ : আবদুল হালীম খাঁ


প্রকাশিত:
২৭ অক্টোবর ২০২২ ০১:২৬

আপডেট:
২৮ অক্টোবর ২০২২ ০১:৩২

 ছবিঃ দেওয়ান হাসন রাজা এবং দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

 

মরমি কবি হাসনরাজা সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের কথা ওঠে আসে এবং দেওয়ান আজরফ সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে হাসন রাজার কথাও ওঠে আসে। একজন আরেকজনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে রয়েছেন। হাসনরাজা ছিলেন জমিদার এবং মরমি কবি। মরমি কবি হিসাবে তিনি বিশ্ববিখ্যাত। এবং দেওয়ান আজরফের নানা হিসাবে ইতিহাসে আর একটু বেশি আলোচিত হচ্ছেন। দেওয়ান আজরফ ছিলেন দুহালিয়ার জমিদার মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা দেওয়ান মোহাম্মদ আসফের পুত্র এবং হাসন রাজার মেয়ের ঘরের নাতি, মূলতঃ একজন প্রখ্যাত দার্শনিক। তিনি জন্মগ্রহণ করেন নানা বাড়িতে এবং সেখানেই তার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। তিনি হাসনরাজা সম্পর্কে যত বিষয় জেনেছেন এবং লিখেছেন এমনটি আর কেউ জানেননি এবং লিখেননি। যেমন:
তিনি বলেছেন, নানা কোনো কোনো গান লিখেছেন। যেমন:
‘লোকে বলে বলেরে ঘরখানি ভালা না আমার
কি ঘর বান্দিমু আমি শূন্যের মাজার।
এই গানটি আমাকে কোলে নিয়ে লিখেছেন। দেওয়ান আজরফ সাহেব লিখেছেন, নাতি নাতনিদের মধ্যে তিনি আমাকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। তাঁর তো ছিল অনেক নাতি-নাতনি। সকলকে আবার সমানভাবে ¯েœহ করতেন না। আমার মায়ের গর্ভজাত সন্তানদের আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। তারপর তৈমুর রাজাকে ¯েœহ করতেন। এ রকম এক একজনকে উনি বিশেষ ¯েœহ করতেন। এটা দেখতে অবশ্য খারাপ লাগে।... তাঁর দূরদৃষ্টি বোধ হয় আমি যে ভবিষ্যতে সাহিত্যিক হবো এ জন্যই ছিল। কারণ বিখ্যাত সাহিত্যিক সিলেটের সৈয়দ মুজতবা আলী, তাকেও তিনি অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। মুজতবা আলীর বাবা ছিলেন সৈয়দ সিকান্দর আলী, সুনামগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। সেই সুনামগঞ্জের বাসা থেকে তাঁকে লোক পাঠিয়ে আনিয়ে তাঁকে মিঠাই-টিঠাই খাওয়াতেন। মুজতবা আলী আমার চেয়ে এক বছরের বড়। নানা আমাদের দু’জনকে এক সঙ্গে মিঠাই খাওয়াতেন। অথচ সিকান্দর আলীর তো আরো দুই ছেলে ছিল মুরতজা আলী, মোস্তফা আলী। এদের এ রকম মায়া করতেন না। তাতে বোঝা যায়, একটু সাহিত্যিক রুচি আছে এ রকম ছেলেদের তিনি ¯েœহ করতেন।’
হাসন রাজা এক অদ্ভুত চরিত্রের লোক ছিলেন। একদিকে প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার। চীফ কমিশনার বা লেফটেন্যান্ট গভর্নর, এরা যখন আসতেন তখন তিনি চাপকান পায়জামা রাজাদের ড্রেস যা ছিল সেইগুলো পরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, প্রথম সারিতে বসেছেন, তাদের সাথে মোলাকাত করেছেন। রাজা মহারাজার মত দরবারের মধ্যে তার মাথার উপর ছাতি ধরে একজন লোক বসে থাকতো। আবার দেখা যায়, সেখান থেকে এসে খড়ম পায়ে দিয়েছেন, ধুতি পরেছেন, খালে গায়ে থেকেছেন। কখনো গায়েনদের নায়ে গিয়ে বসে রয়েছেন এবং গায়েনরা তাঁকে গান শোনাতেন, তিনি গায়েনদের মধ্যে নিজেও গাচ্ছেন। গায়েনরা সেগুলো শিখছে, বুড়াবুড়িরা পর্যন্ত গাচ্ছে।
হাসনরাজা কখনো অনেক গভীর রাতে গান রচনা করতেন এবং একা একাই গাইতেন, আবার কখনো গায়েনদের সঙ্গে গাইতেন এবং তাদের শিখাতেন। দুই একদিন দেওয়ান আজরফকে সঙ্গে নিতেন। তিনি গান গাওয়ার সময় ঢোলক বাজাতেন, একজনে মন্দিরা বাজাতো। কয়েকজন গায়িকা সঙ্গে থাকতো। তাদের কারো নাম ছিল দিলারা, সোনাজান, আলিফজান। মাঝে মাঝে আবিদ আলী নামে একজন ঢোলক বাজাতো। এ সময় গান গেয়ে তিনি তন্ময় হয়ে সাধনা করতেন বলে শোনা যায়।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, আমাদের এ অঞ্চলে আমার নানা মরমি কবি হাসনরাজা ছিলেন এক সুবিখ্যাত কুড়া শিকারী। তাঁর বাড়িতে পঞ্চাশ থেকে একশো কুড়া থাকতো। প্রত্যেকটি কুড়ার পরিচর্যার জন্য একজন চাকরানী নিযুক্ত ছিল। হাসনরাজার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেকেরই পাখি শিকারের অভ্যাস ছিল।
ওমর খৈয়ামের মতই অনিত্য এ জীবনের গূঢ় রহস্য আপন চৈতন্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন হাসনরাজা। তাই রাজা তথা বিপুল বৈভবের অধিকারী হয়েও তিনি অভ্যস্তÍ হয়েছিলেন অনাড়ম্বর জীবন যাপনে। দালানকোঠা না বানিয়ে ছনের ছাউনির সেটে ঘরে বাস করতেন তিনি। পরিধান করতেন আটপৌরে পোশাক। কেবল উচ্চ পর্যায়ের কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে যোগদান করতে হলে পরতেন সেকালের প্রথা মাফিক আচকান, পাগড়ি, নাগরা কোট ইত্যাদি। প্রাত্যহিক জীবনে কোনো রকম জৌলুস ধাতে সইতো না তার। সুফির মত সাদামাটা পোশাকই ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কুঁড়ে ঘরে বসে তিনি নিমগ্ন থাকতেন বিশ্বভাবনায়। এ কারণেই বিশ্বখ্যাত একজন মরমি দার্শনিকের শীর্ষ আসনে উঠতে পেরেছিলেন তিনি। এ কালেও লোক কবি হিসাবে তাঁর জনপ্রিয়তা অসামান্য।
হাসনরাজার মৃত্যুর পর তার চিন্তাধারা স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে কিছুসংখ্যক লোক নানাবিধ মন্তব্য করেছেন। অথচ তারা কেউ হাসনরাজাকে দেখেনি। তারা বলেছে, হাসনরাজা যৌবনে অত্যাচারী ও দস্যু প্রকৃতির দুরাচারী ছিলেন। জীবনে তিনি নানাভাবে অপদস্থ হয়ে পরে বিবাগীতে পরিণত হন। আসলে এসব কথা সত্য নয়। অপপ্রচার মাত্র। দেওয়ান আজরফ বলেন, আমি হাসনরাজার কথাবার্তা ও তার সাথীদের কাছ থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করেছি, তাতে জানতে পেরেছি, যৌবনে তিনি খুব প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন বটে, অত্যাচারী ছিলেন না। তিনি গোড়া থেকেই বিবাগী ছিলেন এবং জীবনের নানা পর্যায়ে নানা কাজে সৌখিন ব্যাপারে লিপ্ত হলেও তিনি পূর্বাপর ছিলেন আল্লাহর অনুরাগী। তার মধ্যে বহু বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটেছিল;
জমিদার, ঘোড়সওয়ার, কুড়া শিকারী, নারী বিলাসী, গান বাজনায় উৎসাহী, চিকিৎসক, ইলমে কেফায়ায় দক্ষ। একটি মাত্র লোকের জীবনে অনেক গুণের সমাবেশ দেখা দিয়েছিল। তবে তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আল্লাহর সঙ্গে মিলন এবং তার উক্তি: ‘আমি যাইমু গো যাইমু আল্লাজীর সঙ্গে।’ এটা কবিজনোচিত খেয়ালি উক্তি নয়। এই নীতিই তাকে জীবনের সবক্ষেত্রে পরিচালিত করেছে।
হাসনরাজার জীবন সম্পর্কে যতসব অমূলক কিংদন্তি প্রচলিত রয়েছে তা নিরসন করার জন্য দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ‘মরমি কবি হাসনরাজা’ নামে একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে সব কথার সুন্দর জবাব রয়েছে। তিনি লিখেছেন, হাসন রাজা মৃত্যুর সময়ে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ উচ্চারণ করে দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছেঠন। তিনি নিঃসন্দেহে একজন মুমিন মুসলমান ছিলেন। তার মৃত্যুর সন ১৯২২।
॥ দুই ॥
আমাদের চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতির ভুবনে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এক বিশাল মহীরুহের মত ডালপালা পত্রপল্লব ছড়িয়ে আছেন। তিনি আমাদের জাতিগোষ্ঠী সংস্কৃতির মৌল সূত্রগুলোর বিকাশে এবং রূপায়নে নিজকে সদাসর্বদা নিয়োজিত রেখেছিলেন। যেসব মূল্যবোধ সংস্কৃতি চেতনার শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়ে একটি জাতিকে প্রাণৈশ্বর্যে সক্রিয় ও বেগবান করে তোলে, সেগুলোই ছিল তার চিন্তা-ভাবনার উপজীব্য। এক পর্যায়ে তিনি তার স্বজাতির আজাদীর সংগ্রামে দৈহিকভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং কিছুকাল বৃটিশের কারাগারে বন্দী জীবন কাটান। তাঁর এই ভূমিকা গ্রহণ প্রমাণ করে যে, ইসলামের প্রকৃত অনুসরণ মানুষকে তার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করেনা, বরং এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য তাকে প্রবল প্রেরণা দিয়ে থাকে। দেওয়ান আজরফের মুখ্য পরিচিতি একজন দার্শনিক হিসাবে হলেও তাঁর আরো পরিচিতি রয়েছে। তিনি বিভিন্ন কলেজের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের খন্ডকালীন অধ্যাপকও ছিলেন। তবে তথাকথিত অধ্যাপকদের মতো দার্শনিকের বুলি কপচানো পন্ডিত মন্যতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেন নি। ঐসব দর্শন চিন্তার ভুল ভ্রান্তি ও অসম্পূর্ণতার বিশ্লেষণ করে, তিনি সামগ্রিক জীবন দর্শনের মুখোমুখি হন, তা হচ্ছে ইসলামের বিশ্বজনীন জীবন দৃষ্টি, যা কোন একপেশে মতবাদ দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেনা।
এই সার্বিক জীবন দৃষ্টি, যার অন্তর্গত হচ্ছে মানুষের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সকল কর্মকান্ড তারই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করেন। এ সাধনায় তিনি যে ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েছেন তাতে রয়েছে দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য, সকল ধর্মবলম্বীদের জন্য সম্প্রীতি ও উদারতা। একজন সত্যিকার মুমিন, তার চিন্তা-কর্মে আচরণে সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠে দুনিয়ার সকল মানুষকে তার আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে পারেন বলে তিনি সকলের প্রিয়, সবার শ্রদ্ধেয়।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯০৬ সালের ২৫ অক্টোবর, ১৩১৩ বাংলা ৯ কার্তিক রোজ শুক্রবার সুনামগঞ্জ শহরে মাতামহ বিশ্ববিখ্যাত মরমি কবি ও জমিদার হাসন রাজার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। সূতরাং দেখা যায় যে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সোনার চামচ মুখে দিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। বিস্ময়কর ছিলো তাঁর স্মরণ শক্তি। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বাংলা, উর্দু, ফার্সী. সংস্কৃত ও ইংরেজী সাহিত্য হতে উদ্ধৃতি দিয়ে যেতে পারতেন। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন প্রকার দর্শন ছাড়াও বিশ্ব সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, সামাজবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব ও বিভিন্ন চিন্তাবিদদের অনেক মূলবান গ্রন্থ গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। পড়াশোনা ও লেখালেখির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জনহিতকর কর্ম সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা ও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। দীর্ঘ জীবনে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ অসংখ্য সেমিনার ও আলোচনা সভায় বক্তৃতা করেছেন। তিনি প্রচুর লিখেছেন। তিনি ৭৫টি গ্রন্থ এবং কয়েক হাজার প্রবন্ধ লিখেছেন। দর্শনের বিভিন্ন বিষয় ছাড়াও তিনি ছোট গল্প, নাটক, উপন্যাস, কবিতা, রম্য রচনা, ভ্রমণ কাহিনী, ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়াবলী নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ, জীবনী গ্রন্থ প্রভৃতি রচনা করেছেন। বলা বাহুল্য সব রচনার মধ্যেই তাঁর জীবন বোধ ও বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯২৭ সালে তাঁর মামা মরমি কবি হাসান রাজার পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার কন্য সাজেদুন নেছা চৌধুরীকে বিয়ে করেন। তাদের দাম্পত্য জীবন সবদিক দিয়ে ছিলো সুন্দর ও মধুময়। ১৯৯১ সালে সাজেদুন নেছা চৌধুরী এর স্বামী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, দুই কন্যা এবং ছয় পুত্র রেখে মৃত্যুবরণ করেন। সাজেদুন নেছা নামানুসারে একটি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তিত হয়েছে। তাঁদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আবু সাঈদ জুবেরী এবং কন্যা সাদিয়া চৌধুরী পরাগ সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। আরেক ছেলে বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল দেওয়ান সায়েরুজ জামান চৌধুরী।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ দেশের সাহিত্য সংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি তমদ্দুন মজলিশ ও ইকবাল সংসদের সভাপতি, বাংলাদেশ দর্শন সমিতির উপদেষ্টা ছিলেন। কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিশের উপদেষ্টা, পূর্ণিমা বাসরের উপদেষ্টা, মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রধান উপদেষ্টা এবং নজরুল একাডেমির কার্যকরী পরিষদের সম্মানিত সদস্য ছিলেন।
অনন্য সাধারণ মহান ব্যক্তিত্ব দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার(১৯৮১) ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার(১৯৮৩), নাসির উদ্দীন স্বর্ণ পুরস্কার(১৯৮৪), কোরানিক সোসাইটি পুরস্কার (১৯৮৭), জালালাবাদ যুব ফোরাম পুরস্কার (১৯৯০), খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৯০) জ্ঞান তাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক(১৩৯৫ বাংলা) মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ স্বর্ণপদক (১৯৮৯), ভোলা জাতীয় মঙ্গল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২), বিশ্বনাথ ছাত্রকল্যাণ সমিতি সংবর্ধনা(১৯৯২), মৌলভীবাজার মিউনিসিপ্যালিটি পুরস্কার(১৯৯২), স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু পুরস্কার (১৯৯২), জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা(১৯৯৩ অক্টোবর) এবং জিয়াউর রহমান স্বর্ণপদক (১৯৯৪) লাভ করেছেন। একুশে পুরস্কার(১৯৯২)।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের কর্মজীবন গৌরবময়, উল্লেখ করার মতো অনেক কীর্তি কাহিনীতে ভরে রয়েছে। ছোট খাটো প্রবন্ধে ব্যক্ত করা তা মোটেই সম্ভব নয়। তিনি একসময় সরকারি কলেজের অধ্যাপ না ছেড়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি ফিরে এসেছেন পারিবারিক জমিদারী তদারকি করার জন্য। আবার পঞ্চাশ দশকে প্রথম ভাগে জমিদারী প্রথা লোপ পায়। ফলে আজরফের জীবিকার জন্য চাকরী প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাই পঞ্চাশ দশকে শুরুতেই সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। পরে তিনি নরসিংদী কলেজে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে কলেজ পরিচালনা করেন। তারপর ষাট দশকের প্রথম ভাগে আজরফ ঢাকায় আবুজর গিফারী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বিদেশে অনেক সেমিনারে বিভিন্ন সময়ে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর সততা, ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে অনেক তাক লাগানো ঘটনা রয়েছে। তার মধ্যে থেকে এখান ছোট অথচ খুব ভারী মজার একটি ঘটনা উল্লেখ করে আলোচনা শেষ করছি। ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে God: The contemporary discussion শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর সাতী ছিলেন একটু দূর সম্পর্কে নাতী ড. কাজী নরুল ইসলাম। নানা- নাতীর আন্তরিকতা ও খাতির ছিলো গভীর। এখানে ড.কাজী নুরুল ইসলাম সাহেবের ভাষায়ই উল্লেখ করছি:
সেমিনারে দিনগুলো পার হয়ে গেলো। শেষ দিনে sight seing । স্যার সঙ্গত কারণেই যাবেন না। আর আমিতো যাবার জন্য পাগল। পরের দিন sight seing এবং তারে পরের দিন বিদায়। রব স্যারের সঙ্গে একটু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছি। স্যার রুমে একা ছিলেন। ফিরে আসতেই স্যার ( নানা) বললেন, কাজী সাহেব, আগামীকাল আমাকে একা ফেলে আপনি যাবেন না। আমি বিস্মিত হয়ে স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? স্যার যা বললেন নি¤œরূপ: একটি মেয়ে তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছে, Do you want drink? জবাবে স্যার বলেছেন: I am a muslim, i can not drink alcohol.. মেয়েটি বলেছে: No sir, i don’t offer alcohol, do you need women? স্যারের তো হার্টফেল করার মতো অবস্থা। তবু স্যার শক্ত হয়ে বলেছেন:I am an old man, do not distrub me. মেয়েটি আরো মধুর কন্ঠে বললো: our duty in to make old people young. নানা নাতির সম্পর্কের কারণে বললাম, স্যার, এতে ভয়ের কি আছে? আপনি না চাইলে তো আর আসবেনা। স্যার মানতে চাইলেন না। তার ভয় যদি কোন মেয়ে রুমে ঢুকে পড়ে। তাহলে কী কেলেঙ্কারী না হবে। এই বলেই আমার দু হাত ধরে বললেন, দোহাই আপনার, আমাকে একা ফেলে আপনি যাবেননা। আমি বললাম, না আপনাকে ফেলে আমি যাবনা।’ এমনি শিশুর মতো সরল এবং সৎ ছিলেন মহান দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top