সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ : বাঙালি মুসলিম দার্শনিককে কতটা চেনেন? : রাগিব রব্বানি


প্রকাশিত:
২৭ অক্টোবর ২০২২ ০১:২৯

আপডেট:
৭ মে ২০২৪ ২৩:৫৮

ছবিঃ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

 

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বাংলাভাষার খ্যাতিমান একজন সাহিত্যিক, সমালোচক, অধ্যাপক এবং পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব হলেও তাঁর মূল পরিচয় তিনি একজন মুসলিম দার্শনিক। তাঁর চিন্তাধারা, অধ্যাবসায়, গবেষণা এবং নানামাত্রিক কাজের জন্য জীবদ্দশায়ই নানা পদক, সম্মান ও খ্যাতিতে ভূষিত হয়েছেন। আজ ২৫ অক্টেবর, তাঁর ১১৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের এ দিনে সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

 

পড়াশোনা ও কর্মজীবন
অভিজাত বাঙালি মুসলিম পরিবারের সন্তান দেওয়ান আজরফ ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটের এমসি (মুরারিচাঁদ কলেজ) থেকে বিএ পাশ করেন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে অর্জন করেন এমএ ডিগ্রি। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে যোগদান করেন চাকরি জীবনে। এখানে দীর্ঘদিন তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখান থেকে অবসরগ্রহণের পর ঢাকার আবু জর গিফারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৩ থেকে ৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও ইসলাম শিক্ষা বিভাগে খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’র একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। আসামে মুসলিম অভিবাসীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। সেই সময়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে ১০ মাসের জন্য কারন্তরীণও হন।
৫২-এর ভাষা আন্দোলনের তিনি জোরদার সমর্থক ছিলেন। নও বেলাল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। নও বেলালে ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে জোরালো সম্পাদকীয় লেখার কারণে পাক প্রশাসন ক্ষিপ্ত ছিল তাঁর ওপর। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে এ কারণে তাঁকে সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। যদিও পরে স্থানীয়দের প্রতিবাদের মুখে স্বপদে তাঁকে পুনরায় বহাল করতে বাধ্য হয় প্রশাসন।
বাঙালি মুসলিমদের অধিকার প্রশ্নে সতত সচেতন ছিলেন আজরফ। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ইন্তেকালের আগ অবধি টানা অর্ধ শতাব্দীকাল তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। বাংলাদেশে দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৮৪ থেকে ৮৯ খ্রিষ্টাব্দ অবধি বাংলাদেশ দর্শন সমিতির সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একজন বিশিষ্ট দার্শনিক ও ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরাক, রোম প্রভৃতি দেশ সফর করেছেন এবং দেশ বিদেশের বিভিন্ন সেমিনারে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করে সুখ্যাতির পাল্লা ভারি করেছেন।
সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে শতাধিক গ্রন্থ লিখেছেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের মধ্যে ধর্ম ও দর্শন, ইসলামিক মুভমেন্ট, তমদ্দুনের বিকাশ, মরমী কবি হাসন রাজা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ অবদানের জন্য মোহাম্মদ আজরফ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, আন্তর্জাতিক মুসলিম সংহতি পুরস্কার, একুশে পদক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার, বাংলাদেশ মুসলিম মিশন পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালের ৪ নভেম্বর তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে।
১৯৯৯ সালের ১ নভেম্বর মহান এ মুসলিম দার্শনিক ইন্তেকাল করেন।
দেওয়ান আজরফের চিন্তা : মুসা আল হাফিজের বিশ্লেষণ
বাঙালি এ মহান মুসলিম দার্শনিকের চিন্তাধারা নিয়ে দীর্ঘ ও গভীর পড়াশোনা করেছেন আলেম বুদ্ধিজীবী, দর্শণ-বিশ্লেষক ও কবি মুসা আল হাফিজ। আজরফের ১১৩তম জন্মবার্ষিকীতে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর থেকে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে তাঁর সঙ্গে। আলাপচারিতায় আজরফের চিন্তা, দর্শন ও গবেষণার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন তিনি।
মুসা আল হাফিজ বলেন, ‘আজরফের চিন্তার প্রধান বিষয় ছিলো মানুষ ও মানুষের জীবন। মানুষকে তিনি দেখতেন অমিত শক্তি ও সম্ভাবনার আধার হিসেবে। মানুষের সত্তায় নিহিত শক্তি ও সৌন্দর্যের অভ্যুত্থান তিনি চাইতেন। তার দর্শনের মানুষ হচ্ছে সমুন্নত মানুষ। এ ক্ষেত্রে তিনি কান্টের অতিমানব বা সুপারম্যান থিউরির অনুগামী ছিলেন না। কান্টকে তিনি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। তার মনে হয়েছে কান্টের ‘আদর্শ মানুষ’ আর তার ‘আদর্শ মানুষে’ ব্যবধান দুস্তর। যদিও কান্টের অনেক কিছুই তার কাছে উপাদেয় মনে হয়েছে। ইকবালের খুদিসত্তার সাথে তার আত্মীয়তা ছিলো। অনেকটা ইকবালের নিকটবর্তী এলাকায় তিনি ডেরা গেড়েছিলেন। ইকবালের সুরের সাথে তার সুর অনেক জায়গায় মিলেছে। আদর্শ মানুষ মানুষপ্রশ্নে ইকবালের খুদিবাদের সাথে ইবনুল আরাবির ইনসানে কামিল দর্শনের সমন্বয় তিনি ঘটিয়েছিলেন। যুক্ত করেছিলেন নিজের কিছু ভাবধারা। ফলত তার দর্শনের মানুষ একটি বিশেষ অবয়ব পেয়েছে, আয়তন লাভ করেছে। সেখানে হৃদয়বাদ আবেগ আর গতির বেগের সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন যে আমরা বলি, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের গতির বেগ দিয়েছে কিন্ত কেড়ে নিয়েছে হৃদয়ের আবেগ, মানুষকে করে তুলেছে বুদ্ধিমান রোবট, এ বাস্তবতায় আজরফ যে মানুষের উন্নত জীবনের রূপের কথা বলেন, সেটা খুবই প্রাসঙ্গিক। জরুরি।’
মুসা আল হাফিজ বলেন, ‘মানুষের জীবনকে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শবাদিতায় বিভূষিত দেখতে চান। এমন জীবন, যা প্রগতিধর্মী, এমন জীবন, যা জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কল্যাণ নিয়ে বহমান, এমন জীবন, যা আত্মিক ও দৈহিকভাবে সমান বিকাশে বিভূষিত, এমন জীবন, যা বিশ্বাস ও যুক্তিশীলতায় উজ্জীবিত। তিনি মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। মানুষের চিত্ত ও চেতনায় বিরাজমান যে দাসত্ব, তা থেকে তিনি মুক্তি চাইতেন, পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাসত্ব থেকে মুক্তিতে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। মুক্তি ও কল্যাণে তার যে ফর্মুলা, সেটা শেষ অবধি ইসলামে মিলিত হয়।’
দেওয়ান আজরফের দর্শন ও চিন্তায় ইসলাম প্রসঙ্গ বিষয়ে মুসা আল হাফিজের মতামত–‘আজরফ শেষ অবধি ইসলামের প্রস্তাবক ছিলেন। সে প্রস্তাব ছিলো নিরেট দার্শনিকের প্রস্তাব। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম ও দার্শনিক মতবাদকে বিচার ও অবলোকন করেই তিনি ইসলামকে কল্যাণময় জীবন ও জগতের জামিন্দার হিসেবে উপস্থাপন করেন। তার ইসলামের প্রস্তাবনায় আযাদ সোবহানীর রব্বানী দর্শন যেভাবে ক্রিয়াশীল ছিলো, তেমনি আলী শরিয়তী, মাওলানা মওদুদী, আল্লামা আবুল হাশেম তাকে প্রণোদিত করেছেন।’
মুসা আল হাফিজ বলেন, ‘দার্শনিক হিসেবে তিনি ছিলেন হেগেলিয় বিশ্লেষণপদ্ধতির অনুরাগী। জ্ঞানতত্তে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিজস্ব সজ্ঞাবাদ, অধিবিদ্যায় তিনি জীবনজিজ্ঞাসার সদুত্তর খোঁজেন ওহিভিত্তিক জীবনবাদিতায়, মূল্যতত্তে তিনি রাখেন নিবিড় ও উন্মোচক ব্যাখ্যানিদর্শন। বাংলাদেশের নিজস্ব দর্শনের তিনি বিকাশ চেয়েছিলেন। ইউরোপীয় দর্শনের প্রাজ্ঞ বিশ্লেষক হয়েও তিনি এর প্রতি বিশেষ কোনো মোহ দেখাননি। কিন্তু তার দর্শন শেষ অবধি ইসলামকেই প্রস্তাব করে বলে অনেকেই এ প্রস্তাবনাকে দার্শনিকতা হিসেবে দেখতে রাজি নন। তারা একে বলেন বিশ্বাস। আজরফকে অভিধা দেন ‘ইসলামি চিন্তাবিদ’। তিনি নিজেও এক পর্যায়ে নিজের ইসলামি চিন্তাবিদ পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। কিন্তু ইসলামি চিন্তাবিদ বলে তিনি দার্শনিক নন, তা তো হতে পারে না।’
মুসা আল হাফিজ আরও বলেন, ‘এ কথা বার বার বলা হয়েছে যে, ধর্ম চায় প্রশ্নহীন বিশ্বাস আর দর্শন চায় প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণ, অতএব ধর্মীয় চিন্তা আর দর্শন এক সাথে চলতে পারে না। এটা এক মূঢ় বক্তব্য। এ যদি সত্য হতো, ইসলামি দর্শন ও মুসলিম দর্শন অস্তিত্বে আসত না। হিন্দু দর্শন ও ভারতীয় দর্শন বিকাশ পেতো না। এ বক্তব্য বিশেষত ইসলামকে ভুল উপলব্ধির ফসল। ইসলাম চিন্তাহীনতা নয়, চিন্তাশীলতাকে প্রমোট করে সর্বদা, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেয় বিপুল। ফলে ইসলামের বীজতলা থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বহু দার্শনিকের জন্ম হতে পেরেছে। দেওয়ান আজরফ এই ধারায় পা থেকে মাথা অবধি একজন দার্শনিক ছিলেন।’
এই সময়ে দেওয়ান আজরফ কতটা প্রাসঙ্গিক?
একজন মুসলিম দার্শনিক হিসেবে দেওয়ান আজরফ এই সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক? এমন প্রশ্নের জবাবে মুসা আল হাফিজ বলেন, ‘আজরফের দর্শন বর্তমান বাস্তবতায় খুবই প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য। বিশেষত যখন অমানবিক পুঁজিবাদ, আত্মাহীন বস্তবাদ, একচক্ষু সমাজবাদ এবং পশ্চিমা নব্য সাম্রাজ্যবাদ মানবতাকে মুক্তি দিতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দেওয়ান আজরফ এখন কেবল বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক নন, তিনি বিশ্বপ্রেক্ষাপটেও প্রাসঙ্গিক। তার সময়ের যাদেরকে এ দেশে দার্শনিক হিসেবে সামনে আনা হয়, আরজ আলী মাতুব্বর, আহমেদ শরীফ, সাইদুর রহমান প্রমুখ; তাদের তুলনায় দার্শনিক হিসেবে যথেষ্ট অগ্রসর ছিলেন আজরফ। আমাদের জাতীয় প্রয়োজনেই আজরফচর্চা অপরিহার্য।’

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top