সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

দবির সাহেবের সভ্য ভাষা: সোলায়মান আশরাফী


প্রকাশিত:
২৭ মার্চ ২০১৯ ১৪:৩৫

আপডেট:
১৫ এপ্রিল ২০২০ ০০:০২

 

বেশ কিছু দিন ধরে দবির সাহেবের মাথায় একটা আইডিয়া ঘোরা ফেরা করছে । তিনি একটা ভাষা চালু করবেন । সবাই তাঁর নতুন ভাষাতে কথা বলবে । নতুন ভাষার জন্য তিনি অক্ষরও ঠিক করে ফেলেছেন । সব মিলিয়ে ২২০ টা অক্ষর । মনে রাখার জন্য সংখ্যাটা কি বেশী? চাইনীজদের তো ২০০০ এর উপর অক্ষর রয়েছে । তাদের তো মনে রাখতে কোন অসুবিধা হয় না, তবে আমাদের কেন হবে । তাঁর নামের সাথে মিল রেখে তিনি নতুন ভাষার নাম ভাবির রেখেছেন । ভাষার ভা আর দবিরের বির নিয়ে ভাবির ভাষার সৃষ্টি । এই যেমন তুমি কেমন আছ? এই কথাটা তাঁর ভাবির ভাষাতে বলতে হবে ঘুত মুত । মাত্র দুইটা শব্দে ভাব প্রকাশ করা যাচ্ছে । কেউ যদি উত্তরে বলে ভাল আছি, তবে বলবে ওয়াঙ্গা আর যদি বলতে চায় ভাল নেই তাহলে বলবে রুঙ্গা । তিনি বেশ জোরে জোরে শব্দ গুলি বলার চেষ্টা করলেন । এই সময় তাঁর স্ত্রী জাহানারা এসে বললেন, এই কি শিম্পাজীর মত শব্দ করছো? স্ত্রীর কথা শুনে তাঁর হতভম্ব হয়ে গেলেন । এই মূর্খ মেয়ে লোকটার সাথে তাঁর জীবনের ৪০ টা বছর কাটাতে হয়েছে – ভাবতেই তাঁর গায়ে কাটা দিয়ে উঠল । তাঁর চরম বিরক্তি নিয়ে বলতে চাইলেন উজযহা মানে তুই এখন যা, কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন । তাঁর নতুন ভাষাতে কোন কটূ শব্দ রাখা যাবে না । সভ্য যুগে তাঁর ভাষা হবে পৃথিবীর সব চেয়ে সভ্য ভাষা।

তাঁর মাথায় যখন কোন আইডিয়া আসে তখন তাঁর শরীর ঘামতে থাকে, ঘন ঘন পিপাসা পায়, বুকের ভিতর একটা ধর ফর শব্দ হতে থাকে । এখন তেমনটাই হচ্ছে । এই সময় তাঁর স্ত্রী জাহানারা চিৎকার করে বলে উঠলেন, ও আল্লাহ গো তুমি এমন ঘামছ কেন? তোমার কি হয়েছে? ও কণা ও মবিন তোর বাবাকে বাঁচা --- এই টুকূ বলে তিনি কান্না শুরু করে দিলেন। মবিন বাসায় ছিল না, তাদের মেয়ে কণা ছুটে এল । জাহানারা তাকে হর বর করে সব বললেন । কণা সাথে সাথে দবির সাহেবের শ্যালক ডাক্তার মহিন কে ফোন করল । দবির সাহেব শুনতে পেলেন তাঁর মেয়ে বলছে, বাবা প্রথমে ঘত ঘত করে শিম্পাজীর মত শব্দ করে মাকে কিছু বলল, তারপর হার্ট এট্যাক । কণার বয়স ২১, উনিতে থার্ড ইয়ারে পড়ে । সব কিছু বাড়িয়ে বলা তার অভ্যাস । ও পাশ থেকে ডাক্তার মহিন কিছু বলল । তিনি বুঝলনে কিছুক্ষণের মধ্যে মহিন এম্বুল্যান্স নিয়ে চলে আসবে । মহিন ছেলেটা ভাল, তবে তার চেম্বারে কোন রুগী আসে না । তবু সে নিয়ম করে ৪ টার সময় চেম্বারে যাবে, দুইটা হিন্দী সিনেমা দেখবে এরপর রাত নয়টায় বাসায় চলে আসবে। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন । দবির সাহেব বিরক্ত হলেও কিছু বললেন না । মহিনকে উনি পছন্দ করেন । ছেলেটার বুদ্ধি বিবেচনা ভাল । জাহানারা ওয়াজিফা নিয়ে জোরে জোরে পড়ছেন, কণা ঠাণ্ডার মধ্যেও এসি ছেড়ে দিল ।

কিছুক্ষণের মধ্যে মহিন চলে এল । সে হন্ত দন্ত হয়ে রুমে ঢুকে বলল দুলাভাই কেমন আছেন? জাহানারা ওয়াজিফা পড়া বন্ধ করে হাউ মাউ করে উঠলেন । দবির সাহেব কড়া গলাতে জাহানারা আর তাঁর মেয়েকে রুমের বাইরে যেতে বললেন । এরপর মহিনকে বললেন দরজা বন্ধ করে দিতে । মহিন দরজা বন্ধ করে দবির সাহেবের পাশে বসে তাঁর হার্ট চেক আপ করতে থাকল । দবির সাহেব কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মহিনকে উনার আইডিয়ার কথা বললেন ।

ঘরে পিন পতন নিরবতা । দবির সাহেব গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছেন মহিন কি বলে । মহিন হত বিহবল হয়ে আছে । কিছুক্ষন পর সে বলল, দুলা ভাই এই ভাষা আপনি বানিয়েছেন ? দবির সাহেব মাথা নেড়ে হা বললেন । মহিনের এখনও কিছু বোধগম্য হচ্ছে না । সে প্রশ্ন করল, কেন ?

দবির সাহেব বললেন পৃথিবীর সব ভাষাতে অশ্লীল শব্দ আর কর্কশ গালি রয়েছে । আমার ভাষাতে কোন অশ্লীল শব্দ বা কর্কশ গালি থাকবে না । এটা হবে সভ্য যুগের সভ্য ভাষা । কথা কম ভাব বেশী । এই দেখ সেদিন টেলিভিশনে দেখলাম এক লোক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেই যাচ্ছে, তবু সে ভাব প্রকাশ করে শেষ করতে পারছে না, আর চেয়ারে বসে মাননীয় মন্ত্রী মহাদোয় ঘুমাচ্ছেন । কিন্তু ভাবির ভাষাতে কিন্তু কথা গুলি ২ মিনিটেই বলা হয়ে যেত আর মন্ত্রী মহাদোয় ও বাসায় গিয়ে ঘুমাতে পারতেন, আবার কথা কম বলার কারনে শব্দ দূষণ ও কম হত । মহিন মুগ্ধ হয়ে মাথা নাড়ল, কথা ঠিক । দবির সাহেব উৎসাহ নিয়ে বলে চললেন, আমাদের মধ্যে যত গন্ডগোল হচ্ছে তার বেশীর ভাগই হচ্ছে অপরকে কটূ কথা বলার জন্য। ভাবির ভাষাতে সবচেয়ে কটূ শব্দ হচ্ছে- দুষ্ট । মহিন খুশি হয়ে বলল, কেউ কাউকে কটূ কথা বলবে না, তাহলে কারো মনে কোন কষ্ট থাকবে না, ভাবতেই তো আমার লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে ।

এই ঘটনার পর দবির সাহেব এবং মহিন ভাষার কাজে লেগে পড়লেন । জাহানারা আর কণা অবাক হয়ে দেখল, দুইজন বয়স্ক লোক শিম্পাজীর মত শব্দ করে ভাব বিনিময় করছে আর সারাক্ষন বিশাল মোটা খাতার মধ্যে কি সব লিখছে । কিছু দিনের মধ্যে মহিন তাদেরকে জানিয়ে দিল যে, তাঁরা একটা নতুন ভাষা নিয়ে কাজ করছে । আগামী ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীকে দিয়ে এই ভাষার উদ্ধোদন করানো হবে, এর পর সারা বাংলাদেশের মানুষ এই সভ্য ভাষাতে কথা বলবে । মহিনের ধারনা, আগামীতে প্রফেসর ইউনুসের পর দবির সাহেব নোবেল পুরুষ্কার পাবেন ।

এভাবে ১০ দিনের মত কেটে গেল । দবির সাহেব এক রকম নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে ভাষার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকলেন । তিনি টেবিলে বসে একটা বিশাল মোটা খাতাতে কিছু লিখছেন । জাহানারা তাঁর জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসে নরম গলাতে বললেন, কি করছ? দবির সাহেব বললেন, নতুন ভাষাটার জন্য ব্যাকরণের বই লিখছি। স্বামীর জন্য জাহানারার মায়া হল । তিনি বললেন, এখন একটু রেস্ট নাও। শরীরের দিকে তো খেয়াল করতে হবে, তোমার কিছু হলে তো এই দেশের মানুষের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। দবির সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, কথাটা ঠিক বলেছ, তারপর কি ভেবে বললেন, অনেক দিন পত্রিকা পড়া হয় না, আজকের পত্রিকাটা নিয়ে আসোতো । জাহানারা পত্রিকাটা দবির সাহেবের হাতে দিয়ে চলে গেলেন।

দবির সাহেব পত্রিকাতে চোখ বুলাচ্ছেন, তেমন কোন খবর নেই । হঠাৎ তাঁর চোখ আটকে গেল একটা খবরে – অমানুষিক নির্যাতনের কারনে সিলেটে একটা শিশুর মৃত্যু। দবির সাহেব এক নিঃশ্বাসে খবরটা পড়তে লাগলেন । তাঁর হাত পা কাঁপতে লাগল । তাঁর মুখ দিয়ে কোন রকমে বের হয়ে এল হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চারা, কুত্তার চেয়েও অধম তোরা, এই জাতির অভিশাপ তোরা! দবির সাহেব তাঁর ভাষার বই ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেললেন ।

 

লেখক : সোলায়মান আশরাফী



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top