সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

দেবী: তিয়েন আন্দালিব


প্রকাশিত:
১৬ জুন ২০১৯ ০৭:২৫

আপডেট:
১৫ এপ্রিল ২০২০ ০২:৪৫

 

এ পর্যন্ত কয়টা সিগারেট খেলো মা, দেখেছিস? প্রশ্নটা করে সঞ্জু সাহেব চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিলেন। চা টা ‘অসাধারণ প্লাস’ হয়েছে! লিলির বানানো চা সাধারনত অসাধারণই থেকে যায়। অসাধারণ প্লাস কখনও হয় না। তবে আজকেরগুলো একের পর এক অসাধারণ প্লাস হচ্ছে। রহস্যটা কি?

সকাল থেকে অনেক চা খাওয়া হল। আরও খেতে ইচ্ছা করছে। ব্যপারটা কি? ছেলেটা বাসার সামনে বসে থাকার পর পরই কি তার চা খাওয়া রোগ করল? প্রচুর সিগারেটও খেতে ইচ্ছা করছে। এটিও মনে হয় ওই ছেলেটার সিগারেট খাওয়া দেখে এসেছে। ছেলেটি একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে। অথচ চরম সিগারেটপ্রেমী হওয়া স্বত্তেও তিনি কোনো সিগারেট খেতে পারছেন না। কারণ একটাই। বাসায় সিগারেট খাওয়া নিষেধ। লিলির মিলিটারী নিয়ম। সিগারেট খেতে হলে বাসার বাইরে গিয়ে খেয়ে আসতে হবে। সাথে সাথে সিগারেটের গন্ধ দূর করার জন্য একটি চকলেটও খেয়ে আসতে হবে। মহাঝামেলা। দোকানে না যেয়ে কোন উপায় নেই। সমস্যা হল, এখন হেঁটে হেঁটে দোকানে যেতে ইচ্ছা করছে না। এই শানিকা মেয়েটা আবার কোথায় গেল? এই মাত্রই না এখানে ছিল? এখন দেখা যাচ্ছে না কেন? চশমার পাওয়ারটাও দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এটিও আরেক চিন্তার বিষয়। ইদানিং তিনি ভুল ভাল দেখা শুরু করেছেন। অবশ্য জানালা দিয়ে ছেলেটিকে তো ঠিকই ভালভাবেবেই দেখতে পারছেন। ছেলেটি মনে হয় আরেকটি সিগারেট ধরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

-বাবা, এই যে তোমার চা।

শানিকা আরেককাপ চা নিয়ে হাজির! বাহ! তার এই ছোট মেয়েটা তো দারূন বুদ্ধিমতি হয়েছে! বাবার কখন কি লাগে, কি খেতে ইচ্ছা হয় চট করে বুঝে ফেলে।

-হ্যাঁ মা, তোকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম মনে হয়!

-হ্যা বাবা, প্রশ্নটা শুনেছি। ইচ্ছা করেই জবাব দেয় নি। ভাবলাম চা নিয়ে এসে তারপর জবাব দেই।

-এই চা টা কি তুই করেছিস?

-হ্যা। কিভাবে বুঝলে? ও, চা টা পচা হয়েছে, না? পচা হলে খাওয়া লাগবে না বাবা, ফেলে দাও। মা কে বানাতে বলছি।

-আরে না মা। পচা হবে কেন? ভাল হয়েছে ভাল হয়েছে। অসাধারণ।

-কিন্তু মায়ের মত তো হয় নি, না?

-আহহা মা! ওই একই তো বেপার! উনিশ আর বিশ! কি আর এত তফাৎ? তুই বস তো আমার কাছে!

-হ্যা বাবা, তুহিন ভাইয়া সকাল থেকে মোট সাড়ে ১৮টা সিগারেট খেয়েছে।

-সাড়ে ১৮টার হিসাবটা কি?

-১৮ টার পরের সিগারেটটা অর্ধেকটা খেয়ে ফেলে দিয়েছে। তাই সাড়ে ১৮টা!

-ও আচ্ছা!

- বাবা!

-বল মা

-তুহিন ভাইয়া তো দুদিন ধরে এখানে বসে আছে। খাবার দাবারও কিছু খায় নি। দুদিন ধরে সিগারেটই খেয়ে যাচ্ছে। ভাইয়া তো মরেই যাবে! তো, তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে হবে না? দাফন কাফনের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?

-এসব তুই কি বলছিস মা!

-আমি কি বেঠিক কিছু বলেছি?

-মা, আজকে তো নাস্তা দিতে গিয়েছিলি, না?

-হুম।

-তো, নাস্তা খায় নি?

-না।

-কি বলে?

-কি আর বলবে, অই একই কথা। আনিকা আপা রাজি না হলে কিছুই খাবে না। বাসার সামনে থেকে নড়বেও না। শুধু সিগারেট খেয়ে যাবে।

-ভালবাসা বড়ই সর্বনাশা রে! কেন যে মানুষ ভালবাসে? ব্যাপারটা আজও বুঝে উঠতে পারলাম না।

-বাবা এখন যাই? এখানে বসে থাকতে ভাল লাগছে না।

-আচ্ছা মা, যা!

শানিকার চোখের কোণে কি একটু পানি দেখা গেল? নাকি তিনি ভুল দেখলেন? চোখটার যা দশা, ভুল দেখাটাই স্বভাবিক। সঞ্জু সাহেব আকাশের দিকে তাকালেন। একি! আকাশ তো ভয়াবহ কাল! হটাত আকাশ এত কাল হয়ে গেল কেন? ধুম বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। এই বৃষ্টির মাঝেও কি ছেলেটা বসে থাকবে? সঞ্জু সাহেবের মনে হতে লাগল, ছেলেটা অবশ্যই বসে থাকবে।

আনিকা খুব যত্ন করে পায়ের নখ কাটছে। নখগুলো এত বড় হয়ে গেল কবে? টেরই পায় নি। একদম ডাইনির পায়ের মত লাগছে। বড় বড় নখ রাখা রিমকির পছন্দ।  তাই বলে এত বড় না যে ডাইনির মত লাগবে। নখগুলো একটু বড় রেখে একটা চমৎকার স্টাইল দাঁড় করাতে হবে। এরপর নেইলপলিশ দিতে হবে। লাল টুকটুকে নেইলপলিশ। তার লাল নেইলপলিশটা শেষ হয়ে যায় নি তো? শেষ হয়ে গেলে তো মহাবিপদে পড়তে হবে এখন! কাল নেইলপলিশটা দিতে হবে! কাল নেইলপলিশে পায়ে একটা ডাইনি ডাইনি ভাব থেকে যায়।

-আপা, তোর চা! আসব?

-হুম আয়। মনে হচ্ছে চা আজকে নিজেই বানিয়েছিস?

-হ্যা আপা, খেয়ে দেখ না কেমন হয়েছে।

আনিকা হালকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে চায়ে চুমুক দিল। এই শানিকাটার আবার মাঝে মাঝে বাসার কাজ করার ’হিড়িক’ উঠে। আজকে মনে হয় ‘চা বানানোর হিড়িক!’ উঠেছে!

-হুম শানিকা, চা তো খুব ভাল হয়েছে রে!

-আপা সত্যি?

-সত্যি হবে না কেন? অবশ্যই সত্যি!

-আপা একটা কথা বলি?

-একটা কেন? এক হাজারটা কথা বল।

-আপা ছেলেটা মরে যাবে!

- যে মরে যেতে চায় তাকে মরে যেতে দিতে হয়।

-এসব কি বলছিস আপা!

-ঠিকই বলছি শানিকা।

-আপা একবার যদি তুই একটু বুঝিয়ে আসতি...

-দেখ শানিকা, আমি অনেক বুঝিয়েছি, আমার দ্বারা ভালবাসা টালবাসা সম্ভব না। এত বুঝানোর পরও যদি সে গাধার মত পাগলামি করে মরে, আমার কিছু করার নেই।

-কিন্তু তুই এখন ওর কাছে গিয়ে যদি একটু...

-দেখ শানিকা, তুহিন ভাই হচ্ছে একটা জঞ্জালের বাচ্চা! বুঝেছিস? একটা জঞ্জালের বাচ্চার জন্য আমি এত কষ্ট করে কাছে গিয়ে বুঝাতে পারব না, জঞ্জালের বাচ্চাকে ওর মতই থাকতে দে!

আনিকার ভীষণ রাগ উঠছে। রাগে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে পড়তে চাইছে। ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে শানিকার গালে একটা থাপ্পড় মেরে আসে! এত রাগ হচ্ছে কেন? এতটা রাগ হওয়ার মত তো কিছু শানিকা বলে নি! আনিকা আবার পায়ের নখ কাটায় মনোনিবেশ করল। এইত! এখন নখগুলোকে কত সুন্দর লাগছে! সুন্দর একটা শেপ এসে গেছে। শানিকা কি এখনো হাঁ করে তার দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে? না থাকলেই ভাল। না হলে ওকে আবার একটা বড়সড় ধমক দিতে হবে!

বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তুহিন আরেকটা সিগারেট ধরাতেই সেটা নিভে গেল। তুহিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঠে শুয়ে পড়ল। বুক আর পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে জ্বলে পুড়ে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা বার বার কেমন পাক খেয়ে উঠছে। তুহিন আনিকার বাসার দিকে তাকাল। না, আনিকাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আনিকার বাবা মোটা চশমা পড়ে বারান্দায় বসে আছেন। চোখের দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে, এটা কি বৃষ্টির কারণে না তার সময় ফুরিয়ে এল? সময় যে খুব বেশি নেই সেটা অবশ্য ভালমতই বোঝা যাচ্ছে। সময় নেই, আর সময় নেই।

কতই না ভাল চলছিল তুহিনের জীবন। দুর্দান্ত ছাত্র, চেহারা ছবিও বেশ ভাল ছিল। পড়াশোনা, খেলাধুলা, বন্ধুবান্ধব আড্ডা নিয়ে বেশ তো চলে যাচ্ছিল দিন! এই আনিকাটা বুকের মাঝে এসে সবকিছু লন্ড ভন্ড করে দিল! সকাল বিকাল, রাত্রি বুকটা যেন চিৎকার করে ডাকত,’ আনিকা! আনিকা!’

আনিকা ছাড়া জীবনে যেন কিছুই নেই। মাথার উপর আনিকা যেন একজন দেবী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। বুকটাও সারাক্ষণ শুধু গুন গুন করত, ‘আমার দেবী আনিকা! আনিকা আমার দেবী!’ আচ্ছা দেবী কেন বলতে চাইত মন? আনিকা দেবীর মত সুন্দর বলেই কি? নাকি এতই বেশি ভালবাসা ছিল যে ভালবাসা থেকে এই মন আনিকাকে দেবী বানিয়ে দিয়েছিল? দেবী আসলে দেখতে কি রকম? দেবীরা কি আসলেই অনেক সুন্দর হয়? দেবী কি আসলেই আছে? এই জীবনটাই বা আসলে কি? আশ্চর্য, হটাত মনে হচ্ছে ভালবাসা আসলে ভয়ঙ্কর এক রোগ। এই জিনিসটা কি জ্ঞানী গুনী মানুষরা বুঝতে পারে? এই রোগের কি কোন প্রতিকার নেই? ভয়াবহ রোগ ভয়াবহ রোগ! নাহ চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে...

সবকিছু ধীরে ধীরে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে...

সঞ্জু সাহেব ছাতা নিয়ে বের হয়ে এসেছেন। তার বুক ধুক পুক করছে। ছেলেটা মাঠের মাঝে মরার মত পড়ে আছে। ওর কিছু হয়ে গেল না তো?

সঞ্জু সাহেব তুহিনের কাছে এসে ডাকলেন,’বাবা! এই তুহিন বাবা!’

তুহিন ঘোরের মাঝে বলে উঠল, ‘আনিকা! আনিকা!’

-বাবা তোমার কি হয়েছে?

-আ-আনিকাকে একটু দেখব, চাচা। আনিকাকে একটু...

-তোমাকে এখন হাসপাতালে নিতে হবে, বাবা।

-না চাচা। আ-আমি একটু আনিকাকে দেখব, প্লিজ। প্লিজ আনিকাকে...

-আচ্ছা ঠিক আছে এসো আমার সাথে। শরীর কি খুব খারাপ লাগছে?

-না। ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে।

-দেখে তো মনে হচ্ছে না। তোমাকে জলদি হাসপাতালে নিতে হবে।

-আগে আমি একটু  আনিকাকে দেখব, একটু দেখব!’

-আচ্ছা আচ্ছা আমাকে শক্ত করে ধরো! এইত এসে পড়েছি।

লিলি, শানিকা আর আনিকা চোখ বড় বড় করে সঞ্জু সাহেব আর তুহিনকে দেখছে। আনিকা এত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে যেন ভাবতে পারে নি তুহিনের এত খারাপ অবস্থা হবে। তুহিনকে শক্ত করে ধরে আছেন সঞ্জু সাহেব। তুহিনের শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।

সঞ্জু সাহেব বললেন,‘তুহিন, বাবা এখন একটু দাঁড়াতে পারবে?

তুহিন আনিকার দিকে ছুটে গিয়ে বলল,‘আনিকা! আমার দেবী!’ বলেই সে আর টাল সামলাতে পারল না। ধপাস করে পড়ে গেল আনিকার পায়ে। মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত বের হয়ে এল। রক্তে আনিকার পা দুটো ভেসে গেল। তুহিন আরেকবার ‘আমার দেবী’ বলে আনিকার পা দুটো ছুঁতে চাইল। কিন্তু পারল না। হাতদুটো থেমে গেল। ফুস করে মুখ দিয়ে শেষ নিঃশ্বাসটা বের হয়ে এল। আনিকার পায়ের উপর তুহিনের মুখটা কেমন অসহায় শিশুর মত দেখাতে লাগল। মনে হতে লাগল এই বুঝি আবার মুখটা বলে উঠবে,’আনিকা! আমার দেবী!’

শানিকা হু হু করে কেঁদে উঠল।

আনিকা আর পা দুটো সরিয়ে নিল না। স্তব্ধ, পাথরের মত মুখ করে সে তার পায়ের পাতার উপর তুহিনের মুখটা দেখতে লাগল। দেখতেই লাগল।

কেন যেন মনে হচ্ছে আনিকা আর পা দুটো সরাবে না। অনন্তকাল এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে!

 

তিয়েন আন্দালিব
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top