সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চির-প্রস্থানের দিন আজ


প্রকাশিত:
৬ আগস্ট ২০১৯ ২০:৪৭

আপডেট:
১৪ এপ্রিল ২০২০ ০৬:২৬

 

আজ বাইশে শ্রাবণ। কবি রবি ঠাকুরের চির-প্রস্থানের দিন। কালের অমোঘ নিয়মে আবার ফিরে এলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চির-প্রয়াণের বেদনাবিধুর স্মৃতিবহ বাইশে শ্রাবণ। ১২৬১ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ কলকাতার ঐতিহ্যবাহী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি আলোকিত করে যে ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ঠিক সেখানেই ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তথা বাংলা বাইশে শ্রাবণ চির-বিদায় নিয়েছিলেন এই মধুময় পৃথিবী থেকে। 

নিজের জন্মদিন নিয়ে যিনি লিখেছিলেন, “ওই মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্ত্য ধূলির ঘাসে ঘাসে…”, সেই রবীন্দ্রনাথই জীবনসায়াহ্নের জন্মদিনে মৃত্যুভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে লিখেছিলেন_ “আমার এ জন্মদিন মাঝে আমিহারা,/ আমি চাহি বন্ধুজন যারা/ তাহাদের হাতের পরশে/ মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে/ নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ/ নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ…।”

১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করেন। তার জীবনের শেষ চারটি বছর কেটেছে শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে। ১৯৩৭ সালে একবার অচেতন হয়ে গিয়েছিলেন। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। এ সময় তিনি মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেন বেশ কিছু অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা। যদিও প্রথম জীবনে তিনি ভানুসিংহের পদাবলিতে লিখেছিলেন, “মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান … মৃত্যু অমৃত করে দান।” 

জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি লেখেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তি ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ মহাপ্রয়াণের ৭৭ বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ অনির্বাণ শিখার মতোই জ্বলছেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে। বাঙালি প্রতিদিনই তাকে স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে। আজও পথ খুঁজতে হয় তারই স্ফুলিঙ্গ ধরে। বাঙালির সব উৎসবেই আছেন রবীন্দ্রনাথ। 

তার সেই আকাঙ্ক্ষার মতোই শুধু ‘বন্ধুজন’ নয়, সর্বস্তরের মানুষের শেষ আশীর্বাদ আর ভালোবাসার অশ্রুতে সিক্ত হয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে কেওড়াতলা শ্মশানঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। কলকাতার সেদিনের (১৯৪১) বিবরণ তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় আর রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে কবির জীবনের সমাপ্তি হয়েছিল সর্বজনীন শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ মিছিল ছিল তার শবযাত্রায়। 

মানুষের শেষ আশীর্বাদ চেয়েছিলেন, পেয়েছেনও। এমনকি যারা ছিলেন তীব্র সমালোচক-নিন্দুক, তারাও নিন্দা প্রত্যাহার করে বিশ্বকবির অন্তিমযাত্রার খবরে বিষণ্ন হয়েছেন। সে যুগের দৈনিক আজাদ’র মতো ঘোরতর রবীন্দ্রবিরোধী পত্রিকা যে বিস্ময়কর শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়েছিল প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে, তা অকল্পনীয়ই বটে। 

তার আশি বছরের জীবনের সবটুকু জুড়েই গভীর মানবপ্রীতির এই আকাঙ্ক্ষা নানাভাবে উৎকীর্ণ। গল্পগুচ্ছের গল্পমালায় পূর্ববঙ্গের পদ্মাতীরবর্তী মানুষের সুখ-দুঃখ আর নর-নারীর জীবনতৃষ্ণার যে নিখুঁত চিত্র, তার তুলনা নেই। কবিতায়, সঙ্গীতে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে, চিত্রকলায়— এমনকি স্মৃতিকথার মধ্যেও মানবতাবাদী উদার প্রগতিশীল রবীন্দ্রনাথের দ্রোহ আর প্রেম, বাউল দর্শন আর বস্তুবাদী দর্শন মিলেমিশে একাকার। ‘সোনার তরী’, ‘মানসী’, ‘চিত্রা’র কবি হয়েও দুই দু’টি মহাযুদ্ধের ভয়াবহতায় আঁতকে ওঠেন। লেখেন ‘সভ্যতার সংকট’-এর মতো অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রবন্ধ। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ‘গোরা’র মতো উপন্যাস, নারীমুক্তির অমর বাণী ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাট্য আর ‘যোগাযোগ’-এর মতো প্রতিবাদী উপন্যাস। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলির পরতে পরতে আছে বাঙালির যাপিত জীবন, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। আছে বাঙালির চিরদিনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা। তার বহুমাত্রিক সৃজনশীলতা সাহিত্য ও শিল্পের প্রায় সব ক’টি শাখাকে স্পর্শ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। তারই দেখানো পথে বাঙালি আজও খোঁজে নতুন পথ। 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করেন তিনি ১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালি এবং এশীয় হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের মধ্যদিয়ে। ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিচারপতি সারদাচরণ মিত্র, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, মণীন্দ্রনাথ নন্দী এবং অন্যান্য পণ্ডিত মিলে সাড়ম্বরে কবির জন্মোৎসব পালন করেন। নোবেল পুরস্কার জয়ের আগে এটাই ছিল কবির প্রতি স্বদেশবাসীর প্রথম অর্ঘ্য। - তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া। 

হিংসাদীর্ণ পৃথিবীতে মানবতার কবি, মানবমৈত্রীর বাণীবাহক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমময় সুকুমার বৃত্তির চর্চা আজ বড্ড প্রয়োজন। মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতার মহত্তম বাণীর স্রষ্টা কবিকে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। মানবতার লাঞ্ছনায় যিনি ১০৩ বছর আগে ‘নাইট’ উপাধির মতো গৌরবটিকা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন তেমন মহৎ কবির কি মৃত্যু হয়! তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাকবেন চিরকাল মানুষের সুগভীর ভালোবাসায়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top