সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

ফিরে যাওয়া : সুলতানা রিজিয়া


প্রকাশিত:
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৫৯

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ১৩:০৫

 

আজকে বড়ই নিদারুন সময় গেলো।সেই যে গত তিন মাস যাবত পরিশ্রম চলছে, তারতো আর শেষ ছিলোনা।দীর্ঘ দিন ধরে নিজের কোনো কাজ তেমন করাই হয়ে ওঠেনি।শরীর, মন কিম্বা নিজের চারপাশে কি।  

জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো।সম্পত্তির অংশ ছেলেরা যতো সহজে এবং কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেয়, মেয়েদের বেলায় ততোই কঠিন।জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজের পাওনাটুকু বুঝে নিতেই মনিকাকে অনাকাঙ্খিত মারপ্যাঁচের তিক্ততায় জড়িয়ে পড়তে হয়। সন্তানদের অঢেল সম্পত্তি থাকলেও তারা মায়ের এই সামান্য পৈত্রিক সম্পত্তির অংশটি মনে মনে লালন করে এসেছে।নিজের পাওনা এবং সন্তানদের আশা পূরনের কারণেই মনিকার এতো দিনের ব্যস্ততা।সময় যে কত দ্রুত বয়ে চলে এখন বেশ বোঝা যায়। ইদিনিং মনিকার সমসাময়িক চেনা জানা বন্ধুরা প্রায় মুখে মুখে ছড়া কাটে-

দিনে দিনে দিন যে যায়-
মেঘে মেঘে সন্ধ্যা তো হয়।

সেই সকাল থেকে রাত, কেমন পলকে হারায়।জীবনের বয়স বাড়ে,পরিবারের বয়স বাড়ে, মানুষের আয়ু কমে।জন্মের পর থেকেই জীবন পায়ে পায়ে হাঁটে।শৈশব কৈশোর পেরিয়ে আসে যৌবন, মানুষ প্রস্তুত হয় যুদ্ধের জন্য। ভয়ানক এক যুদ্ধ, জীবন যুদ্ধ।এই যুদ্ধের কত আয়োজন!কত শত তার রূপ, কত তার হাতিযার, পায়ে পায়ে বাধা, সামনে পিছনে, ডানে বায়ে হাজারো প্রতিপক্ষ। জীবনে হেরে না যাওয়ার জন্য সেকি তাড়না, সতর্কতা, প্রস্তুতি।

মনিকা খুব ভালো করেই জানে যুদ্ধের ভয়াবহতা। এইতো নভেম্বরে উনসত্তর পেরোলো, ইতোমধ্যে তার বাম চোখের ছানি কাটা হয়েছে। ডান চোখটাও জ্বালাচ্ছে, মাঝে মাঝেই চোখ দিয়ে জল ঝরে, জ্বালা করে। শরীরের কাটাছেঁড়ার কষ্টের চেয়ে মনের যাতনাই বেশি মনে হয়। ছেলে মেয়েরা নিজ নিজ সংসার নিয়ে যতোটা না ব্যস্ত তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত বাইরের জগত নিয়ে।পেশাগত জীবনের পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়া বিষয়ক ঝক্কি ঝামেলা বিস্তর।সংসারে কেউই স্থিতু হতে পারেনা নানান অজুহাতে, যা নিত্যনৈমিত্তিক।

নিজের সন্তানদের নিয়ে মনিকা আর মাথা ঘামায় না, বুকের কষ্টরা এখন অভ্যাসবশতঃ ঝিম মেরে থাকে। পুরু কাঁচের চশমায় মনিকা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। সন্তানদের এমনতরো কথায় মনিকা ইদানিং গায়ে মাখেনা। দোতলা বাড়ির উত্তরে টানা বারন্দা কাঁচ দিয়ে ঘিরে মনিকার থাকার পাকাপোক্তো ব্যবস্থা করে দিয়েছে। প্রথম প্রথম বুকের কষ্টরা দলা পাকিয়ে মনিকার শ্বাস রোধ করতো, গলগল করে দু’চোখ বেয়ে জল ঝরতো। 

মাস তিনেক মনিকার মাথার ঠিক ছিলোনা, রাতের পর রাতের প্রহর কেটে যেতো, মনিকা দু’চোখের পাতা এ্ক করতে পারতো না।সব আশা ভরসা, বেঁচে থাকা সবকিছুই দূরাগত মরিচীকা মনে হতো্।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট্ট কাঁচ ঘেরা ঘরে নতুন করে গড়ে তুলেছে আপন ভূবন, জায়নামাজের মগ্নতা।গভীর নিস্তব্ধ রাতে মনিকা অপেক্ষায় থাকে দেবদূতের, জাগতিক জটিলতার নাগপাশে ইদানিং মনিকার দম বন্ধ হয়ে আসে। বিনম্র সেজদায় মনিকা নিজেকে বিছিয়ে দেয় স্রষ্টার করুণার আশে, চোখের জলে অতিক্রম করতে চায় জাগতিক উপেক্ষা, শারিরীক অক্ষমতা ও মৃত্যুভয়।

এমন ভাবে বেঁচে থাকা কি কারো কাম্য হতে পারে?মনিকার অন্তরে প্রশ্নটা দারুন ভাবে আলোড়ন ছড়ায়।বুকের অতল থেকে কষ্টের বুদবুদ দু’চোখ উপছে অশ্রু ঝরায়।নিশ্চল নিঃশ্চুপ ক্ষয়ে যাওয়া মনিকা তার জলে ভেজা অস্বচ্ছ দৃষ্টি মেলে ধরে খোলা জানালার এক খন্ড আকাশে।

 

সুলতানা রিজিয়া
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top