সিডনী সোমবার, ১৩ই মে ২০২৪, ২৯শে বৈশাখ ১৪৩১


২৫ অক্টোবর কৃতী দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী


প্রকাশিত:
২৫ অক্টোবর ২০১৯ ২৩:৫০

আপডেট:
৩০ মার্চ ২০২০ ০২:৩৬

আজ কৃতী দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী

বাংলাদেশের প্রখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী আজ । ক্ষণজন্মা এই জ্ঞানী মানুষটি বাংলা ১৩১৩ সনের ৯ কার্তিক তথা ইংরেজি ১৯০৬ সালের ২৫ অক্টোবর তারিখে সুনামগঞ্জ জেলার তেঘরিয়া গ্রামে তাঁর নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নানা ছিলেন বিখ্যাত মরমী কবি হাসান রাজা। তাঁর পিতার নাম দেওয়ান মুহাম্মদ আসাফ। তিনি ছিলেন দুহালিয়া অঞ্চলের জমিদার এবং তৎকালীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন জননেতা। তাঁর মাতা রওশন হুসেইন বানু ছিলেন কবি হাসান রাজার বড় কন্যা এবং একজন বিদুষী নারী।

শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পর্যায়ে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ অসামান্য মেধা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ডিস্টিংশনসহ বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর কর্মজীবনের শুরুতে স্বল্পসময়ের জন্য সিলেট এমসি কলেজে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন।

জীবনের এই পর্যায়ে তিনি এই অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিবেদিত কর্মকান্ডেই অধিকতর সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ত্রিশের দশকে সিলেটে ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’ প্রতিষ্ঠার সাথে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং আসাম প্রাদেশিক আইন পরিষদের আপার হাউজে সদস্য নির্বাচিত হন। দেশভাগের প্রাক্কালে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আহবানে সাড়া দিয়ে কংগ্রেস কর্তৃক প্রবর্তিত ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং এক পর্যায়ে গ্রেফতার হয়ে দশমাস কারাদন্ড ভোগ করেন।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর তৎকালীন ভাষা আন্দোলনে স্থানীয় নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ এতদঅঞ্চলের জনমানুষের স্বার্থের পক্ষে নিরবিচ্ছিন্ন এবং সংগ্রামী ভূমিকা রেখে যান। তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং রাজনীতির অঙ্গনে দীর্ঘদিনের বর্ণাঢ্য অবদানের পরও জ্ঞানপিপাসু ও মেধাবী মানুষটির মনে সর্বদাই পড়ালেখার প্রতি টান থেকে গিয়েছিলো।

১৯৪৮ সালে তিনি সুনামগঞ্জ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে পুনরায় শিক্ষকতা পেশায় ফিরে আসেন। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল এবং অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাকে এ সময় সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য এবং নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বারংবার অনুরোধ করলেও তিনি শিক্ষকতাকে প্রাধান্য দিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিরত থাকেন। তথাপি জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ছিলো। এমনকি এক পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার কারণে তৎকালীন সরকার তাকে সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করলেও শেষপর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

১৯৪৯ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে তিনি অন্যান্য ইসলামী ব্যক্তিত্বের সাথে যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম ইসলামিক একাডেমি। কালের নানা বিবর্তনের পর বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটিই ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ দার্শনিক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

কর্মজীবনে তিনি নরসিংদী কলেজ ও মতলব কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকায় আবুজর গিফারী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্র এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন।

এতদঅঞ্চলে ইসলাম ও দর্শন সংক্রান্ত জ্ঞানের রাজ্যে দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের অবদান অতুলনীয়। তিনি সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে গভীর চিন্তা ও বোধসম্পন্ন ৬৫ টি বই রচনা করে গিয়েছেন। এছাড়াও দীর্ঘদিনে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নানা সমসাময়িক প্রসঙ্গে তাঁর অসংখ্য লেখা প্রকাশ হয়েছে এবং অনেক লেখাই এখনো অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি হিসেবে থেকে গিয়েছে।

তিনি পৃথিবীর নানা দেশে অনেক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন এবং অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার দায়িত্বশীল পদে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিভিন্ন সময়ে ভারত, ইরাক, দক্ষিণ কোরিয়া এবং রোমের আন্তর্জাতিক কনফারেন্স তার প্রদত্ত বক্তব্যগুলো বিশ্বের নানা দেশের পন্ডিত ও শিক্ষাবিদদের সামনে বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চাকে উপস্থাপন করেছে।

সাহিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মাঝে দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮১), নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৪), ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম সলিডারিটি প্রাইজ (১৯৮৫), ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৮৯), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৯১), কবি মোজাম্মেল হক পুরস্কার (১৯৯১), মহান একুশে পদক (১৯৯২), মাওলানা আকরাম খাঁ স্বর্ণপদক (১৯৯৩), জালালাবাদ স্বর্ণপদক (১৯৯৪), ভাসানী পুরস্কার (১৯৯৫), শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর পুরস্কার ও বাংলাদেশ মুসলিম মিশন পুরস্কার প্রভৃতি সম্মাননা ও পদকসমূহ রয়েছে।

এই মহান ব্যক্তিত্বকে শিক্ষা, সমাজ-সংস্কৃতি ও দর্শনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালে দেশের জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করে। ১৯৯৯ সালের ১ নভেম্বর তারিখে কালের স্বাক্ষী ও জ্ঞানের মহীরুহ মহান এ শিক্ষাবিদ বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন। বাংলা ভাষায় ইসলামী জ্ঞান ও দর্শন চর্চার পাশাপাশি এই অঞ্চলের রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসে তাঁর রচনাবলী অনাগত ভবিষ্যতেও জ্ঞানপিপাসুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলীল হয়ে থাকবে।

বাংলাভাষী এই অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর আত্মউন্নয়ন ও স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকালের ঐতিহাসিক পর্যায়ে যেসকল মনীষী মূল্যবান ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখে গেছেন, মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তাদের মাঝে প্রণিধানযোগ্য একজন মানুষ। তার রচনাবলী এবং চিন্তাধারার চর্চা অব্যাহত রাখা এদেশের মানুষদের আত্মপরিচয় নির্ধারণের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মতো জ্ঞানপিপাসু পন্ডিতরা যে কোন জাতির জন্যই অমূল্য এবং ঐতিহাসিক সম্পদ হয়ে থাকেন। সুতরাং নতুন প্রজন্মের সাথে এমন মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই তাদের জন্ম, জীবন ও কর্মকে স্মরণ এবং উদযাপন করা জরুরী।

 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top