ইতিহাসের শিক্ষা ‘বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে’ : ব্যারিষ্টার সাইফুর রহমান
প্রকাশিত:
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:১৪
আপডেট:
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৮:২৪

সেটা বোধকরি ১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাস। মহাত্মা গান্ধী এসেছেন কলকাতায় কংগ্রেস পার্টির একজন সাধারণ প্রতিনিধি হয়ে। কংগ্রেসের অন্য প্রতিনিধিরা মূল অধিবেশনের আগে সাধারণত শুয়ে-বসে আলস্য সময় কাটাচ্ছিলেন। আলস্য কাকে বলে সেটা জানা নেই মহাত্মা গান্ধীর। স্বেচ্ছায় কিছু কাজ করতে চান বলে গান্ধী কিছু ঊর্ধ্বতন কংগ্রেস নেতার শরণাপন্ন হলেন। গান্ধীকে দিয়ে কী কাজ করানো যায়? এসব ভেবে ভেবে জনৈক নেতা তাকে পাঠালেন জানকীনাথ ঘোষালের কাছে। কে এই জানকীনাথ ঘোষাল? তাকে একটু পরিচয় করিয়ে না দিলে অনেক পাঠকই হয়তো তাকে চিনতে পারবেন না। কংগ্রেস পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সেবারের কংগ্রেস অধিবেশনের সম্পাদক ছিলেন জানকীনাথ। তার আরও কিছু পরিচয় হলো তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভগ্নিপতি অর্থাৎ কবিগুরুর জ্যেষ্ঠ ভগ্নি স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী ও সরলা দেবী চৌধুরানীর পিতা। সরলা দেবী চৌধুরানী বিয়ে করেছিলেন বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীকে। সেই সূত্রে জানকীনাথ ছিলেন প্রমথ চৌধুরীর শ্বশুর। সে যাক, জানকীনাথ ঘোষাল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অতি সাধারণ বেশভূষা ও পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে ভাবলেন এ ছোকরা হয়তো অতি সাধারণ কেউ আর শিক্ষা-দীক্ষাও সামান্যই হবে হয়তো। তিনি তাকে উদ্দেশ করে বললেন— “দেখ বাপু ওদিকের টেবিলটায় রাজ্যের সব চিঠি স্তূপ হয়ে আছে। সব চিঠি কি আর আমার একার পক্ষে পড়া সম্ভব? নাকি পড়ার যোগ্য। তা ভাই তুমি যদি চিঠিগুলো একটু উল্টে পাল্টে দেখ। কোনটা গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা ভাগাড়ে যাওয়ার উপযুক্ত। তা তুমি চিঠি পড়তে জানো তো নাকি?” গান্ধী যে সদ্যই বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে ফিরেছেন সেটা তিনি গোপন রাখলেন সন্তর্পণে। বিনা বাক্যব্যয়ে একজন অনুগত কেরানির মতো গান্ধী বসে গেলেন চিঠি পড়তে। আর সেদিনই তার জীবনে ঘটল ভিন্ন রকম একটি ঘটনা। জমিদারতনয় জানকীনাথ নিজে নিজে কখনো জুতার ফিতা ও কোটের বোতাম লাগাতে পারতেন না কিংবা লাগাতেন না। এসব কাজে সাধারণত সাহায্য করত তার এক ভৃত্য। বিকাল বেলা কাজ শেষে জানকীনাথ উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রিয় ভৃত্যটিকে ডাকাডাকি শুরু করলেন। কিন্তু ভৃত্যটি তখন ধারেকাছে না থাকায় গান্ধীর দিকে এমনভাবে তাকালেন জানকীনাথ, ভাবে মনে হলো যেন গান্ধী এসে তার জুতার ফিতা ও কোটের বোতামগুলো লাগিয়ে দিক। মুখে যদিও তিনি কিছু বললেন না। ব্যাপারখানা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে জানকীনাথের জুতার ফিতা ও কোটের বোতামগুলো লাগিয়ে দিলেন গান্ধী। পরে অবশ্য জানকীনাথ আরেক বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা গোখলের কাছে থেকে জেনেছিলেন যে, ওই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামে যে তরুণটিকে দিয়ে তিনি সেদিন কেরানি ও আরদালির কাজ করিয়েছিলেন আসলে সে ছিল একজন বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। উপরোক্ত ঘটনাটি ইতিহাসের পাতা থেকে ধুলাবালি ঝেড়ে তুলে ধরলাম এ কারণে যে, সত্যি সত্যি যদি কেউ বড় হতে চায় তাহলে তাকে আগে ছোট হতে হয়। নিরহংকারী হতে হয়। বিনয়ী হতে হয়। আর এ জন্যই কবি লিখেছেন— “গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে/বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।” আজকের এই লেখাটি লিখতে প্রবুদ্ধ হলাম এ জন্য যে, আমাদের চারদিকে আত্মহংকারী কিংবা ‘মুই কী হনু রে’ জাতীয় মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, তাদের হয়তো অহংকার করার মতো কিছুই নেই, তারপরও তাদের পা যেন মাটিতে পড়ে না- এ জাতীয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ ধরনের মানুষের আধিক্য থাকলেও রাজনীতিতেই কেন জানি এ ধরনের মানুষে একেবারে ভর্তি। বিশেষ করে অনেক রাজনীতিবিদের মুখে প্রায়ই ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা শুনে মনে হয় যেন আজকেই পৃথিবীর শুরু এবং আজকেই এর শেষ। এর আগেও কিছু ছিল না আর ভবিষ্যতেও কিছু ঘটবে না। অথচ ইতিহাস পড়লে জানা যায় বুদ্ধ, খলিফা ওমর, আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, ম্যান্ডেলা, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, সক্রেটিস, কনফুসিয়াস, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, তলেস্তয়, মাদার তেরেসা— আরও কত শত সহস্র মনীষী যারা ছিলেন মানবতাবাদী, বিনয়ী ও নিরহংকারী।
আমরা আমাদের জীবনের একেবারে শৈশব থেকে যুগ যুগ ধরে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রণীত ‘বড় কে?’ কবিতাটি পড়ে আসছি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। কিন্তু এই কবিতাটির তাত্পর্য কিংবা এর এতটুকু প্রভাবও কী আমাদের জীবনে কখনো পড়েছে। এখানে প্রসঙ্গক্রমেই বলতে হয় ২০১৫ সালে দেখলাম এই কবিতাটির কবির নামও পাঠ্যপুস্তক থেকে পাল্টে গেছে। এতদিন আমরা জানতাম ‘বড় কে?’ কবিতাটির লেখক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এখন আবার বলা হচ্ছে এই কবিতাটির জনক হরিশচন্দ্র মিত্র। সঠিক ইতিহাস নিয়েও এখানে ঘটানো হচ্ছে তুঘলকি কাণ্ড। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত ‘বড় কে?’ কবিতাটিতে আমার দুটো প্রিয় লাইন ছিল এরকম— “হিতাহিত না বুঝিয়া মরে অহংকারে/নিজে বড় হতে চায়, ছোট বলি তারে।” কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে হরিশচন্দ্র মিত্রের কবিতাটিতে এমন দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরণও বেমালুম গায়েব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী এমন জাদুকরি পরশপাথর যার স্পর্শে কিছু মানুষ এমন বিনয়ী ও নিরহংকারী হয়ে ওঠে। আর কিছু মানুষ থেকে যায় অহংকারী, বর্বর, হিংস্র ও দাম্ভিক। আমার মতে এই পরশপাথরটি হচ্ছে পড়াশোনা। তবে এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, অনেক মানুষ সহজাত ও জন্মগতভাবেই হয় অহংকার বিবর্জিত ও সদালাপি। গান্ধীজি সহজাতভাবে যেমন বিনয়ী ছিলেন তেমনি বইও পড়তেন প্রচুর, যদিও তিনি তার আত্মকথায় বলেছেন, “বিদ্যাভ্যাসকালে আমি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কিছুই পড়ি নাই বলা যায়। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিবার পরও খুব কম পড়িয়াছি। এমনকি আজও এ কথা বলা যায় যে, আমার পুস্তকের জ্ঞান খুবই সীমিত।” গান্ধীজির আগ্রহ ছিল বিচিত্র ধরনের বই সম্বন্ধে তার প্রমাণ পাওয়া যায় মহাদেব দেশাইয়ের দিনলিপি থেকে। ১৯৩২ সালে তিনি যখন ইয়ারবেদা জেলে ছিলেন তখন গান্ধী জানতে চান জেল লাইব্রেরিতে স্কট, মেকলে, জুলভার্ন, ভিক্তর হুগোর বই এবং কিংসলির ‘ওয়েস্টওয়ার্ড হো’ এবং গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ আছে কিনা। জেলে বসেই গান্ধীজি পড়েছেন কার্লাইলের ‘ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস’। গিবনের ‘রোম সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস’ও তিনি পড়েছেন জেলে বসেই, ১৯২২ কি ১৯২৩ সালে। সারা জীবনে গান্ধীজি কত বই পড়েছেন সেগুলো লিখতে গেলে ফুল-স্কেপ কাগজের ১০-১২ পৃষ্ঠা শুধু তার পড়াশোনার ওপরই লেখা যায়। এত বইপত্র পড়ার পরও একজন মানুষ কতটা বিনয়ী হলে বলতে পারেন যে, আমি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কিছুই পড়ি নাই। তবে মহাত্মা গান্ধীর জীবনে সম্ভবত দুজন লেখকের দুটো বই সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিল— প্রথমটি জন রাস্কিনের (১৮১৯-১৯০০) ‘আনটুু দিস্ লাস্ট’ এবং দ্বিতীয়টি— লিও তলেস্তয়ের (১৮২৮-১৯১০) ‘এ লেটার টু হিন্দু’। রাস্কিনের আনটু দিস্ লাস্ট বইটি যে গান্ধীর ভালো লাগবে এটি অতি সাধারণ কথা। কারণ এ বইটিতে লেখক বলেছেন, সমষ্টির মঙ্গলই ব্যস্টিক কল্যাণ। উকিল ও নাপিতের জীবিকা অর্জনের সমান অধিকার সুতরাং তাদের পারিশ্রমিকের হার একই নীতিতে নির্ধারিত হবে। কৃষক, মজুর প্রভৃতি যারা কায়িক পরিশ্রম করে তাদের জীবনই আদর্শ জীবন। অন্যদিকে গান্ধী তার দিকিবজয়ী ‘অহিংসা’ দর্শনটির ধারণা পেয়েছিলেন প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লিও তলেস্তয়ের কাছ থেকে। তলেস্তয় তার ‘এক হিন্দুকে লেখা চিঠি’ বইটিতে বলেছেন যে, “অহিংসাই ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতের মুক্তির একমাত্র পথ।” লিও তলেস্তয়ের লেখনীর দ্বারা গান্ধী এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, ১৯১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের কাছে একটি সমবায় খামারের নাম তিনি তলেস্তয়ের নামে নামকরণ করেছিলেন। তবে এটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক যে, গান্ধীর দার্শনিক গুরু লিও তলেস্তয় কিন্তু যৌবনে ছিলেন— অহংকারী, দাম্ভিক ও স্বার্থপর। ঠিক যেমনটি আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিবিদ ও শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের মতো। তলেস্তয় তার আত্মকথনে লিখেছেন— “সেই সময় আমি লিখতে শুরু করেছিলাম দম্ভ থেকে, স্বার্থপরতা থেকে, আত্মশ্লাঘা থেকে। আমার জীবন যেরকম, লেখার ক্ষেত্রেও তাই। যশ ও অর্থের লোভে আমার ভালোত্ব’কে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল, খারাপ মনোবৃত্তিগুলোকে প্রকাশ করতে হয়েছিল। আর আমি সফল হয়েছিলাম, প্রশংসিত হয়েছিলাম।”
কিন্তু পরিণত বয়সে আত্মানুসন্ধান করতে গিয়ে তলেস্তয় বুঝতে পারেন এগুলো সবই ভ্রান্ত, কূহক ও অপ্রয়োজনীয়। তলেস্তয় যেমনটি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন— আত্মানুসন্ধানের জন্য তলেস্তয় গিয়েছেন রাজা সলোমনের কাছে। “সলোমন বলছেন, ‘দম্ভ, আত্মশ্লাঘা, শুধুই তাই। সূর্যের নিচে কী লাভের আশা করে মানুষ তার শ্রমের জন্য? প্রজন্ম যায়, প্রজন্ম আসে, পৃথিবী টিকে থাকে।... প্রজ্ঞাকে জানার জন্য আমি হৃদয় সঁপে দিয়েছি, উন্মত্ততা আর অপরাধকে জানার জন্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার মধ্যে আছে দুঃখ। যার জ্ঞান বাড়ে, তার কষ্টও বাড়ে।... জীবিতরা জানে তারা বাঁচবে না, মৃতরা কিছুই জানে না, তাদের কোনো পুরস্কার নেই, তাদের স্মৃতি মুছে যাবে, মুছে যাবে তাদের প্রেম ও ঘৃণা, তাদের ঈর্ষা ধ্বংস হয়ে যাবে।”
তলেস্তয়, গান্ধী, লিংকন, ম্যান্ডেলা প্রমুখ ব্যক্তির বর্ণাঢ্যহীন, সাধারণ ও বিনয়ী জীবনযাপন নিয়ে যখন ভাবছিলাম ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল জনৈক এক মন্ত্রীর কথা। যিনি হাল আমলে তার একটি বক্তৃতার এক জায়গায় বললেন— বিএনপিকে সমূলে নির্মূল করে দিতে হবে। আমি নিভৃতে বসেই হাসলাম খানিকক্ষণ। ইতিহাসবোধ কতটা স্বল্প ও তুচ্ছ হলে মানুষ এমন মন্তব্য করার প্রয়াস রাখে। চাইলেই কী সবকিছু নির্মূল করা যায় নাকি নির্মূল করা সম্ভব। বিএনপিকে নির্মূল করতে হলে নিদেনপক্ষে দেশের অর্ধেক মানুষকে নির্মূল করতে হবে। জেল-জুলুম আর গুম-খুন দিয়ে কী মানুষকে তার আদর্শের জায়গা থেকে দূরে সরানো যায়। এ প্রসঙ্গে আমার একটি ইংরেজি প্রবাদ মনে পড়ে গেল— You can take the boy out of the farm but you can’t take the farm out of the boy- যার সহজ বঙ্গানুবাদ হচ্ছে- তুমি হয়তো একটি ছেলেকে গলা ধাক্কা দিয়ে একটি খামার থেকে বের করে দিতে পার কিন্তু ছেলেটির হৃদয় থেকে খামারটির স্মৃতি তুমি কীভাবে মুছে ফেলবে।
একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, সর্বদাই ইতিহাসের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে। সবকিছুই কিন্তু ঘুরেফিরে পুনরায় ফেরত আসে। সে জন্যই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষের কাছ থেকে। যিনি অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। জেলখানায় বসেও তিনি প্রায়ই তার সতীর্থ কয়েদিদের কাপড় কেচে দিতেন নিজ হাতে। অথচ তিনি জন্মেছিলেন তার অঞ্চলের গোত্র প্রধানের ঘরে। কনফুসিয়াস, কুইং ডায়নেস্টির রাজ্যতে দুটো মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। একটি স্বরাষ্ট্র অন্যটি আইন। কিন্তু তার ঘরে তেমন কোনো আসবাব ছিল না। হাঁস-মুরগিগুলো ঘরের একদিক দিয়ে প্রবেশ করে ওগুলো ওদের স্বভাবসুলভ শব্দ করতে করতে বেরিয়ে যেত অন্যদিক দিয়ে। ভাবতেই অবাক লাগে সত্যি, রূপকথার মতো ছিল তাঁদের জীবনযাপন। তবে কনফুসিয়াসের ঘরে ছিল হাজার দুয়েক বই। সক্রেটিস কিংবা বিদ্যাসাগরের মতো মানুষেরা এত বড় জ্ঞানী হয়েও অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। গ্রিসে ডায়াজেনিসের মতো বিশ্ববরেণ্য দার্শনিকেরা বাস করতেন কুঁড়েঘরে। আর সে জন্যই সম্ভবত আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বলেছিলেন— “আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম তবে আমি ডায়াজেনিস হতে চাইতাম।” আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার মতো দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েও দুই-চারটির বেশি পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল না তার। লিংকনেরই অন্য একটি প্রসঙ্গ সম্পর্কে বলে লেখাটি শেষ করছি। সেটা আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়কার ঘটনা। লিংকনের নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির সদস্য জেনারেল ফ্রেমন্টকে পদচ্যুত করে মিত্র বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য ম্যাকক্লেলানকে। কিন্তু অচিরেই ম্যাকক্লেলান সম্পর্কে মোহ ভঙ্গ হলো লিংকনের। প্রতিনিয়তই ম্যাকক্লেলান সেনাপতি হিসেবে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। সেসব বিষয়সহ আগামীদিনের রণকৌশল সম্পর্কে জানতে লিংকন স্থির করলেন তিনি নিজে যাবেন ম্যাকক্লেলানের বাসগৃহে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিওয়ার্ড লিংকনকে উদ্দেশ করে বললেন— “ম্যাকক্লেলানকে রাষ্ট্রপতি ভবনেই ডেকে পাঠানো হোক।” সে কথা না শুনে লিংকন নিজে গিয়ে হাজির হলেন ম্যাকক্লেলানের গৃহে। গৃহকর্ত্রী জানালেন যে, সেনাপতি ম্যাকক্লেলান বাড়িতে নেই। লিংকন অপেক্ষা করতে লাগলেন সেনাপতির জন্য। খানিক পরে ম্যাকক্লেলান বাড়িতে ঢুকেই দেখলেন লিংকন ও তার মন্ত্রী পরিষদের কয়েকজন সদস্য তার অপেক্ষায় বসে আছে। কিন্তু সেদিকে এতটুকু ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি গট গট করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেলেন দোতলায়। পরে ভৃত্যকে দিয়ে ম্যাকক্লেলান খবর পাঠালেন যে, তিনি অসুস্থ, তার পক্ষে নিচে এসে লিংকনের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। সিওয়ার্ড ম্যাকক্লেলানের এহেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সহ্য করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন— মি. প্রেসিডেন্ট একে এক্ষুনি বরখাস্ত করুন। লিংকন সিওয়ার্ডকে উদ্দেশ করে বললেন— জাতির এই সংকটকালে ভদ্রতাহানির ব্যাপারকে গুরুত্ব দেওয়া মোটেও উচিত হবে না। লিংকন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন— শোন সিওয়ার্ড, ম্যাকক্লেলান যদি যুদ্ধে জয়ী হতো তাহলে আমি তার ঘোড়ার রেকাব ধরতেও আপত্তি করতাম না। লেখক হিসেবে শুধু আমার এটাই দুঃখ যে, আমাদের দেশের কেউই কোনো দিন এসব ইতিহাসের দু’চার লাইনও পড়ে দেখল না। সত্যিই আফসোসের কথা।
সাইফুর রহমান
গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
বিষয়: সাইফুর রহমান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: