বিদেশি জঙ্গিরাই এখন বড় হুমকি


প্রকাশিত:
১৫ জুলাই ২০১৮ ১০:২৫

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০১:১৪

বিদেশি জঙ্গিরাই এখন বড় হুমকি

আচমকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়। দুই বছর আগে ১ জুলাই ওই হামলার পর জঙ্গি দমনে সরকারের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাসহ অন্তত ৭০ জন নিহত হন।



বিগত দুই বছর ধরে ওই হামলার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ২১ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। এদের মধ্যে ১৩ জনই বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। ছয়জনকে জীবিত গ্রেফতার করা হলেও এখনো পলাতক দু’জন। দ্রুতই আলোচিত এই ঘটনার মামলায় আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।



তদন্ত সংশ্লিষ্টদের মতে, গুলশান হামলার পর দেশীয় জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ভেঙে দেয়া সম্ভব হয়েছে। এরপরও তাদের ভাষ্যে, বাংলাদেশ এখনও ঝুঁকিমুক্ত নয়। দেশীয় জঙ্গিদের সক্রিয় রাখতে তৎপর রয়েছে বিদেশি জঙ্গিরা। তাদের মধ্যে ভার্চুয়াল যোগাযোগ হয়। ডার্ক ওয়েবে বিভিন্ন অ্যাপস ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বাইরে বসেই তাদের বিভিন্ন ধরনের দিক-নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।



জানা গেছে, যেকোনো ধরনের জঙ্গি হামলা বা অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় এরই মধ্যে পুলিশ সদর দফতর থেকে ১৯টি নির্দেশনা দিয়ে বিভিন্ন ইউনিটকে চিঠি দেয়া হয়েছে।



ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ‘আমরা জঙ্গি নেটওয়ার্ক গুড়িয়ে দিয়েছি। তাদের পর্যুদস্ত করেছি। উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি আর নাই, তারপরও তারা যাতে আর মাথাচাড়া দিতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।’



তিনি বলেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলার পর এখন পর্যন্ত ৭০টির মতো জঙ্গিবিরোধী অভিযান হয়েছে। এসব অভিযানে অনেক শীর্ষ জঙ্গি নিহত হয়েছেন, আবার অনেককে জীবিত আটক করা হয়েছে।’



কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বাংলাদেশে তৎপর জঙ্গি সংগঠনগুলোর শক্তি, সামর্থ্য ও নেটওয়ার্ক এখন বিপর্যস্ত। কিন্তু, তাদের চিন্তাধারা ও মতাদর্শের কিছু সমর্থক এখনো রয়ে গেছে। যদিও তারা ততটা সক্রিয় নয়। তবে অনুকূল পরিবেশ পেলে এরা আবার যেকোনো ঘটনা ঘটানোর প্রস্তুতি নেয়ার চেষ্টা করবে। সে কারণে আমরা সতর্ক রয়েছি।’



তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ জঙ্গিবাদের ভ্রান্ত আদর্শে বিশ্বাসী একজন ব্যক্তিও থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কমবেশি ঝুঁকি থেকে যাবে। আসলে জঙ্গিবাদ দমন একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। এটি হয়তো টেকটিক্যালি মোকাবেলা করা সহজ। কিন্তু, যেহেতু এটি একটি মতবাদ, সেক্ষেত্রে তাদের পরাস্ত করতে কিছুটা সময় লাগে। ফলে এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চালাতে হয়।’



বিদেশে থাকা জঙ্গিদের নিয়ে শঙ্কা:



জঙ্গি দমনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম টার্গেট কিলিংসহ বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতায় সক্রিয় আছে। এর মধ্যে নব্য জেএমবি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং আনসার আল ইসলাম আল-কায়েদার অনুসারি। বিভিন্ন অভিযানের মধ্যদিয়ে তাদের কোণঠাসা করা সম্ভব হলেও এখনো বড় হুমকি হয়ে আছেন বিদেশে থাকা জঙ্গিরা।



আইএস মতাদর্শী হয়ে অনেক বাংলাদেশি সিরিয়া গেছেন। এছাড়া সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জঙ্গির সংখ্যাও কম নয়। তাই দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।



সিরিয়া-আফগানিস্তানে ৮০ বাংলাদেশি জঙ্গি!



খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত ৪০ জন সিরিয়া ও আফগানিস্তানে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের মধ্যে নিহত হয়েছেন সাইফুল হক সুজন, নজিবুল্লাহ আনসারীসহ অন্তত ১০ জন। জীবিতদের মধ্যে রয়েছেন ব্যারিস্টার এ কে এম তাকিউর রহমান, তার স্ত্রী রিদিতা রাহেলা, তাহমিদ রহমান, তার স্ত্রী সায়মা খান, ডা. রোকনুদ্দীন খন্দকার, তার স্ত্রী নাঈমা আক্তার, তাদের দুই মেয়ে রেজওয়ানা রোকন ও রমিতা রোকন এবং জামাতা সাদ কাশিমসহ অনেকে।



এছাড়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অন্তত ৪০ জন প্রবাসী সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের মধ্যে জাপান থেকে সাইফুল্লাহ ওজাকি, অস্ট্রেলিয়া থেকে এ টি এম তাজউদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আতাউল হক, কানাডা থেকে তাবিরুল হাসিব, আবদুল মালিক ও তামিম চৌধুরী সিরিয়া যান। পরে তামিম দেশে এসে জঙ্গি দল গঠন করেন এবং তার পরিকল্পনাতেই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁতে হামলার ঘটনা ঘটে। পরে অবশ্য নারায়ণগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তামিম নিহত হন।



ওজাকি-তাজ-তামিমই অধিকাংশকে সিরিয়া নেন:



বাংলাদেশ থেকে যারা সিরিয়া গেছে তাদের একটা অংশ গেছে জাপান প্রবাসী সাইফুল্লাহ ওজাকির মাধ্যমে। হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় ঘরছাড়া যুবকদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে দেয়া নিখোঁজদের প্রথম তালিকায় সাইফুল্লাহ ওজাকির নাম আসে।



পরে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার জিনদপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামের জনার্দন দেবনাথের ছেলে সুজিত চন্দ্র দেবনাথই এই সাইফুল্লাহ ওজাকি।



সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে উত্তীর্ণ হন সুচিত। ২০০১ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপান গিয়ে ধর্মান্তরিত হন তিনি, নাম হয় সাইফুল্লাহ। এক জাপানি নারীকে বিয়ে করে জাপানের নাগরিকত্ব নেন; তাদের চার ছেলে ও এক মেয়েরও জন্ম হয়।



জাপানের গণমাধ্যমের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, সিরিয়ায় আইএসের কথিত রাজধানী রাকার পতনের আগেই ওজাকি সিরিয়া থেকে বেরিয়ে বুলগেরিয়া চলে যান। মাস তিনেক আগে জাপানি পুলিশ জানতে পেরেছে ওজাকি সপরিবারে ফিলিপাইনের মিন্দানাও এলাকায় আছেন। ওজাকি ফেসবুকে ক্যাডেট কলেজকেন্দ্রিক একটি পেজ খুলে আইএসের মতাদর্শ প্রচার করতেন এবং সিরিয়া যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের আর্থিকভাবে সহায়তা করতেন।



ওজাকির মাধ্যমে সিরিয়া গিয়ে পরে দেশে ফিরেছেন ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তণ ছাত্র গাজী কামরুস সালাম ওরফে সোহান নামের এক প্রকৌশলী। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।



সালামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানতে পেরেছে, সাইফুল্লাহ ওজাকির সূত্রে সিরিয়া গেছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মো. মহিবুর রহমান। তিনিও সিলেট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তণ ছাত্র মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নজিবুল্লাহ আনসারীও একই সূত্রে সিরিয়া গেছেন। নজিবুল্লাহ নিহত হয়েছেন বলে শুনেছেন গাজী কামরুস সালাম।



এছাড়া লক্ষ্মীপুরের এ টি এম তাজউদ্দিনের মাধ্যমেও অনেকে সিরিয়া পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে। তাজউদ্দিন অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষা শেষে ওই দেশেই বিয়ে করেন। সেখান থেকে ইউরোপের একটি দেশ হয়ে তিনি সস্ত্রীক সিরিয়া যান। তাজউদ্দিনের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের যোগাযোগ আছে বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। তার মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া থেকে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ সিরিয়া গেছেন বলেও জানা গেছে।



হলি আর্টিজানে হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী নারায়ণগঞ্জে নিহত শীর্ষ জঙ্গী তামিম চৌধুরীর হাত ধরেও অনেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুবক সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল বলে তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।



উৎসঃ   poriborton


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top