প্রতারণার মিলাদে গোয়েন্দা হানা


প্রকাশিত:
১৫ জুলাই ২০১৮ ১১:১৫

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০১:১৭

প্রতারণার মিলাদে গোয়েন্দা হানা

মানুষ বিভিন্ন কারণে মিলাদ বা দোয়ার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু কখনো কি শুনেছেন কারো সঙ্গে প্রতারণা করা হবে, সে জন্য মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। বিষয়টি অবিশ্বা‌স্য মনে না হলেও এমনই ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। আর সেই ‘প্রতারকচক্রের সদস্যদের’ ধরতেই মিলাদে হানা দিয়েছিল পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেসটিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) গােয়েন্দা সদস্যরা।



রাজধানীর পল্টনের বিজয়নগর এলাকার সামাদ ট্রেড সেন্টারে একটি কক্ষে গত ১০ জুলাই সকালের দিকে প্রতারক চক্র একটি মিলাদের আয়োজন করেছিল। আর সেখানে হানা দেন সিআইডির গােয়েন্দার সদস্যরা। কক্ষে প্রবেশ করেই গােয়েন্দারা প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। 



সে সময় ওই কক্ষে অবস্থানরত ১৩ প্রতারকসহ আগত অতিথিরা মিলাদে মশগুল। মিলাদ শেষে দোয়া করছিলেন। গোয়েন্দারাও হুজুরের দোয়ায় শরিক হলেন, হাত তুলে দোয়া করার ভান করলেন। কিন্তু দোয়া শেষে প্রতারকচক্রের পুরো ১৩ সদস্যকে হাতেনাতে ধরে ফেললেন তারা। আর এ দৃশ্য দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন মিলাদে আগত হুজুর।  



গ্রেফতারকৃতরা হলেন—আদনান তালুকদার ওরফে আল আমিন (৪০), খন্দকার মো. আলমগীর ওরফে মাসুম (৪২) ও জহুরুল হক ওরফে শাহজাহান মিয়া (৪২), সৈয়দ শাহরিয়ার সোহাগ ওরফে আবু শাফি তালুকদার শাফিন, খালেদ মাহমুদ ওরফে সবুজ মিয়া (৩২),  রহমত উল্লাহ সৌরভ ওরফে দেলোয়ার হোসেন, হাফিজুর রহমান আল মামুন ওরফে মামুন লস্কার, ইনছান আলী,  সিরাজুল ইসলাম, নাদিম উদ্দিন, মেহেদী হাসান, হানিফ কাজী ও মামুনুর রশিদ। তাদের সবার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী, কুষ্টিয়া, বরিশাল, কিশােরগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ফরিদপুরে। তারা ঢাকায় সংঘবদ্ধ হয়ে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করতেন।



ম্যাক্স ভিশন নামে পত্রিকায় দেওয়া প্রতারক চক্রের ভুয়া একটি চাকরির বিজ্ঞাপন। ছবি:    



সিআইডির সূত্র জানায়, তাদের কাছে তথ্য ছিল একটি প্রতারকচক্র দীর্ঘদিন ধরে নিত্যনতুন কোম্পানি খুলে তাতে চাকরি দেওয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির নামে ভুয়া কোম্পানি খুলে বিভিন্ন জনের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল।



প্রতারণার কৌশল হিসেবে তারা প্রথমে দেশের শীর্ষ সারির পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। পরে যারা সেই বিজ্ঞাপনে সাড়া দেন, তাদেরকে ভাইভায় ডেকে চাকরি হয়েছে বলে জানানো হয়। কিন্তু এই চাকরিতে যোগদানের আগে তাদের তিন থেকে ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানানো হয়। আর এসব টাকা তাদের অফিস যাতায়াতের জন্য দেওয়া গাড়ি, অবসরকালীন ভাতা, চাকরির সিকিউরিটির জন্য দিতে হবে।



এরপর চাকরিতে যাোগদানের তারিখ জানিয়ে ওই দিনই তারা টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিস গুটিয়ে কেটে পড়ত। এই প্রতারণার কাজটি তারা ২০১৩ সাল থেকে করে আসছিল। চক্রটি ২০১৩ সাল থেকে কখনো ফরচুন, রেক্সন, ইস্টার্ন, কেয়া, নেক্সাস আবার কখনো সানলাইট ও ম্যাক্স ভিশন গ্রুপ অব কোম্পানিজ নামে কোম্পানি খুলে এমন প্রতারণা করে আসছিল।



বিষয়টি দীর্ঘদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে ছিল না। তবে রমনা, পল্টন ও গুলশান থানায় আটটি মামলা হলে টনক নড়ে তাদের। মামলাগুলোর তদন্তের দায়িত্ব পান পুলিশের বিশেষ শাখা সিআইডির সদস্যরা। সর্বশেষ ম্যাক্স ভিশন কোম্পানি খুলে প্রতারকচক্রটি প্রায় ৫০ জন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।



চক্রটি ভুয়া কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া ব্যক্তিদের কাছে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর তাদের প্রত্যেককে একটি করে টেলিভিশন দিত। সেই টেলিভিশন খুললেই ভেসে উঠত সানলাইট কোম্পানির লোগোসংবলিত লেখা। বিষয়টি অনেকের কাছে অজানা থাকলেও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানতে পারেন এই সানলাইট নামে ভারতে একটি টিভি প্রস্তুতকারক কোম্পানি রয়েছে। সেই কোম্পানির কাছ থেকে প্রতারকচক্রটি টিভি কিনে ভুয়া কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিত। প্রতারণার জন্য চক্রের প্রত্যেক সদস্য তাদের আসল নামের পরিবর্তে ভুয়া ও ছদ্মনাম এবং ঠিকানা ব্যবহার করতেন। যে কারণে থানায় মামলা হলে এতদিন তাদের ধরতে পারেনি পুলিশ। 



 



সর্বশেষ সানলাইন গ্রুপের নামে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেয় প্রতারক চক্রটি। ছবি: সংগৃহীত



তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানতে পারেন, এর আগে তারা সাতটি কোম্পানি খুলে কয়েক শত মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা যেসব অফিস ভাড়া নিত, সেগুলো খুব সুন্দর করে সাজাত। যে কেউ সে অফিসগুলোতে প্রবেশ করলে বোঝার উপায় নেই যে অফিসটি প্রতারণার জন্য। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেকেই নিঃস্বও হয়েছেন। সর্বশেষ ম্যাক্স ভিশন অব কোম্পানি খুলতে গিয়ে গােয়েন্দাদের জালে আটকা পড়েন ওই চক্রের ১৩ সদস্য। তবে এখনো কয়েকজন পলাতক। তাদের গ্রেফতার করা গেলে চক্রটি এ পর্যন্ত কতজন ব্যক্তির কাছ থেকে কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং তারা এসব টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় করেছে, তা জানতে পারবে বলে জানিয়েছে সিআইডি।  



এই প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে আটটি মামলার তদন্ত করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। চক্রটি আবারও সংগঠিত হচ্ছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতেই মাঠে নেমে পড়েন গোয়েন্দা সদস্যরা।



তদন্তে বেরিয়ে আসে, চক্রটির কয়েকজন মূল হোতা হলেন আদনান তালুকদার ওরফে আল-আমিন, খন্দকার মো. আলমগীর ওরফে মাছুম এবং খালেদ মাহমুদ ওরফে সবুজ মিয়া। এই তিনজনের মধ্যে আল আমিন ২০১২ সালে ঢাকায় চাকরির খোঁজে এসে প্রতারিত হন। তাকেও এমন একটি ভুয়া কোম্পানির লোকজন চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।



পরে আল-আমিন তার কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে নিয়ে শুরু করে ভুয়া কোম্পানি। তার নাম দেন ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানি। এরপর তারা একটি ভবন ভাড়া নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। তবে এই দুটি কাজের জন্য অর্থ তারা নিজের পকেট থেকেই খরচ করতেন। তাদের সবার লক্ষ্য পূরণ হলে তারা প্রতারণার টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে যে যার মতো করে কেটে পড়তেন।



এভাবে চলে একের পর এক প্রতারণা। এই আল-আমিন একটি কোম্পানি খুলে প্রতারণার পর কিছুদিন গা-ঢাকা দিতেন। পরে আবারও নতুন লোক সংগ্রহ করে আবার নতুন নামে কোম্পানি খুলতেন, আবারও চলত প্রতারণা। 



সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘চক্রটি প্রতারণার শিকার প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে  চাকরির সিকিউরিটি মানি, পেনশন স্কিম এবং ব্যক্তিগত গাড়ি দেওয়ার নাম করে তিন লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে জমা নিত। পরে নির্ধারিত তারিখে কর্মস্থলে যোগদান করতে এলে আগে থেকে তাদের অফিস তালা দিয়ে সরে পড়ত। তবে প্রত্যকটি অফিস তারা মাত্র তিন মাসের জন্য ভাড়া নিত। চক্রটি সর্বশেষ যে অফিসটি ভাড়া নিয়েছিল, তার মাসিক ভাড়া ছিল তিন লাখ ৪০ হাজার টাকা। আর অফিসটি নামিদামি কর্পোরেট অফিসের চেয়ে সুন্দর ছিল। দেখে বোঝার কোনো উপায় ছিল না অফিসটি তারা প্রতারণার জন্য ব্যবহার করে।





 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top