একা এবং একা (পর্ব: চার) : আহসান হাবীব
প্রকাশিত:
৬ জুলাই ২০২০ ২২:৫৫
আপডেট:
৪ আগস্ট ২০২০ ২২:০৯

টিচার্স রুমে টিচাররা সব বসে আছেন। মারুফ ঢুকতেই মনিকা ম্যাডাম উঠে দাড়ালেন, তার চেহারায় যথেষ্ট কাঠিন্য; চক ডাস্টার নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন তিনি। রফিক স্যার হাসি মুখে তাকালেন মারুফের দিকে
- তাহলে মারুফ স্যার আপনার ক্লাশ শুরু হচ্ছে কবে? মানে ড্রিল ক্লাশ?
- আজকে জানানোর কথা, মজিদ স্যার নতুন রুটিন করেছেন, হেড স্যারের সাইন হলেই...
- আচ্ছা স্যার, আপনি ঠিক কি শিখাবেন ছাত্রদের?
- আমি ভাবছি সেলফ-ডিফেন্সটা শিখাব। স্বাভাবিক শরীর চর্চ্চার পাশা-পাশি এখন এটা জানা মনে হয় জরুরী।
- আচ্ছা ধরেন কেউ একজন দু’নলা গাদা বন্দুক নিয়ে দিনে দুপুরে আমাকে আক্রমন করে বসল, সেলফ ডিফেন্স জানা থাকলে আমি কি ওকে ঠেকাতে পারব? প্রশ্নের ধরনে হেসে ফেলল মারুফ ‘দেখুন রফিক স্যার, গাদা বন্দুক বা যা নিয়েই আক্রমন করুক পরিস্থিতিটা আগে বুঝতে হবে, ক’জন আক্রমন করল, পরিবেশটা কেমন... আপনি কতটা প্রস্তুত সব দিক বিবেচনা করে...’
রফিক স্যার ততক্ষনে মারুফের কথা আর শুনছেন না, তিনি ভাবনার জগতে চলে গেছেন। তার বাড়ীওলার সঙ্গে পানির মেশিন ছাড়া নিয়ে ঝামেলা চলছে। ব্যাটার একটা দোনলা গাদা বন্দুক আছে! মাঝে মাঝেই বন্দুক হাতে বারান্দায় এসে চেচামেচি করে অন্য ভাড়াটেদের সাথে। ব্যাটাকে যদি একটা শিক্ষা দেয়া যেত। মারুফ স্যারের কাছে সেলফ ডিফেন্সের দু একটা কৌশল শিখতেই হবে...!
- হেড স্যার কি আজ আসেন নি? মারুফ তাকায় রফিক স্যারের দিকে।
- না। চক ডাস্টার নিয়ে উঠে দাড়ান রফিক স্যার। ‘হেড স্যারতো কামাই দেয়ার মানুষ না, মনে হয় জ্বর-জারি কিছু একটা হয়েছে, খবর নেয়া দরকার; আমি যাই...!’
আজ তিন দিন হেডস্যার স্কুলে আসছেন না, তার না আসার কারণটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না, হয়ত রফিক স্যারের কথাই ঠিক, জ্বর-জারি কিছু একটা হয়েছে। এই সময় মজিদ স্যার ঢুকলেন। তাকে ঢুকতে দেখে মাহফুজা ম্যাডাম তার খাতাপত্র নিয়ে উঠে গেলেন, যদিও ক্লাশ শুরুর ঘন্টা এখনো পড়েনি। মজিদ স্যার হাসিমুখে মারুফকে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন।
- কিসের খাম? নতুন ক্লাশ রুটিন?
- খুলেই দেখুন।
খাম খুলে অবাক হল মারুফ। স্কুলের প্যাডে ছোট্ট একটা চিঠি। নিচে হেডস্যার মানবেন্দ্র দাসের স্বাক্ষর। এটা যে সত্যিই প্রধান শিক্ষক মানবেন্দ্র দাসের স্বাক্ষর তাতে কোন সন্দেহ নাই।
মারুফ রহমান
মহোদয়
পরিতাপের বিষয় যে, স্কুল কমিটির সিদ্ধান্তে আপনাকে ‘সরযুবালা বিদ্যা নিকেতন’ এর শরীর চর্চা শিক্ষকের পদ হইতে অদ্য অব্যাহতি দেয়া হইল। বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে শরীর চর্চা শিক্ষকের প্রয়োজন নাই। তাই সর্বসম্মতিক্রমে এই পদ বাতিল করা হইল।
এই পত্র পাওয়া মাত্র আপনাকে স্কুল এলাকা ত্যাগ করিতে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করা গেল।
বিনীত
(স্বাক্ষর)
মানবেন্দ্র দাস
প্রধান শিক্ষক
সরযুবালা বিদ্যানিকেতন।
মারুফ খেয়াল করল। একটু আগেও মজিদ স্যার সহ অন্য দুজন শিক্ষক, ম্যাডাম এই টিচার্সরুমেই ছিলেন, শুধু মনিকা ম্যাডাম ছিল না। এখন কেউ নেই, সে একা।
মারুফ বাইরে এসে দেখে মবিন দাড়িয়ে আছে , তার হাতে মারুফের লাল ক্যাম্বিস ব্যাগটা।
- স্যার চলেন আপনেরে রিক্সায় উঠায়া দেই। মারুফ বেশ অবাক হল, সব কিছু এত আগে থেকে প্রস্তুত! মবিন পর্যন্ত তার ব্যাগ নিয়ে রেডি! তিনি মবিনের দিকে তাকালেন। তার চেহারাটা থেকে কিছু ধরা যাচ্ছে না। যেন কিছুই ঘটেনি বা ঘটছে না।
- চল
মবিন হঠাৎ ফিস ফিস করল ‘স্যার আপনের বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলতাছে। ঐদিন মেয়র সাবের অফিসে মজিদ স্যার আর মনিকা ম্যাডামরে দেখছি, তারা অনেক্ষন ধইরা মিটিং করছে।’
- কিসের মিটিং?
- মনে হয় আপনেরে নিয়াই মিটিং
- তাই নাকি ?
- জি স্যার, আপনি কিন্তু স্যার বিরাট বিপদে আছেন... হেডস্যারও...
মারুফ অংকটা মেলানোর চেষ্টা করে। হেডস্যার নেই, হঠাৎ তার চাকরীও নেই। মনিকার হঠাৎ ক্ষেপে উঠা... দুইয়ে দুইয়ে চার হচ্ছে না, বাইশ হয়ে যাচ্ছে। অংকের শিক্ষক তার বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত বলতেন ‘মারুফ, ২২ সংখ্যাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ । ২২ কে ৭ দিয়ে ভাগ করলে...একটা অসীম সংখ্যা পাই আমরা, আবার ২২ কে ২ দিয়ে ভাগ করলে পাই ১১, আর মজার ব্যাপার কি জানিস? ফিবনাক্কি রাশিমালার ১১ তম সংখ্যা ৮৯ ... আর ১ কে ৮৯ দিয়ে ভাগ করলে সেই ফিবোনাক্কি রাশিমালাই ফিরে পাই আমরা... ০১১২৩৫৮...’
স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে এসে মারুফ বলল ‘মবিন ব্যাগটা আমার হাতে দাও, রিক্সা আমি ঠিক করে নিব।’ মবিন ব্যাগটা দিল। মারুফের ভুলও হতে পারে তবে মনে হল মবিনের চোখটা একটু ভিজে। সে কি মারুফের জন্য মন খারাপ করছে? মারুফ ওর কাধে হাত দিয়ে বলল ‘মন খারাপ কর না, আমি হয়ত আবার আসব...’
-হ স্যার আইসেন আমি আপনার লাইগা অপেক্ষা করুম।
অবশ্য খুব বেশীদূর যেতে পারল না মারুফ, সন্ধ্যা সবে নেমে আসছে, আধো আলো অন্ধকারে আট দশজনের একটা দল ঘিরে ধরল তাকে, এই গরমেও দুতিনজনের গায়ে চাদর পড়া; তারমানে এরা সশস্ত্র। সব অচেনা মুখ। তারা হুট করে কোথা থেকে এল কে জানে। মারুফ ওদের বাধা দিল না। শান্ত স্বরে বলল ‘আমাকে তোমরা কোথায় নিতে চাও?’
মারুফের কোরিয়ান কারাটে ট্রেনার তাকে একবার সাবধান করেছিল চারজনের বেশী হলে কখনো লড়তে যেও না। মনে রেখ যারা আক্রমন করে তারা কিছু কৌশল জেনেই আক্রমন করে।
মারুফের ক্যাম্বিসের ছোট্ট লাল ব্যাগটা রাস্তার ধারে পরে রইল। দলের একজন পিছিয়ে এসে লাথি মেরে ব্যাগটা ফেলে দিল পাশের ড্রেনে। এই শহরের সিটি কর্পোরেনের সবচে বড় ড্রেন এটাই। গতকাল বৃষ্টি হয়েছে, বেশ পানি ড্রেনে। ব্যাগটা টুপ করে ডুবে গেল ড্রেনের ময়লা পনিতে।
ঐ ছোট্ট শহরটায় মারুফের আর কোনো চিহ্ন থাকল না ।
নতুন করে সরযুবালা বিদ্যানিকেতনের যাত্রা শুরু। মেয়র সাহেব হঠাৎ স্কুলের সেই পাওনা টাকার দিয়ে গেছেন মানবেন্দ্র স্যারকে। কিছুদিন আগের হতদরিদ্র স্কুলটির এখন বেশ রমরমা অবস্থা। নতুন ছাত্র/ছাত্রীও ভর্তি হয়েছে মন্দ নয়। সরকারী হাই স্কুলের অনেক ছাত্র/ছাত্রীও নাকি এসে ভর্তি হয়েছে এই স্কুলে।
স্কুলের টিচার্স রুমে মিটিং চলছিল। মজিদ স্যার রুষ্ট স্বরে বললেন
- আমার মনে হয় মবিনকে বাদ দিয়ে নতুন লোক রাখতে হবে
- কেন স্যার?
- ও আজকাল ঠিকমত স্কুলের ডিউটি করছে না। কোথায় থাকে কি করে বোঝা মুশকিল। এই যে আপনারা সিংঙ্গারা খাচ্ছেন চা খাচ্ছেন, আমি নিজে গিয়ে ক্যান্টিন থেকে এনেছি। কাজের সময় তাকে পাওয়া না গেলে তাকে রেখে আমাদের লাভ কি?
- ঠিক বলেছেন হয়ত দেখা যাবে একদিন আমাদের ক্লাশের ঘন্টাও পিটাতে হচ্ছে। মজিদ স্যারকে তাল দিলেন মাহফুজা ম্যাডাম।
আসলেই মবিন কোথায় থাকে আজকাল? হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যায় , কোথায় যায় সে?
মবিন অবশ্য স্কুলের আশে পাশেই আছে। ড্রেনের পাশে বসে জল বিয়োগ করতে বসেছে; এই মুহুর্তে এই অবস্থায় তাকে দেখলে হেড স্যার তখন তখনই তার চাকরী খেয়ে দিতেন, সন্দেহ নাই। ঠিক তখনই জিনিষটা নজরে এল মবিনের, ড্রেনের মধ্যে একটুখানি ভেসে আছে। হ্যাঁ কোন সন্দেহ নেই মারুফ স্যারের ক্যাম্বিসের ব্যাগটার লাল হাতলটা। প্রাকৃতিক কাজ মাঝপথে বন্ধ করা খুবই কষ্টকর কাজ। তারপরও তাই করতে হল মবিনকে। আর যাই হোক স্যারের ব্যাগের উপরতো আর ইয়ে করা যায় না।
ব্যাগটা টেনে তুলে রিক্সায় নিয়ে রওনা হল মবিন। বাজে গন্ধ বেরুচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। তার মানে কি স্যারকে ওরা উঠিয়ে নিয়ে গেছে ঐদিনই? মবিনের আফসোস হল ঐদিন স্যারকে রিক্সায় উঠিয়ে দেয়া পর্যন্ত তার থাকা দরকার ছিল।
মবিন পরদিন স্কুলে গিয়ে শুনে তার চাকরী নেই। মজিদ স্যার বলল ‘তোমার আর আসার দরকার নেই, আমরা অন্য লোক রেখেছি’
- ক্যান স্যার আমি কি করছি?
- সেটা হেডস্যারকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।
- হেড স্যারতো স্কুলেই আসে না
- কেন আসে না সেইটার আমি কি জানি!
- স্যার আমার বেতন?
- বেতন কিরে হারামজাদা? কয়দিন ডিউটি করছস এই মাসে?? বিশ্রি ভাবে খেকিয়ে উঠেন মজিদ স্যার।
মবিন অবশ্য হেড স্যারের রুমে গেল না। তার জিনিষপত্র নিয়ে বের হয়ে গেল। তার কাছে খুব আশ্চর্য লাগছে হেডস্যার সহ সবাই যেন একটু বদলে গেছে। এর কারণ কি? এ কোন চক্কর শুরু হল স্কুলে? ক্যান্টিনে গিয়ে দেখে শাহজাহান চাচা সিঙ্গারার খামির তৈরী করছে, দুই হাতে দলাই মলাই করছে।
- চাচা?
- ক
- আমার চারকী খায়া দিছে
- কে খাইল?
- কে খাইছে বুঝেন না!
- হু, চপ খাবি? আইজ আলুর চপ বানাইছি । মবিন বিরক্ত হয়ে একটা চপ তুলে কামড় দেয়। গরম চপ, তারপরও খেতে বিস্বাদ লাগছে।
আজ বৃহস্পতিবার নতুন মাসের ১ তারিখ, স্যারদের বেতনের ডেট। মাস ছয়েক আগেও সরযুবালা বিদ্যানিকেতনে স্যারদের বেতনের কোন ঠিক ঠিকানা ছিল না। এখন ঠিক এক তারিখে বেতন হয়। স্কুল ছুটির পর টিচার্স রুমে এসে স্কুলের নতুন একাউনটেন্ট ফজলুর রহমান যার যার হাতে খাম ধরিয়ে দেয়।
মজিদ স্যার তার খামটা নিয়ে স্কুলের গেটে দাড়ালেন। তার পিছে পিছে ব্যাগ নিয়ে কুদ্দুস আসছে। কুদ্দুস মবিনের জায়গায় নতুন লোক। মজিদ স্যারের নিজস্ব লোক। তার গ্রামের বাড়ির পাশের বাড়ির ছেলে। ছেলে ভাল, শিক্ষিত ইন্টার পাশ। মবিনতো ছিল অশিক্ষিত । এমন না যে নিজের লোক ঢুকানোর জন্য মজিদ স্যার মবিনের চাকরী খেয়েছেন। তিনি একটা প্রস্তাব রেখেছিলেন সবাই সেটা গ্রহণ করেছে।
- কুদ্দুস?
- স্যার?
- ব্যাগটা দেও
- আমি আউগাইয়া দেই?
- দরকার নাই। বেতন পাইছ?
- জি পাইছি।
- সব টাকা নিজের কাছে রাইখ না, কিছু বাড়ীতে পাঠায়া দেও।
- জি চাচা
- আবার চাচা, বলেছি না স্কুলে কখনো চাচা ডাকবা না
- জি স্যার
মজিদ স্যার হাঁটা দেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজ একটু আগে যাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আজই দেরী হয়ে গেল। তিনি দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। অনেকদিন হাঁটা হয় না, আজ একটু হাঁটা যাক; ডায়বেটিসে ধরেছে। ডাক্তার বলেছে নিয়ম করে প্রতিদিন আধা ঘন্টা হাঁটতে।
কদম গাছটার মোড়ে এসে দাড়াতে হল মজিদ স্যারকে। দুটো লোক পথ আটকে দাড়াল স্যারের।
- স্যার সেলামালিকুম
- কে?
- স্যার আমি মবিন
মজিদ স্যার দেখলেন সত্যিই তার সামনে দাড়িয়ে আছে মবিন, তার ডান হাতটা একটু বেশী লম্বা দেখাচ্ছে যেন। মজিদ স্যার খেয়াল করে দেখেন মবিনের ডান হাতে একটা পিস্তল ধরা, সে খুব অভিজ্ঞ মানুষের মত জিনিষটা ধরে আছে, এটা কি খেলনা পিস্তল না আসল? পিছনে তার চেয়ে লম্বা আরেকজন দাড়িয়ে। এই লোকটা কে? কোন কারণ ছাড়াই মজিদ স্যার ঘামতে লাগলেন, এরা তার কাছে কি চায়!
(চলবে)
একা এবং একা - পর্ব এক
একা এবং একা - পর্ব দুই
একা এবং একা - পর্ব তিন
একা এবং একা - পর্ব চার
একা এবং একা - পর্ব পাঁচ
একা এবং একা - পর্ব ছয়
একা এবং একা - পর্ব সাত
একা এবং একা - পর্ব আট
বিষয়: আহসান হাবীব
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: