একা এবং একা (পর্ব ৫) : আহসান হাবীব
প্রকাশিত:
১৩ জুলাই ২০২০ ২২:০৭
আপডেট:
৪ আগস্ট ২০২০ ২২:০৯

- আপনি বলছেন আপনার বেতনের সব টাকা স্কুলের পিয়ন মবিন হাইজ্যাক করেছে?
- জি?
- ওর সঙ্গে আর কেউ ছিল?
- ছিল
- কে সে?
একটু ইতস্তত করলেন মজিদ স্যার। ‘ইয়ে ...মনে হয় ড্রিল স্যার মারুফ, মারুফ রহমান।’
-মানে? যে স্যারকে আপনারা নিয়োগ দিয়ে আবার দুই মাস পর বিদেয় করেছেন সেই স্যার?
মাথা নাড়েন মজিদ স্যার।
- আপনি সিওর?
- চেহারা কাটিংয়ে ঐ রকম মনে হল। তা ছাড়া মবিন আর মারুফ স্যার দুজনের বেশ খাতির ছিল। দুজনেরই চাকরী নেই... হতে পারে তারা ভেবেছে আমি স্কুলের কলকাঠি নাড়ছি... আমাকে ইয়ে করতে...
কথা হচ্ছিল থানায় বসে সেকেন্ড অফিসারের সঙ্গে। সেকেন্ড অফিসারের পাশে একজন কনস্টেবল বসে নোট নিচ্ছিল।
থানা থেকে বেরুতে বেরুতে ঘন্টা খানেক লাগলো। থানাওলারা টাকা উদ্ধারের সেরকম কোন আশা দিল বলে মনে হল না। তবে চেষ্টা করবেন তারা। এমনটাই বললেন। মজিদ স্যার মেজাজ খারাপ করে স্কুলের দিকে হাঁটা দিলেন। ফার্স্ট পিরিয়ডে তার ক্লাশ আছে। মনে হচ্ছে প্রথম ক্লাশটা মিস হবে।
টিচার্স রুমে সবাই ঘিরে ধরল মজিদ স্যারকে। এই শহরেতো হাইজ্যাক টাইজ্যাক ছিল না। তাহলে এটাও শুরু হল। এবং শুরু হল এই স্কুলের কারণে। মবিনের চাকরী না গেলে হয়ত এটা ঘটত না। সবার মতামত অনেকটা এরকম।
- আপনারা বলতে চাচ্ছেন আমি ওর চাকরী খেয়েছি? মজিদ স্যার একরকম চেচিয়ে উঠলেন।
- না সেটা বলছি না। ওর চাকরী আমরা সবাই মিলেই খেয়েছি। আমার মনে হয় ক্যান্টিনের শাহজাহানের চাকরীটাও খেতে হবে। বললেন রফিক স্যার
- কেন সে কি করেছে?
- কি করেছে মানে আজকাল তার সিঙ্গারা সামুচা চপের অবস্থা দেখেছেন? রফিক স্যারকে বেশ ক্ষিপ্ত মনে হয় ‘ আলুর চপতো না স্রেফ আলু ভর্তা, এর চেয়ে সিদ্ধ আলু লবন মরিচ দিয়ে চিবিয়ে খাওয়া ভাল আর সিঙ্গারার মধ্যেতো সেদিন আমি একটা আস্ত গান্ধি পোকা পেলাম ’
- মরা না জেতা? পাশ থেকে মাহফুজা ম্যাডাম বলে। সবাই হেসে উঠে। রফিক স্যারের হঠাৎ মনে হল এরা সবাই তার সাথে ইয়ার্কী করছে নাকি!
- পরে সেই গান্ধি পোকাওলা সিঙ্গারা কি করলেন? রফিক স্যার তাকিয়ে দেখেন প্রশ্নটা করেছে নতুন একাউনটেন্ট ফজলুর রহমান। ব্যাটা ফাজিলের ফাজিল, মজিদ স্যারের ডান হাত... তোরতো টিচার্স রুমে আড্ডা মারার কথা না। তার চেহারা দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে ইয়ার্কী করছে
- কি আর করব পোকাটা ফেলে দিয়ে সিঙ্গারা খেলাম
- কি বলছেন সত্যি খেলেন? মাহফুজা ম্যাডামের চোখে অবিশ্বাস!
- হ্যাঁ খেলাম. আফটার অল প্রোটিনতো... সবাই আবার হেসে উঠল। রফিক স্যারের ভাল লাগলো তার ফানটা সবাই গ্রহন করেছে।
- কি ব্যাপার আপনারা কেউ ক্লাশে যাচ্ছেন না। সবাই তাকিয়ে দেখে হেড স্যার দরজায় দাড়িয়ে। তিনি তাহলে এসেছেন আজ। এই ক’দিনে তিনি আরো বুড়িয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে।
- এই যাচ্ছি স্যার। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে তাই সবাই...
- কি দুর্ঘটনা?
- মজিদ স্যারের পুরো বেতন হাইজ্যাক হয়েছে!
- হাইজ্যাক?
- জি, হাইজ্যাক করেছে আমাদের পিয়ন মবিন। তার হাতে পিস্তল ছিল।
- সে পিস্তল পেল কোথায়?
- সেটাইতো প্রশ্ন স্যার
- আবার সাথে নাকি মারুফ স্যারও ছিল
- ছি ছি আপনারা এসব কি বলছেন? না জেনে না শুনে? সে ভদ্রলোকের সন্তান।
- মজিদ স্যার নিজের চোখে দেখেছেন। হেডস্যার আর ওখানে দাড়ালেন না। হন হন করে হেঁটে তার রুমের দিকে চলে গেলেন।
সবাই ক্লাশে চলে গেলেও মনিকা বসে রইলেন। তার ক্লাশ দু পিরিয়ড পরে। এক কাপ চা খাওয়া দরকার।
মবিন নেই, কুদ্দুসকে ডাকা যেতে পারে। ‘কুদ্দুস কুদ্দুস’ চেচালেন মনিকা ম্যাডাম কয়েকবার। ঘন্টা বাজালেন বার দুয়েক তাতেও কুদ্দুসকে দেখা গেল না। তবে ঢুকলেন মজিদ স্যার।
- ম্যাডাম আছেন?
- জি
- ক্লাশ কখন?
- প্রথমটা সেকেন্ড পিরিয়ডে
- আজকে ছুটির পর একটু থাইকেন
- কেন স্যার?
- মেয়র সাহেবের অফিসে আপনাকে নিয়ে একটু যাব।
- আবার মিটিং?
- মিটিং না, মেয়র সাহেব চা খেতে ডাকছেন।
- স্যার আমার ভয় লাগছে, আমাকে বাদ দেন
- কি বলছেন। সবতো প্ল্যান মতই এগুচ্ছে। আমি আছি না, আর যা করছি সবতো স্কুলের ভালর জন্যই করছি, এটা মানেনতো?
মাথা নাড়ে মনিকা ম্যাডাম।
- ম্যাডাম চা খেয়েছেন ?
- না, কুদ্দুসকে পেলাম না
- কুদ্দুসকে আমিই একটু বাইরে পাঠিয়েছি। আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করছি। মজিদ স্যার বেড়িয়ে গেলেন। একটু পরেই কুদ্দুস চা আর দুটো চপ নিয়ে এল। মনিকা ম্যাডাম টাকা দিতে গেল। কুদ্দুস বলল ‘ ট্যাকা লাগব না, মজিদ স্যারে দিয়া দিসে’ মনিকা ম্যাডাম অস্বস্থি নিয়ে চপে কামড় দেয়। বেশ সুস্বাদু চপ সন্দেহ নেই। চা’টাও ভাল লাগল। তারপরও ভিতরের অস্বস্থিটা যাচ্ছে না। মারুফ লোকটার প্রতি কি অবিচার করল সবাই মিলে? লোকটাকে কেন যেন প্রথম থেকেই পছন্দ হচ্ছিল না মনিকার। মালয়েশিয়া থেকে হেড স্যারের টাকা আসার ব্যাপারটা নিয়ে মিথ্যা কথা বলল লোকটা। মনিকা আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, তাকে অন্যরকম বোঝানো হয়েছে ... সেকি নোংরা কোনো পাকে জড়িয়ে যাচ্ছে, অবশ্য বন্দুকের গুলি বের হয়ে গেছে, অনেক আগেই... !
সেদিন দুপুরে মানবেন্দ্র দাসের হার্ট এ্যাটাক করল। ধরা ধরি করে হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা গেল হার্ট এ্যাটাক না স্ট্রোক করেছে। শরীরের বাম সাইড পুরা প্যারালাইজড। তার কথা বন্ধ হয়ে গেছে, ঘোলাটে চোখে সবার দিকে তাকাচ্ছেন!
বাধ্য হয়েই স্কুলের দায়িত্ব নিলেন মজিদ স্যার। এই মুহূর্তে স্কুলের সবচে সিনিয়র শিক্ষক মজিদ স্যার, মজিদুল ইসলাম; সরযুবালা বিদ্যা নিকেতনের আপাতত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।
ভট ভট শব্দ হচ্ছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশে আলোহীন ফ্যাকাশে একটা চাঁদ। মারুফের বোধ হল সে একটা নৌকায়, খুব সম্ভব শ্যালো ইঞ্জিনের বড় নৌকা। তার হাতপা বাধা, নৌকার পাটাতনের উপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে। সারা শরীরে ব্যাথা... আর কিছু মনে করতে পারছে না এই মুহূর্তে। তখনই চিকন একটা কান্নার শব্দ পেল। আশ্চর্য ! ঠিক তার পাশে একটা মেয়ে পড়ে আছে উপুর হয়ে তারও হাতপা বাধা। এই সময় একটা গলা শোনা গেল।
- এই মাঝি দুবলার মোড়ে আইছি?
- আরো বিশ মিনিট
- আইলে কইস
- আইচ্ছা। তৃতীয় একটা গলা শোনা যায়। ‘মালেক ভাই?’
- ক
- এগো কেমনে মারবেন? গুল্লি কইরা নদীত ফেলাইবেন?
- নারে বেকুব তাইলেতো দুইদিন পর লাশ ভাইসা উঠব, জানাজানি হইব। অন্য বুদ্ধি আছে
- কি বুদ্ধি?
- প্রথমে গুল্লি করবি মাস্টররে, হেরপর পেট বরাবর ফইড়া ফেলবি দাও দিয়া।
- হেরপর নদীতে ফেলামু?
- না না হেরপর পেডের ভিতর চুনা দিয়া শিলি দিবি, হেরপর নদীত ফেলাইবি। তাইলে আর জিন্দেগীতে লাশ ভাইসা উঠব না
- বাপরে ম্যালা কাম!
- তো ট্যাকা এমনি এমনি খিলাবি হালার পো ?
- গুল্লির দরকার কি পেট ফাড়লেইতো কাহিনী শ্যাষ
- তাও হয়
- চুনা পাইবেন কই?
- আরে গাধা নৌকার পাটাতনের নিচে ড্রাম ভর্তি চুনা... একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। কে হাসল, কেন হাসল বোঝা গেল না। তবে এটা নিশ্চিত নৌকায় আছে তিনজন।
হঠাৎ শ্যালো নৌকার ভট ভট শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।
- আইছি?
- হ
- রাজীব?
- জি
- রেডি হ। আগে মাস্টররে...
ওরা কি পেট ফাড়বে আগে না গুলি করবে? মারুফ পাশ ফিরে তাকাল, দেখে মেয়েটা তাকিয়ে আছে তার দিকে; এতক্ষন খুন খুন করে কাঁদছিল, এখন চুপ। মেয়েটার বয়স কত হবে ২০/২১? মেয়েটা ফিস ফিস করল-
-ওরা এখন আমাদের মেরে ফেলবে!
মারুফ কিছু বলল না। মেয়েটার নাম কি কোত্থেকে কিভাবে এল তার পাশে? নৌকার পাটাতনে শব্দ হচ্ছে, একজন এগিয়ে আসছে; মারুফ শরীরের সমস্ত পেশী ঢিলে করে অপেক্ষা করে। তার হাত পা দুটোই নাইলনের দড়ি দিয়ে বাধা, বেশ ভাল ভাবেই বাধা। চাঁদের ফ্যাকাশে আলোয় দেখা গেল লম্বা একটা লোক এগিয়ে আসছে তার দিকে, তার হাতে বেশ বড় একটা রাম দা... এই লোকটার নামই বোধ হয় রাজীব। সে কি রাম দা দিয়ে আগে পেট ফাড়বে মারুফের...?
রামদা হাতের লোকটা একটু নিচু হতেই সেকেন্ডের মধ্যে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে জোড়া পায়ে লাথি দিল মারুফ লোকটার পেটের নরম পেশীতে। লোকটা টাল সামলাতে পারল না, কয়েক সেকেন্ডের জন্য শূণ্যে উঠে ঝপ করে নদীতে ছিটকে পরল রামদা সহ! নদীর পানিতে বেশ বড় ধরনের একটা আলোড়নের শব্দ হল।
-ওরেশ- শালা মাস্টরের প্যাডে এত বুদ্ধি!
এবার পিস্তল হাতে উঠে আসে মালেক নামের লোকটা, সম্ভবত সেই দলপতি । কথা শুনে বোঝা গেল এই লোকটাই সেই পেট ফাড়া চুনা বিশেষজ্ঞ! লোকটার মাথা বেশ ঠান্ডা, যেন এমনটাই হত এমন ভাবে মাঝিকে বলল ‘ঐ রাজীবরে পানি থাইকা উঠা’ বলে পিস্তলটা মারুফের দিকে তাক করে। পিস্তলের নলটা মারুফের একদম পয়েন্ট ব্ল্যা্কং রেঞ্জে আছে। মারুফের আর কিছুই করার নেই, একই জিনিষ দুবার ঘটনো সম্ভব নয়। মৃত্যু বোধহয় এভাবেই আসে। পানিতে পরা লোকটা হাচড়ে পাচড়ে উঠে আসার চেষ্টা করছে নৌকায়, টের পাওয়া যাচ্ছে; সময় যেন থমকে গেল!
ঠিক তখনই খুব কাছ থেকে পর পর দুটো গুলির শব্দ হল! আকাশের ফ্যাকাশে চাঁদটা হঠাৎ করে উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে। ঝাপসা মেঘগুলো চাঁদটাকে কেন্দ্র করে গোল হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে, অদ্ভুত এক দৃশ্য!
(চলবে)
একা এবং একা - পর্ব এক
একা এবং একা - পর্ব দুই
একা এবং একা - পর্ব তিন
একা এবং একা - পর্ব চার
একা এবং একা - পর্ব পাঁচ
একা এবং একা - পর্ব ছয়
একা এবং একা - পর্ব সাত
একা এবং একা - পর্ব আট
বিষয়: আহসান হাবীব
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: