সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

মায়া : তিয়েন আন্দালিব


প্রকাশিত:
২০ আগস্ট ২০২০ ২২:৪১

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৪২

 

‘বাবু আমারে মারিস না রে, আমি মইরা যামু!’

কান্নার ফাঁকে ফাঁকে চিৎকার করে বললেন মনি বেগম। তাঁর নিজের ছেলে আশিক তাকে ধরে মারধর করা শুরু করেছে। একরকম বাধ্য হয়েই মাকে মারধর করতে হচ্ছে আশিকের। আশিক মাকে কতবার বলেছে যে টাকা চাওয়ার সময় কোন ঝামেলা না করতে। কিন্তু তার মা কি বোঝে সে কথা? প্রতিদিনই টাকা চাওয়ার সময় চিতকার চেঁচামেচি করে। টাকা দিতে চায় না। কিন্তু টাকাটা যে আশিকের ভীষণ দরকার মা কি তা বোঝে না? তার নিজের হাতখরচের টাকা শেষ হয়ে গেলে হটাত যদি গাঁজার টান উঠে তখন তার অবস্থাটা কি হয়? সে আর মানুষ থাকে না। একই সাথে জানোয়ারের মত হিংস্র আর সদ্য জন্মানো শিশুর মত অসহায় হয়ে পড়ে। তখন মায়ের কাছে টাকা চাইলে মা উল্টো রেগে উঠেন। গালি গালাজ করতে থাকেন। আর সেসব শুনে আশিকের মাথাটাও এলোমেলো হয়ে যায়। সে আর নিজের মাঝে থাকে না। মা যদি টাকা না দেয় সে মাকে দুহাত দিয়ে মারা শুরু করে। আসলে ঠিক মারে না।  মায়ের শরীর ধরে জোড়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ‘টাকা দাও টাকা দাও!’ বলে চিৎকার করতে থাকে। আর মা টাকা না দিতে চাইলে আরো জোরে চেপে ধরে ঝাঁকাতে থাকে মায়ের শরীর। এতে করে অজান্তেই কিছু কিল ঘুষি মেরে বসে। মাকে ব্যথা দিচ্ছে এটা ভেবে সে নিজেও কাঁদতে থাকে। নিজের করুন এই অবস্থা কল্পনা করে আশিকের বুক চিরে আর্তনাদ বের হয়ে আসে। কিন্তু কি করবে, মাদক তাকে ছাড়ে না। চাইলেও ছাড়তে পারে না। এমনভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছে হয়ত সারাজীবনেও ছাড়বে না।

আশিক তার মাকে ছেড়ে দিয়ে শিশুর মত কেঁদে উঠে বলল, ‘মা দাও না টাকাটা। না হলে বাঁচব না। তুমি দেখ আমার সারা শরীর কাঁপছে। পাগল হয়ে যাব।‘

মনি বেগম কান্না একটু সামলে বললেন, ‘বাবা একটা দিন ওসব ছাড়া থাকতে চেষ্টা কর। আমার কথা শুনে একটা দিন চেষ্টা কর।‘

আশিকের বুক থেকে হাহাকারের মত কন্ঠ বের হয়ে আসে, ‘পারি না মা, পারি না। জলদি টাকাটা দাও, না হলে পাগল হয়ে যাব’।

মনি বেগমকে দেখে মনে হল পরাজিত বিধ্বস্ত কোন সৈনিক, এখনি মাটিতে লুটিয়ে পড়বেন। নিজের বুক ঠেলে আসা কান্নাটা চেপে কাঁপা হাতে ছেলেকে টাকাটা দিয়ে দিলেন। আশিক টাকাটা পেয়েই এক দৌড়ে বাইরে চলে গেল। আশিক যাওয়ার পর মনি বেগম বুক ফাঁটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কপালে হাত দিয়ে মেঝেতে বসে তিনি কাঁদতে থাকেন। আর একটু পর পর চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ গো! কি এমন পাপ করছিলাম? কোন পাপের শাস্তি দাও?’

আশিক যখন পাগলের মত বাসা থেকে বের হল, তখন তার বড় ভাই মিশুক নিজের রুমে হিরোইন গ্রহণ করছে। মিশুকের হিরোইনটাই বেশি পছন্দ। আর কোন ড্রাগ তাকে এতটা পাগল করা অনুভূতি দিতে পারে না। সে হিরোইনের নেশায় বুদ হয়ে থাকে সারা দিন রাত। ফাঁকে ফাঁকে হালকা পাতলা কিছু খাবার খায়। মাস্টার্স শেষ হয়েছে ওর। রেসাল্ট খুব একটা খারাপ না। তবে সে চাকরী করছে না, খুঁজছেও না।  হিরোইনের এই ভয়ঙ্কর সুন্দর জগত থেকে বের হতেই যে মন চায় না।

মনি বেগম একজন স্কুল টিচার। তিনি প্রতিদিন বিরস মুখে ক্লাশ নিতে যান। মনে কোন আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই। তবু ছাত্র ছাত্রীদের তিনি খুব ভালভাবে পড়ানোর চেষ্টা করেন। এমনিতে খুব নাম করা গনিতের টিচার তিনি। দলে দলে ছাত্র ছাত্রীরা তার কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য যায়। তিনি পরম মমতায় নিজের সন্তানের মত করে তাদের গনিত পরিয়ে যান। তাঁর হাত ধরে কত স্টুডেন্ট গনিতে খুব ভাল রেসাল্ট করেছে, তাঁর চোখের সামনে মানুষের মত মানুষ হয়ে আজ অনেকেই কত বড় চাকরী করছে। আর তিনি নিজের প্রাণের ছেলে দুটোকেই মানুষ করতে পারলেন না। অথচ চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। যথেষ্টই শাসন করেছিলেন। তারপরও চোখের সামনে তার ছেলেগুলো পাড়ার খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে কিভাবে কিভাবে যেন নষ্ট হয়ে গেল। প্রথম প্রথম খুব মারতেন। এতে হিতে বিপরীত হল। ওরা আরো বিগড়ে গেল। আর ওদের বাবা তো কোন মানুষ না, একটা গাছ। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। সংসারের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব পালন করেই খালাস। ছেলেদুটোকে ঠিকমত শাসনই করল না। মানুষটা অবশ্য এমনিতে একটু অসুস্থ। শরীর খুব দুর্বল। আবার হার্টের সমস্যা আছে। হার্টের অসুখ মনি বেগমেরও আছে। আবার বাঁধিয়ে বসেছেন ডায়াবেটিস। হাঁপানিরও রোগ আছে। সারাটা দিন তিনি শুধু তাঁর ছেলেদের নিয়ে টেনশন করেন। টেনশন করতে করতে মাঝে মাঝে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে যান। একবার তো হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল ! কবে না জানি টুপ করে মারা যান। তার বার বারই মনে হয় তার জীবনটা এতটা কষ্টের কেন? আগে থেকেই কি নির্ধারিত ছিল যে তাঁর জীবনটা এমন হবে?

মনি বেগমের স্বামী মুরাদ সাহেব জানেন, তিনি শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল। ছোট থেকেই তার এ অসুখ। কি যে এই অসুখ তা আজও জানা হল না। ইদানিং তিনি মানসিকভাবেও অনেক দুর্বল। নিজের সন্তানদের তিনি মাদক থেকে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না এই কষ্ট তাঁর বুকে কাঁটার মত বিঁধে থাকে সবসময়। তবে যত কষ্টই থাকুক আর যত দুর্বলই হন না কেন, তিনি মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। মহান আল্লাহর কাছে তিনি নিজেকে সঁপে দিতে চান। আল্লাহভক্তি ছাড়া তার জীবনে আর কিই বা আছে? সংসারের কথা মনে হতেই তিনি রীতিমত অসুস্থবোধ করেন। তাঁর প্রিয় সন্তানদের পরিনতির কথা তিনি যতবার ভাবেন ততবারই গোপনে কোন জায়গায় গিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদে আসেন। কাঁদার পরেও যে মনটা একটু হালকা হবে তা না, কাঁটার মত কষ্টটা থেকেই যায়। ছেলেরা মাদকের কাছে এতটাই অসহায় হয়ে পড়েছে যে তাঁকে বাধ্য হয়েই টাকা দিতে হয়। না হলে ওরা পশুর মত আচরণ করে। তিনি আর কত টাকা দিবেন? একজন ইউনিভার্সিটির টিচারের আর কতই বা টাকা থাকে? সব সংসারের খরচেই লেগে যায়। ছেলেদের মাদকের খরচের জন্য একটা জমি পর্যন্ত বেঁচে দিতে হয়েছে তাকে। তবে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। অনেক চেষ্টা।  প্রথমে ছেলেদের ভালভাবে বোঝানো, পরে রিহ্যাবে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। কাজ হয় নি। ছেলেরা কিছুতেই রাজি না। তাঁর স্ত্রীও প্রতিদিন কঠিন যুদ্ধ করত। ছেলেদের বের করে দেবে বাসা থেকে। কোন টাকাই দিবে না। প্রতিটা দিন ঝগড়া, চিৎকার চেঁচামেচি। মুরাদ সাহেব মাঝে মাঝে ভাবেন, পৃথিবীতেই বোধহয় তাঁর নরকের কিছু অংশ দেখা হয়ে গেছে।

মুরাদ সাহেব একদিন মসজিদে ফযরের নামাজ পড়ছিলেন। হটাত তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা হতে লাগল। মনটা কেমন কেমন যেন করতে লাগল। মনে হল, নামাযের মাঝেই তিনি কেঁদে ফেলবেন। নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে নামায শেষ করলেন। তারপর তাঁর কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেলেন। মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু –আলতাফ। একটু চমকে বললেন, ‘আরে আলতাফ!’

আলতাফ সাহেব হেসে উঠে বললেন, ‘হ্যা রে। এদিকে একটা বিয়ের দাওয়াত পড়েছে। তিন চার দিন থাকব।‘

‘থাকবি কোথায়? আমার বাসায় থাক।‘

‘না রে, আমার বিজনেস পার্টনারের এক আত্মীয়ের বিয়ে তো, উনার বাসায়ই থাকতে বলেছেন। ’

‘তোর বিজনেস কেমন চলছে?’

‘খারাপ না। আসলে তোর কাছে লুকাব না। বেশ ভাল চলছে। আমি নিজেই অবাক। সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা।‘

‘তাহলে তো ভাল। তারপর, তোর ছেলেমেয়েদের খবর কি?’

‘মুরাদ ! আমার তো দুই ছেলে, কোন মেয়ে নেই।  ভুলে গেলি? সে যাক, ছেলেরা ভালই আছে। এক ছেলে বুয়েট থেকে পাশ করে এখন ইঞ্জিনিয়ার। আরেকটা কয়েকমাসের মাঝেই ডাক্তারি পাশ করবে। ছেলেদুটো ভালই হয়েছে রে। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। কোন বাজে অভ্যাস পর্যন্ত নেই। সারাক্ষণ ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা। এত ব্যস্ত থাকে ওরা যে যখন হাতের কাছে পাই আর ছাড়ি না। বাপ মা দুই ছেলে নিয়ে জমজমাট আড্ডা দেই। তুইও ভাবী আর বাচ্চাদের নিয়ে চলে আয় না একদিন। ’

মুরাদ সাহেব কেমন যেন কাঁপা স্বরে বললেন, ‘আসব’।

-‘হুম আসিস। মজা হবে। তোর ছেলেদুটোর খবর কি?’

মুরাদ সাহেব কি বলবেন বুঝতে না পেরে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুকের ভেতরটা মনে হচ্ছে ভেঙ্গে চুরে দিচ্ছে কেউ।

আলতাফ সাহেব একটু এগিয়ে এসে বললেন, ‘আরে তোর চোখে পানি কেন? কি হল?’

মুরাদ সাহেব তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে বললেন, ‘মনে হয় গাছ থেকে কিছু একটা চোখে পড়েছে। আলতাফ, তোর কাছে জীবনটার অর্থ কি রে? আমাদের জীবন বলতে আসলে কি বোঝায়?’

আলতাফ সাহেব উদাস হয়ে বললেন, ‘ আসলে জীবন হচ্ছে মায়া। এই যেমন আল্লাহপাক এক বিশাল মায়ার বাঁধনে আমাদের বেঁধে রেখেছেন। ভালবাসা আর মায়ার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে পরিবার। আর সন্তান ও বাবা মার মাঝে যে নিঃসার্থ গভীর মায়া তার তো কোন তুলনাই নেই। এটাই জীবন।’

মুরাদ সাহেব বিড় বিড় করে বলতে থাকেন, ‘হুম মায়া মায়া, সবই মায়া ।’ বলতে বলতে তিনি মাথা ঘুরিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।

আলতাফ সাহেব অস্থিরভাবে তাঁকে ধরে বললেন, ‘কি হল! কি হল!’

মুরাদ সাহেব দুর্বল গলায় বললেন, ‘তেমন কিছু না রে। অনেকক্ষণ ধরে পানি খাই না তো। বড্ড পিপাসা লেগেছে। একটু পানি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। একটু পানি দে রে আমাকে।’      

 

তিয়েন আন্দালিব
লেখক ও সংগঠক
ছবি স্বত্ত্বঃ  আনিসুল কবীর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top