কৃষ্ণছায়া : লিপি নাসরিন
প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:০৯
আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৬:১২
বিরাট দালান বাড়ির কুলুঙ্গি থেকে কুপি বাতি নিয়ে আলেয়া সাবধানে ভিতরের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। উন্মুক্ত রোয়াক পেরিয়ে মাঝের ঘরের সাথে ছোট সিঁড়ির ঘর। ভাঙা হাড়ি- পাতিল থেকে শুরু করে কুড়োর বস্তা,আলো-ধানের বস্তা কী নেই এই সিঁড়ির ঘরে। সে এক গুদাম ঘরের মতো।এ বাড়ির ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কাছে সিঁড়ির ঘরটা যেন ভূতের ঘর! মাঝের ঘর পেরিয়ে সামনে বিরাট দালান।বড় বড় চারটা পিলার আর দুপাশে উঠোনে নামার পথ। এই দালান ঘেষেই বাইরের সিঁড়ি এজন্য মাঝের ঘরটা সবসময় অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। এই মাঝের ঘরটা হলো তিন পরিবারের মালিকানায়। সবাই এটার মালিক তাই ঘরটা প্রায় সময় অগোছালো থাকে। সিঁড়ির ঘরে ছোট একটা জানালা আছে তবে সে জানালা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ্য স্বল্প আলো ঘরটাকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে।
আলেয়া কুপি নিয়ে মাঝের ঘর ডিঙিয়ে সিঁড়ির ঘরে ঢোকে। একটা আলো-ধানের বস্তার দড়ি আলগা করে দিনের বেলা রোদে দেবার জন্য।
তমিজ সর্দার কখন বউয়ের পিছ পিছ নিচে নেমে মাঝের ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে আলেয়া বুঝতে পারেনি।
এই দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই খিটির-মিটির লেগে আছে। তা থাকবেই বা না কেন? আঠারো বছরের এক যুবতীর সাথে যদি পঞ্চাশ বছরের এক পুরুষের সংসার হয় তবে সে সম্পর্ক উত্তপ্ত তেলে পানি ছিটিয়ে দেবার মতোই তো ফুটতে ফুটতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
কালু সর্দারের দ্বিতীয় পক্ষের সেজো ছেলে এই তমিজ সর্দার। বিপত্নীক তমিজ সর্দার আলেয়াকে বিয়ে করে আনে প্রথম বউ মারা যাবার ছমাসের মধ্যে। প্রথম পক্ষের দিক থেকে তমিজ সর্দার ছিল নিঃসন্তান।
আলেয়ার গায়ের রং কালো,সামনের দাঁত হালকা উঁচু হলেও একটা সৌন্দর্যের ছটা আছে। কটিদেশ বরাবর তার ঘোড়ার লেজের মতো গোছা চুল ঝুলে থাকে। সে যখন হাঁটে তখন নিতম্বের এপাশ-ওপাশ চুলগুলো দোল খেয়ে আছড়ে পড়ে। তাই দেখে তমিজ সর্দার এই মধ্যষাটে এসেও রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে লুঙ্গির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে রাখে।
আলেয়া সুযোগ পেলেই এই বুড়ো বরের সাথে তুচ্ছাদি বিষয় নিয়েও চেঁচামেচি শুরু করে আর সেই সাথে নিজের বড় ভাইকে দোষারোপ করে শাপ-শাপান্ত করে। আলেয়ার ধারণা তার বড় ভাই বড় বাড়ি আর জমি-জায়গা দেখে এক বুড়োর সাথে তার বিয়ে দিয়েছে।
যৌথ সংসারে তার মেজো জা আর ছোট জা মিলেও তাকে খুব জ্বালিয়েছে। ঝগড়ার সময় মেজো জা সবসময় তাকে কালো মাগী বলে গালাগাল করে অথচ তার নিজেরও গায়ের রঙ কালো। আলেয়া ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো বলে,
- কী রে আমার হাসা মাগী। আয়নার নিজের চেহারাকান দেখিস না কেন?
তারপর আবার জায়ে জায়ে মিলে সংসারের কাজকর্ম ভাগ করে নেয়।
ছোট জা মেজো জায়ের আত্মীয়, বাপের বাড়ি একজায়গায় সেজন্য দু'জনের মধ্যে ভাব বেশি তাই ছোট জায়ের সাথে মেজো জায়ের কোন ঝগড়া নেই। নুরুল সর্দার - আলেয়ার ছোট দেবর, তার দুই ছেলে রেখে বউ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হবার পর মেজো জা তার আত্মীয় এই ছোটজনকে দেবরের বউ করে আনে। মেজো জা সংসারে মন চাইলে কাজ করে না চাইলে করে না। সংসারে মাতব্বরি করাই তার প্রধান কাজ। ছোটজন সেটি মেনে নিলেও আলেয়া মানতে পারে না আর বিপত্তি তখন ঘটে। তমিজ সর্দার বুঝিয়েও আলেয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার যতো অভিমান, যন্ত্রণা ঝগড়ার সময় যেন মাথা উঁচু করে আলেয়াকে টিটকারি করে আর আলেয়াও তাই হয়ে ওঠে উন্মত্ত।
- আপনি উপরে যান। নেমে আসলেন কেন তুলিরে একা রেখে?
আলেয়া কুপি হাতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে জোড়া ভুরু নাচিয়ে বলে।
- তুমি এতো রাতে নিচে নেমে এলে কেন? হাঁটো উপরে হাঁটো । তমিজ সর্দার কুপির আলোয় বউকে দেখে।
- আমি কাল আলো-ধান রোদি দেবো তাই আইছি। আলেয়া বস্তার মুখ খুলতে খুলতে বলে।
সেতো কাল সকালেও দেখতি পারতে।
তমিজ সর্দার জোয়ান বউকে তাড়িয়ে যেন দোতালায় নিয়ে যেতে চায় যেমন করে সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে গ্রামের মানুষ হাঁস-মুরগি কোটায় উঠতে না চাইলে তাড়িয়ে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।
আলেয়া আর কোন কথা না বলে বস্তার মুখ পুনরায় দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে স্বামীকে পিছে রেখে আগে আগে চলে।
তমিজ সর্দারের মতো মানুষদের ভালোবাসা জৈবিক চাহিদার সমার্থক। তারা বউকে ভালোবাসা মানে খাওয়া - পরা আর রাত নামতেই শয্যায় বউকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী পাওয়া এটিই বোঝে।
আলেয়া দোতালায় উঠে তার চুল আঁচড়ে বেণী করে নেয়।
- তোমারে না বলিছি কতোদিন রাতে যেন চুল আঁচড়াবা না, রাতে চুল আঁচড়ালে কলঙ্কিনী হতি হয়।
আলেয়ার সেসব কথায় কোন ভ্রূক্ষেপ কখনো নেই। সে আপন মনে চুলে বেণী করে হারিকেনের অস্পষ্ট আলোয় দেয়ালে লাগানো বড় আয়নায় নিজেকে দেখে।
আলেয়া বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তেই তমিজ সর্দার বউয়ের স্তনের উপর হাত রাখে। অমনি যেন রুদ্ধ রক্ত প্রবাহ বাঁধন ঢিলা পেয়েই ফিনকি দিয়ে ছুটে চলে।
- আপনার মেজ ভাবি সারাদিন আমার পিছনে লাগে,আপনি তো কিছু বলেন না। আপনার আস্পর্ধা পেয়েই আমার এতো গালিগালাজ করে। আমি হয়ে আপনার মতো বুড়োর ঘর করে গ্যালাম। বিয়ে করার দরকার কী ছেলো? ভাইদের সংসারে থাকতেন।
দিনের বেলা মেজ জায়ের সাথে ঝগড়া করে সারাদিন আলেয়া রাগে ফুঁসেছে। স্বামীকে রেখেছে সেই রাগের ঝলসানো তাওয়ায়। এখন তা যেন একেবারে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো।
তমিজ সর্দার শুধু সশব্দে 'ধ্যাত' বলে আবারও স্ত্রীর ব্লাউজ উপরে তোলার চেষ্টা করে।
আলেয়া এবার তার থেকে পঁচিশ বছরের বড় স্বামীর মুখে স্তনের বোঁটা ঠেসে ধরে। তাতে যেন তমিজ সর্দারের দম একেবারে বন্ধ হবার উপক্রম হয়। তমিজ সর্দার ঘোত ঘোত শব্দ করে। আলেয়া তমিজ সর্দারের শিশ্ন ধরে খেলতে খেলতে তাকে রাগিয়ে তোলে,একসময় তমিজ সর্দারের আশ্রয় হয় আলেয়ার ভিতর। কামোদ্দীপ্ত আলেয়ার অম্লমধুর কথায় তমিজ সর্দারের ঘোর লাগে কিন্তু দুএকবার খেলেই তমিজ সর্দার নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আলেয়া তখন বিষধর গোখরোর মতো ফণা তুলে স্বামীকে নিজের বুকের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই স্বামীর উপর চড়ে বসে। ঘর বানানোর কাদা যেমন পা দিয়ে চটকে চটকে নরম করে দেয়ালের উপযোগী করে গড়ে তোলে আলেয়াও তেমনি নিজেকে তমিজ সর্দারের শরীরের সাথে চেপে ধরে ক্রমাগত চটকে নরম কাদার মতো হয়ে উঠতে উঠতে উত্তেজনায় খামচে ধরে তমিজ সর্দারের পিঠের মাংসপেশি।
তিন বছরের মেয়েটার ঘুম ভেঙে যায় আলেয়া মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিতে নিতে ভুলে যায় দিনরাতের সব কাব্য।
আলেয়া সবেমাত্র আলাদা সংসার পেয়েছে। এই নিজের সংসার পাওয়াটাও তার জন্য কম বিড়ম্বনা ছিলো না। তমিজ সর্দার রয়ে যায় ভাইদের সংসারে আর আলেয়াকে হাড়ি-পাতিল চাল-ডাল আর একজন কাজের লোক দিয়ে আলাদা করে দেয় জা, ভাসুর-দেবর মিলে। আলেয়া সেদিন কিছু বলেনি শুধু স্বামীর আচরণে বিস্ময়ে ঠাণ্ডা হয়ে ছিলো। স্বামীকে অন্য সংসারে রেখে আলেয়ার সংসার। তমিজ সর্দার একবারও কোন কথা বলেনি, এমন কি বউ এর আলাদা সংসারেও আসতে চায়নি। তার কারণ ছিলো। তমিজ সর্দারের কোন সন্তানাদি ছিলো না, তার জমি -জায়গা এতোদিন অন্য দু'ভাইয়ের ভোগ দখলে ছিলো। এখন আলেয়ার কোলে সন্তান আসা শুরু হয়েছে তাই তমিজ সর্দার চায় না ভাইদের এই মুহূর্তে রাগাতে তাহলে জমি-জায়গা সব নিজেদের নামে ওরা করে নেবে। কিন্তু সে কথা আলেয়াকে আদৌ বলে না। অল্প বয়সি মেয়ে আলেয়া, বুদ্ধিও কম তমিজ সর্দার অন্ততঃ তাই ভাবে।
- আপনি কোন হিসেবে ভাইদের সংসারে ছেলেন আমারে আলাদা করে দিয়ে?
তমিজ সর্দার কোন কথা না বলে বউয়ের মুখের দিকে চোখ কপালে তোলার ভাব করে তাকিয়ে থাকে। প্রায় দুই মাস পর নিজের বউয়ের সংসারের ফিরে আসে তমিজ সর্দার।
- আমার ভাতার তো তোরাই নিলি তা আবার ফেরত দিলি কেন? আমার লাগবে না তোরা নে।
জায়ে জায়ে ঝগড়ার সময় আলেয়া সেসব বলতে একবিন্দু ছাড় দেয় না।
- মেজো বুড়ি সেদিন আমারে মারলো আপনি কিচ্ছু বললেন না তালি সগুলি যা বলে তাই ঠিক?
- সগুলি কী বলে ?
- বলে আপনার মেজো ভাবির ছোট মেয়ে আপনার জন্মিত।
এই কথা শুনে তমিজ সর্দার পায়ের জুতা খুলে আলেয়াকে দুবার আঘাত করতেই আলেয়ার মাথা দুলতে থাকে। ও জ্ঞান হারায়। সবাই বলে আলেয়ার ঘাড়ে নাকি জ্বিন আছে । এর আগেও কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছিল তখন সবাই মিলে ওর নাকের কাছে কাঁচা হলুদ ধরে, জুতা শুকায়। কাঁচা হলুদের গন্ধ বা জুতার গন্ধ নাকি জ্বিনেরা সহ্য করতে পারে না। এভাবে কিছুক্ষণ পর আলেয়ার জ্ঞান ফেরে।
তমিজ সর্দার এই বউয়ের যন্ত্রণায় অস্থির থাকে। সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার থেকে শুরু করে কোন কিছুই তার পছন্দ হয়না। তারমধ্যে আলেয়ার মা বেড়াতে এলে আরো সমস্যায় পড়ে তমিজ সর্দার।
- এই সংসারে এই বুড়োর সাথে তোমরা আমারে বিয়ে দিলে। একবারও ভাবলে না।
আলেয়ার মা তজবি গোনে। মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে,
- তোমার একটা বাচ্চা হয়িছে মা, এসব কথা আর বলো না। আল্লাহ্ র ইচ্ছা ছেলো তাই হয়িছে। সবর করো। পরকালে ভালো হবে।
- আমার আর পরকাল!! ইহকালই হলো না বলে আলেয়া ডুকরে কেঁদে উঠে।
- তুমি আর বড় ভাই মিলে আমার জীবনডারে নষ্ট করে দেছো। আলেয়ার মা চুপ করে থাকে।
ওর ঘাড়ে আসলে জ্বিন আছে নাহলে বাচ্চা হবার পরও এমন করে কেন!!
অনুজ্জ্বল আলোতে মেয়ের মুখটা ভালো করে দেখে জোরে জোরে কালিমা পড়ে।
আলেয়ার এ সংসারের গল্পটা তার স্বামী তমিজ সর্দারের বা তার মেজো জায়ের সাথে কথা বা ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে গড়িয়ে চললেও আরো একজন মানুষ সবকিছু নীরবে দেখে। মাঝে মধ্যেই আলেয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
- আপনি শান্ত হোন, শান্ত হোন। উত্তেজিত হবেন না, উনাদের কথার উত্তর দেবেন না।
আলেয়া নিধু বাবুর কথায় কখনো চুপ থাকে কখনো অপ্রয়োজনীয় ভেবে কথার গতিবেগ বাড়িয়ে নেয়।সে বেগের তরঙ্গাঘাতে হাড়ি-পাতিল ঝনঝন করে ওঠে। নিধু বাবু তবুও আলেয়াকে উপদেশ দেয়। নিধু বাবু এ বাড়ির ছেলে-মেয়েদের পড়ায় আর নিজে পড়ে। তিনি একটি প্রশিক্ষণে এসেছেন জেলা সদরে। একবছরের জন্য এ বাড়িতেই লজিং আছেন। তিন সংসারে নিধু বাবুর তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা। আলেয়ার ভাগে পড়েছে রাতের বেলা যদিও তার মেয়ে এখনো পড়ার বয়সি হয়ে ওঠেনি কিন্তু ভাগের পর্বে তাকেও সামিল হতে হয়েছে। আলেয়া রাতের বেলায় খাবারের দায়িত্ব নিতে চায়নি কারণ নিধু বাবু ছেলে-মেয়েদের পড়িয়ে নিজে পড়ে রাত দশটার আগে খেতে আসে না,সেজন্য অন্য দুই জা রাতের বেলা নিধু বাবুর দায়িত্ব নেয়নি কারণ রাত ন'টার মধ্যে ছেলেপুলে খাইয়ে তারা ঘরে ঢোকে, অগত্যা আলেয়ার উপায় ছিলো না। তমিজ সর্দারও রাজি হলো।
- একবেলায় তো খেতে দিবি তমিজ সর্দার খেতে খেতে বলেছিলো। মাঝে মাঝে আলেয়াকে তুই বলে সম্বোধন করে।
- আপনি আমাকে তুই করে বলেন কেন? এতো বড় বাড়ি আপনাদের, শুনিছি আপনার বাবা গাতিদার ছেলো। ইংরেজ আমলে জমির ম্যাপে নাকি আপনাদের বাড়ি চেহ্নত করা ছেলো, এতো নামী বংশ আপনাদের তা বউরে তুই বলেন কেন? আলেয়া যেন তুই শুনে ফোঁস করে ওঠে।
তমিজ সর্দার বাটি থেকে থালায় তরকারি ঢেলে নেয় কোন উত্তর না দিয়ে।
প্রথম কয়েকদিন আলেয়া বিরক্ত হলেও ধীরে ধীরে সয়ে যায় সবকিছু। কোন কোনদিন তমিজ সর্দার নিধু বাবুর সাথে একসাথে খেতে বসে আবার কোনদিন নিধু বাবু একা। আলেয়া পিঁড়েতে বসে নিধু বাবুর জন্য একটা ছোট মাদুর পেতে দেয়। তাঁর গলার তুলসী মালার দিকে চেয়ে থাকে।
-আপনার বাড়িতে কেডা কেডা আছে মাস্টার বাবু? কখনো ল্যাম্পের অনুজ্জ্বল আলোয় আলেয়া প্রশ্ন করে।
- মা-বাবা আছে। দাদা বউদিরা আছে। তবে আমার সংসার মা আর বাবাকে নিয়ে।
আলেয়া আরো কী প্রশ্ন করতে গিয়ে থেমে যায়। নিধু বাবু ছোট ছোট কথা বলে। আলেয়া কখনো শোনে কখনো বাটিতে তরকারি বাড়ে। মাছটা, তরকারিটা আর একটু নিতে সাধে।
বিরাট দালান বাড়িতে তমিজ সর্দার দোতলার ঘরে জেগে আছে কিনা বোঝা যায় না। দোতলার ঘরের অন্দরমুখি জানালাটা বন্ধ করা। সন্ধ্যে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। শুধু বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই শোনা যায় না। কেমন একটা ঘোর লাগা রাত। আলেয়া বৃষ্টি পতনের শব্দে কান পাতে।
- আপনাকে এই বাড়িতে বিয়ে দিয়েছিল কে?
নিধু বাবুর কথায় আলেয়া হাঁটুর উপর থেকে মুখ তোলে
- আমার আব্বা মারা যায় আমি ছোট থাকতি।বড় ভাই অভিভাবক। এ বাড়ির সহায় সম্পত্তিতে তার চোখে ধাঁধা লাগে। তাইতো একটা...
নিধু বাবুর হাত ভাতের থালায় ক্ষণিকের জন্য থামে।
- আপনি এঁদের সাথে ঝগড়া করবেন না, এঁরা খুব নিম্নরুচির মানুষ।আপনিও তাঁদের মতো হয়ে যাবেন না।
আলেয়া নিধু বাবুর শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা খুব পছন্দ করে। এমনিভাবে একটা বঞ্চিত হৃদয় কখন যেন নিধু বাবুর হৃদয়ের কাছাকাছি এসে পড়ে, পরিণত হয় আলেয়ার সুখ-দুঃখের আলাপচারিতার সঙ্গী। নিধু বাবু চাকরির প্রশিক্ষণ থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায় ।এসেই ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়াতে বসে। আলেয়া এ-ছলে সে-ছলে দেখে যায়। দু'একটা কথাও বলে কখনো। অধীর অপেক্ষায় থাকে কখন রাত নামবে আর নিধু বাবুর সারাদিনের গল্প শুনবে ভাত বেড়ে খাওয়াতে খাওয়াতে। ব্যাপারটা তমিজ সর্দারের চোখ এড়ায়না।
- তুই ঐ মাস্টারের সাথে কী এত গল্প করিস রে?
আলেয়া এবার কাঁদা ঠেলে বাইন মাছের মতো ফুঁসে ওঠে না; টাকি মাছের নিঃশব্দে চরে বেড়ানোর মতো করে বলে,
- গল্প আবার কখন করলাম।
আজকাল তমিজ সর্দার প্রায় নিধু বাবুর খাওয়া অব্দি বসে থাকে তারপর বউকে নিয়ে উপরে ওঠে। কী যেন মনে মনে ভেবে নিয়েছে তমিজ সর্দার।
নিধু বাবুর থাকার ব্যবস্থা উত্তরদিকের সারি করে যে ক'খানা টালির ঘর আছে সেগুলোর একটিতে। ঘরে আসবাব বলতে তেমন কিছু না। একটা তক্তপোশে পাতলা একখানি তোষক বিছানো। পাশে একটা টেবিলে একখানা ধর্মগ্রন্থ আর রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বইয়ের সাথে তার প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, ছোট আলনায় একটা জামা, একটা লুঙ্গি আর একটি গেঞ্জি অবহেলায় পড়ে আছে। এ ঘরের চাবিটি আলেয়ার রান্নাঘরের তাকের উপর ফেলানো থাকে। মাঝে মধ্যে কাজের লোক নিয়ে ঘরটা খুলে পরিষ্কার করে আবার তালা দিয়ে চাবিটা তাকের উপর ফেলে রাখে। নিধু বাবু ঐ তাক থেকেই চাবি নিয়ে দরজা খোলে আবার বাইরে যাবার সময় নির্দিষ্ট জায়গায় চাবিটা রেখে যায়।
নিধু বাবুর টেবিলে বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখে। আলেয়াকে কষ্ট করে ঘর পরিষ্কার করতে বারণ করেছে নিধু বাবু তবু সে প্রকাশ্যে বা অগোচরে এ ঘরে আসে।
আগুনে যদি বাতাস লাগে তবে সে আগুন বাতাসের পথ ধরে এগিয়ে চলে আর তার চলার পথের সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলে। যুবতী আলেয়ার ভিতরের প্রজ্জ্বলিত আগুন এক সুঠাম যুবকের নিঃশ্বাসের গতিতে বেগ পেয়ে তা যেন তমিজ সর্দারের পৌঢ়ত্বের বাঁধাকে ডিঙিয়ে সংসারকে ছাই করতে উদ্যত হয়।
সেদিন একটু আগেই রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছিল নিধু বাবু , আলেয়া দোতলায় উঠে গিয়েছে স্বামীর সাথে। কুপিটা হাতে নিয়ে আবার নিচে নামতে চাইলে তমিজ সর্দার বলে,
- আবার নিচে যাচ্ছো কেন?
- আপনি শুয়ে পড়েন, মাস্টারকে ক্ষীর দিতে মনে নেই আমি ক্ষীরের থালাটা দিয়ে আসি।
- সকালবেলা দিও এখন আর যেও না।
- সকালবেলা পর্যন্ত থাকপে না নষ্ট হয়ে যাবে। আমি দিয়ে আসতিছি। আলেয়া আর কিছু না শুনেই ভিতরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘরের তালা খুলে ক্ষীরের থালা নিয়ে নিধু বাবুর ঘরের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দেয়। তমিজ সর্দার ভিতরের জানালায় দাঁড়িয়ে সে শব্দ কান পেতে শোনে, সময় গোণে, কতক্ষণ সময় লাগে আলেয়ার ক্ষীরের থালা দিয়ে আসতে! তমিজ সর্দার অধৈর্য হয়ে ওঠে। ওরে, কোনে গেলে? বলে জানালায় দাঁড়িয়ে জোরে ডাকে।
সে রাতের দ্বি-প্রহরে আলেয়া আবার নিচে নেমে এসেছিল। নিধু বাবুর দরজায় ছোট্ট টোকা পড়তেই অন্ধকারের দরজা খুলে যায়। এমনি কতোরাত নিধু বাবুর অন্ধকার ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল দুজন নর-নারীর গভীর তপ্ত শ্বাসে তমিজ সর্দার সে খবর রাখতো না। নিধু বাবুর উষ্ণ আঙুল থেকে প্রখর সূর্যতাপ আলেয়ার শীতার্ত দেহে পরিবাহিত হয়েছে কতোদিন, আলেয়া সে উষ্ণতা মেখেছে বিশাল বরফখণ্ডের উপর ভোরের রশ্মির প্রতিফলিত আলোর মতো আর পুরানো তক্তপোষের কচাৎ কচাৎ শব্দের সাথে তাদের সঙ্গমছন্দ মিলে অন্ধকারে রামধনু উঠেছিল সেই পড়ো ঘরের দেয়ালে। আলেয়ার নরম শরীরটা নিধু বাবুর দেহের নিচে আদর প্রিয় বিড়ালের মতো গুটিশুটি মেরে একটা প্রচণ্ড পতনের অপেক্ষায় থেকেছে আর নিধু বাবু সে অপেক্ষার প্রতিদান দিয়েছে সুদে-আসলে তারপর শান্ত হয়ে ফিরে গেছে শেষরাতের নিভু নিভু ভূতুড়ে জ্যোৎস্নার ভিতর দিয়ে দোতলায় অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা তমিজ সর্দারের কাছে।
আলেয়া দ্বিতীয়বার মা হতে যাচ্ছে। প্রথমবারের নিঃসন্তান তমিজ সর্দার ভীষণ খুশি। এবার সে আশা করছে তার বংশের বাতি আসবে। ছেলের বাবা হবে। তারও তিনমাস পর নিধু বাবুর ট্রেনিং শেষ হয়ে যায়, এবার নিধু মাস্টারের নিজের বাড়িতে ফেরার পালা।
- এ সময়ে বেশি বেশি পানি খাবেন, শাক-সব্জি বেশি খাবেন, ফল খাবেন আর উত্তেজিত হয়ে কারো সাথে ঝগড়া করবেন না। বাচ্চার ক্ষতি হবে। রাতে খেতে বসে কথাগুলো আলেয়াকে বলেন নিধু বাবু। আলেয়া হাত দু'খানা শাড়ির মধ্যে পুরে নিয়ে নিধু বাবুর তেলতেলে মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ এভাবে কখনো বলেনি তাকে এসব কথা। চোখ ভরে ওঠে নোনাজলে। সংসারে কারো জন্যে কষ্ট বুঝি কেউ পেতে পারে না তার জন্যে সে কষ্টকেও তার আত্মস্থ করতে হয়।হঠাৎ কুপি বাতি নিভে যায়। আলেয়া ধারেকাছে কোথাও রাখা দেয়াশলাই খুঁজতে হাত বাড়ায়। সে হাত অন্ধকারে দু'টি হাত টেনে নেয় তার ঠোঁটের কাছে। আলেয়ার ঠোঁটে তুলে দেয় দ্রাক্ষাশর্করার অমৃত। মাতাল মহুয়ার গন্ধ এসে মিশে যায় কালোমেয়ের ঠোঁটে। তমিজ সর্দারের গলাখাকারির শব্দ শোনা যায়। আলেয়া নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে দেয়াশলাই ঠুকে আগুন জ্বালায়। সে আলোতে দেখতে পায় তার পায়ের কাছে দুটো লাল টকটকে আপেল।
নিধু বাবু তাঁর আপন ব্যক্তিত্বে এ বাড়ির সবার কাছে ভীষণ আপনজন ছিলেন তাই তাঁর চলে যাবার দিন সবাই খুব মন খারাপ করলো। ছেলে-মেয়ে গুলো সকাল থেকে নিধু বাবুর কাছ থেকে নড়লো না। নিধু বাবুর চোখ মাঝে মাঝে ছলছল করে উঠছিল। এই এক বছরে এ বাড়ির সবাই তাকে আপন করে নিয়েছিল।তাঁর প্রতি কেউ বিরক্ত হয়নি কখনো।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি দোতালায় আলেয়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শুধু বললেন, আপনার মঙ্গল হোক। খোকা বা খুকী হলে আমাকে খবর দিতে ভুলবেন না কিন্তু।
আলেয়া কোন কথা বলেনি শুধু নিধু মাস্টার সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর সেই দরজায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো। নিধু বাবু একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি।
তমিজ সর্দারের মনের আশা পূরণ হয়েছে । পুত্রের পিতা এবার কিন্তু বিপত্তি দেখা দিলো পুত্র বড় হবার সাথে সাথে। তার গাত্রবর্ণ থেকে মুখের অবয়বে অন্য কারো চেহারার ছাপ যেন স্পষ্টতর হতে থাকলো।কানাঘুষো বাড়তে লাগলো আর তমিজ সর্দারের কপালের ভাঁজও গভীর থেকে গভীরতর হলো।
ছেলে কার মতো দেখতে হয়েছে সে কথা শুধু শব্দহীন তরঙ্গে বাতাসে ভেসে গেলো গ্রামময়।
বিষয়: লিপি নাসরিন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: