বোসপাড়ার মহাশ্বেতা : রঞ্জনা রায়


প্রকাশিত:
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:০৪

আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ২২:২৪

ছবিঃ সিস্টার নিবেদিতা ও রঞ্জনা রায়

 

'মানুষের সত্যরূপ, চিত্ রূপ যে কি, তাহা যে তাঁহাকে জানিয়েছে সে দেখিয়াছে। মানুষের আন্তরিক সত্তা সর্বপ্রকার স্থূল আবরণকে একেবারে মিথ্যা করিয়া দিয়া কিরূপ অপ্রতিহত তেজে প্রকাশ পাইতে পারে তাহা দেখিতে পাওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা। ভগিনী নিবেদিতার মধ্যে মানুষের সেই অপরাহত মাহাত্ম্যকে সম্মুখে প্রত্যক্ষ করিয়া আমরা ধন্য হইয়াছি।'

(ভগিনী নিবেদিতা, পরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলী, নবম খণ্ড)

 

শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাবে এক আধ্যাত্মিক ভাব তরঙ্গ ভারত তথা সমগ্র পৃথিবীতে নতুন শক্তি, নতুন জীবনের উদ্বোধন ঘটিয়েছে। সেই দিব্যশক্তি, দিব্যজীবনের তড়িৎ স্পর্শ ভারতের মেয়েদের জীবনে এনে কিভাবে সেই আধ্যাত্মিকতার অমর অগ্নি তাদের প্রাণে জ্বালিয়ে দেয়া যায়, যাতে তারা নিজেরাই একেকটি মশালের মতো জ্বলে উঠে লক্ষ লক্ষ নারীর মধ্যে সেই আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে- তা ছিল স্বামী বিবেকানন্দের একটি বড় চিন্তা। পরিব্রাজক অবস্থা থেকে দেশের সর্বত্র তিনি এক শক্তিময়ী 'মহীয়সী' নারীর খোঁজ করে চলেছিলেন, যিনি তাঁর কাজের গুরু দায়িত্ব নিতে পারবেন। আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারিণী সেই নারী হবেন বিদুষী, ধীময়ী ও মনীষাসম্পন্না। পবিত্রতা, গুরুর প্রতি জ্বলন্ত বিশ্বাস ও ভক্তি এই তিনটি গুণ অবশ্যই থাকতে হবে। তিনি প্রায়ই বলতেন 'আমি পবিত্রতা বড় ভালোবাসি'। কিন্তু ভারতবর্ষে তখন এইরূপ  ত্যাগব্রতধারিণী দেশসেবিকা পাওয়া কঠিন ছিল সুতরাং স্বামীজি তাঁর পাশ্চাত্য শিষ্যগণের মধ্যেই উপযুক্ত কর্মীর সন্ধান করেছিলেন।

মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল ১৮৯৩ সালের নভেম্বর মাসে ওয়েস্ট এন্ডের একটি ড্রইং রুমে, বক্তৃতা স্থলে সাক্ষাৎ পেলেন তার জীবন নির্ধারক গুরু স্বামী বিবেকানন্দের।

 

ক্রম পরিচয়ের মাধ্যমে স্বামীজি তাঁর ওজস্বিতা, বাগ্মিতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সততা অনুধাবন করলেন। ভারতবর্ষের জন্য বিবেকানন্দের হৃদয় উদ্বেলিত। এখানকার মেয়েদের শিক্ষার জন্য একজন নারীর প্রয়োজন।

ঠাকুরবাড়ির স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা ভারতী পত্রিকার সম্পাদিকা সরলা ঘোষালকে স্বামীজি এই কাজে আহ্বান করেছিলেন এবং তিনি প্রথমে সম্মতও হয়েছিলেন। কিন্তু পরে নানা কারণে পিছিয়ে যান এবং যেটি স্বামীজীর পক্ষে একটি হতাশার কারণ ছিল। তাই ১৮৯৭ সালে ২৯শে জুলাই মার্গারেটকে ভারতে আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখলেন সেই ঐতিহাসিক চিঠি-

"তোমাকে অকপটভাবে বলিতেছি, এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে ভারতবর্ষের কাজে তোমার অশেষ সাফল্য লাভ হইবে। ভারতের জন্য বিশেষতঃ ভারতের নারী সমাজের জন্য, পুরুষ অপেক্ষা নারীর- একজন প্রকৃত সিংহিনীর প্রয়োজন। ভারতবর্ষ এখনও মহীয়সী নারীর জন্মদান করিতে পারিতেছে না, তাই অন্য জাতি হইতে তাহাকে ধার করিতে হইবে। তোমার শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, অসীম প্রীতি, দৃঢ়তা এবং সর্বোপরি তোমার ধমনীতে প্রবাহিত কেল্টিক রক্তই তোমাকে সর্বদা সেই উপযুক্ত নারীরূপে গঠন করিয়াছে।" গুরুর আদেশ শিরোধার্য। ১৮৯৮সালের ২৮শে জানুয়ারি কলকাতা বন্দরে এসে থামল একটি জাহাজ। স্বামী বিবেকানন্দ প্রিয় শিষ্যা মার্গারেটকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং তাঁর থাকার স্থান হল কলকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চলের একটি হোটেলে।

যার উপর নারী শিক্ষার ভার স্বামীজি অর্পণ করতে চেয়েছিলেন তাকে উপযুক্ত ভাবে প্রস্তুত করার ভারও তাকে নিতে হয়েছিল, শিক্ষাতত্ত্ব কি তা মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল যথেষ্টই জানতেন। কিন্তু ওই শিক্ষানীতিকে ভারতীয় খাতে প্রবাহিত করতে হলে ভারতবর্ষ আসলে কি তাও জানা দরকার। তাই স্বামীজি প্রথমেই মার্গারেট প্রভৃতি অনুরাগীদের নিয়ে ভারতবর্ষের নানাদিকে পরিভ্রমণ করেছিলেন। ভারতবর্ষের রূপরেখা দেখার পর মার্গারেটকে জানতে হবে ভারতীয় নারীকে। ভারতীয় নারীর আদর্শ কি? পাশ্চাত্যে স্বামীজি অক্লান্ত কন্ঠে ভারতের নারী আদর্শের কথা বলেছেন: "ভারতে জননীই আদর্শনারী, মাতৃভাব ইহার প্রথম ও শেষ কথা। ...ভারতে ঈশ্বরকে 'মা' বলিয়া সম্মোধন করা হয়।" স্বামীজি মার্গারেটকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত করলেন। নাম দিলেন নিবেদিতা। এবার স্বামীজি নিবেদিতাকে নিয়ে এলেন শ্রী শ্রী মা সারদা দেবীর কাছে। যিনি পাতানো মা নন, যিনি গুরুপত্নী মা নন, যিনি একজন সত্যিকারের মা আর সেই মা সারদা সাদরে গ্রহণ করলেন তার এই বিদেশিনী কন্যাকে তার স্নেহের খুকিকে। আর কন্যা পেলেন প্রিয় 'মাতাদেবী'কে। ১৮৯৮সালের ১৭ মার্চ শ্রী শ্রী সারদা মায়ের সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনটিকে নিবেদিতা তার ডায়রিতে উল্লেখ করলে 'day of days' বলে আর বললেন 'আমার ধারণায় বর্তমান পৃথিবীর মহত্তমা নারী' (Letters of Sister Nivedita. volume -2) এবার নিবেদিতার থাকার জায়গা হল ১০/২ বোসপাড়া লেনে যে বাড়িতে তখন সারদা মা বসবাস করছিলেন। এই বোসপাড়া লেনই হবে নিবেদিতার কর্মক্ষেত্র। ১৬ নং ও১৭ নং বাড়ি দুটি নিয়ে তার স্কুল তৈরি হবে।

 

শ্রী শ্রী সারদা মা পরে বাগবাজারে উদ্বোধন বাড়ি তৈরি হলে সেখানে  বসবাস শুরু করেন। কিন্তু মা ও মেয়ের এই প্রেমময় মধুর সম্পর্ক অটুট ছিল সেই ১৯১১সাল, নিবেদিতার মৃত্যু পর্যন্ত। তৎকালীন সমস্ত সামাজিক প্রথা ও জাতপাতের বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করে শ্রী শ্রী মা সারদা তার ছোট্ট আদরের খুকিকে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে দিয়েছিলেন মধুমাখা আশ্রয়। সহস্রদ্বীপোদ্যানে স্বামী বিবেকানন্দ যাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ক্রিস্টিন গ্রিনস্টাইডেল- এক জার্মান কন্যা। স্বামীজীর দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন 'she is pure, pure in soul, I knew  it, I felt it'. পরম পবিত্র এই জার্মান কন্যাটি তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন স্বামীজীর কাজে। তিনিও এলেন এই বোস পাড়ায় নিবেদিতার সহযোগী হয়ে, তাঁর শিক্ষাব্রতে হলেন প্রধান সহায়ক। ক্রিস্টিন ছিলেন  একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের কিন্তু কাজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ক্রিস্টিনের পরিচালনায় নিবেদিতার স্কুল সুচারুরূপে একটি পূর্ণতা লাভ করে। তারা দুজনেই ছিলেন সমবয়সী। ২০১৮ সালে দুজনেরই সার্ধশতবর্ষ উদযাপিত হয়। স্বামীজি তাঁর এই পুষ্পসম কন্যা তথা শিষ্যাকে উল্লেখ করে লিখলেন সেই বিখ্যাত কবিতা 'To an Early Violet' স্কুলের ছাত্রীদের কাছে নিবেদিতা ছিলেন 'সান দিদি' আর ক্রিস্টিন ছিলেন 'মুন দিদি'। নারীদের শিক্ষা দানের মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠা ও স্বাবলম্বী করে তোলাও নিবেদিতা এবং ক্রিস্টিনের একটি উদ্দেশ্য ছিল। তাই ক্রিস্টিন নিলেন ছাত্রীদের সেলাই শেখানোর ভার। গৃহবধূ ও বিধবাদের শিক্ষার ব্যাপারেও তারা যত্নশীল হলেন। এই ভাবে এগিয়ে চলল নারীশিক্ষার কাজ। স্বামীজি নিবেদিতাকে আশীর্বাদ করে পাঠালেন যে কবিতা তার দুটি ছত্র উল্লেখ করছি

'ভবিষ্যৎ ভারতের সন্তানের তরে

 সেবিকা বান্ধবী মাতা তুমি একাধারে।'

 

প্রসঙ্গত জানাই, আমার মাতামহ স্বর্গীয় শ্রী অজিত কুমার ঘোষ একবার নিবেদিতার সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করেছিলেন।

 

আমার দাদু কিশোর বয়সে পড়াশোনার জন্য উদ্বোধন সংলগ্ন রামকৃষ্ণ লেনে বসবাস করতেন। একবার তিনি ঘুরতে ঘুরতে বাগবাজারে মায়ের বাড়ি উপস্থিত হন। তখন সেখানে শ্রী শ্রী মা সারদাদেবী ছিলেন। দাদু শ্রী শ্রী মায়ের পায়ে পদ্ম ফুল দিয়ে পূজা করেন। তিনি তারপর থেকে প্রায়ই মায়ের বাড়ি যেতেন।

 

শ্রীমত্ স্বামী সারদানন্দ মহারাজ দাদুকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন সারদানন্দ মহারাজ ও নিবেদিতার কথোপকথনকালে দাদু সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

 

দাদু বলেছিলেন শ্বেত গাউন পরিহিতা নিবেদিত ছিলেন অপূর্ব জ্যোতির্ময়ী। যেন তার চারপাশে এক জ্যোতি বিরাজ করছে এমন মনে হয়েছিল। শ্রী শ্রী মায়ের পাদস্পর্শে ধন্য দাদুর সেই হাতখানির স্নেহস্পর্শ জীবনে অনেকবারই পেয়েছি নিজেকে ধন্য মনে হয়।

 

আমি নিবেদিতা স্কুলের ছাত্রী নই, কিন্তু অনেকবারই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মায়ের সঙ্গে ওই স্কুলে গিয়েছি। আমার ছোটবেলার গৃহশিক্ষিকা অর্চনাদি যিনি পরে সারদা মঠের সন্ন্যাসিনী হয়েছিলেন, তিনিও নিবেদিতা স্কুলে বসবাস করতেন।

 

শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে নিবেদিতার রূপটির বর্ণনা দিয়ে এই লেখা শেষ করছি, "সুন্দরী, সুন্দরী তোমরা কাকে বল জানি না। আমার কাছে সেই একটা আদর্শ হয়ে আছে। কাদম্বরীর মহাশ্বেতার বর্ণনা। "শিল্পীর মনে হয়েছে সেই চন্দ্রমণি দিয়ে গড়া রূপটি মূর্তিমতী হয়ে উঠেছিল নিবেদিতার মধ্যে, তিনিই বোস পাড়ার মহাশ্বেতা।

রঞ্জনা রায় 
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top