একান্ত ব্যক্তিগত! : আহসান হাবীব


প্রকাশিত:
১৩ জানুয়ারী ২০২১ ২৩:০৮

আপডেট:
১৪ জানুয়ারী ২০২১ ০০:২৬

 

ব্যাপারটা লিখে রাখা দরকার। মানে আমি করোনার কথা বলছিলাম আরকি। আমি যে করোনা আক্রান্ত হলাম তারপর কি কি হল...এইসব। এমন না যে আমার এই লেখা থেকে সবাই শিক্ষা নিবে, তারপরও ‘যৎপরনং নাস্তি’ ( এই সংস্কৃতির অর্থ কি আমার জানা নেই। আমার এক প্রজ্ঞাবান বন্ধু মাঝে মধ্যে বলত। আমিও বললাম একটু...)

করোনা কালে বাসা থেকে খুব একটা বের হতাম না। একবারেই না। উন্মাদের অফিসে যাই না। ভার্সিটিতে ক্লাশ নিতেও যেতে হয় না, সব অনলাইনে (আমি একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে গ্রাফিক নভেল পড়াই, এডজাঙ্ক ফ্যাকাল্টি হিসেবে) । কিন্তু একদিন একজন এল দেখা করতে খুবই জরুরী। দুই একটা কথা বলে শুধু শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে যাবে। সে এল আমি নিচে গেলাম গ্যারেজেই বসার ব্যবস্থা আছে। সে দু একটা কথা বলল। এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেল। তবে খুব সম্ভব যাওয়ার সময় শুভেচ্ছা স্বরুপ করোনার মিলিয়ন খানেক ভাইরাস দিয়ে গেল। কারণ সে বলছিল তার শরীরটা ভাল না, গা ব্যাথা জ্বর জ্বর, এক পর্যায়ে খুক খুক করে কাশলোও কয়েকবার। 

যাহোক দুদিন পর আমারও একই অবস্থা জ্বর জ্বর খুক খুক কাশি গা ব্যথা। সবাই সন্দেহ করল নির্ঘাৎ করোনা। আমাকে নিয়েই সবার ভয় কারণ আমার ওপেন হার্ট সার্জারী হয়েছে , তার মানে সার্জিক্যাল হার্ট, ডায়বেটিস আছে, প্রেসার আছে...বয়স ৬৩। করোনা আমাকে ধরলে নাকি আমার খবর আছে। কিন্তু সত্যি সত্যি খবর হয়ে গেল। টেস্ট করানোর পর দেখা গেল ‘করোনা পজিটিভ’। হায় হায় এখন কি হবে? আমার মেয়ে এষার যখন করোনা হল তখন একই বাসায় থেকে আমার করোনা হল না। আর এখন গ্যারেজে বসে সামান্য শুভেচ্ছায় করোনা হয়ে গেল!  

কাউকে জানালাম না তারপরও দেখি ফোন আসতে শুরু করল। ফোনের নমুনা কয়েকটা দেই ...

- আপনার করোনা হয়েছে আপনি এখনো বাসায়? আপনি পাগল না উন্মাদ?

( মনে মনে বলি সেই ১৯৭৮ সালের মে মাস থেকে উন্মাদ)

- বাঁচতে চাইলে এখনি হাসপাতালে এডমিট হন। করোনা শরীরে  ঢুকলে একটা না একটা অঙ্গ ড্যামেজ করে দিয়ে যায়। আপনার হার্টতো ড্যামেজই এখন কিডনি না হয় ফুস ফুস যাবে...জলদি হাসপাতাল...

- এ যাত্রায় যদি রক্ষা পানও কিন্তু ঠিক দশ দিন পর সেকেন্ড এ্যাটাকে আপনি শেষ। বয়স্কদের এরকম অনেক ঘটনা হয়েছে। আমার এক মামা...

- (এক ফাজিল ফ্রেন্ড) দোস তোর নাকি করোনা হইছে? মরার আগে একটা মিসড কল দিস

তবে সবচে চমৎকার ফোনটা এল এক তরুণ খাদ্য রসিক লেখকের কাছ থেকে

- বস ট্রিটমেন্ট শুরুর আগে আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে ফোনটা প্লিজ অফ করেন। একুশ দিন পর সেকেন্ড টেস্টের পর ওপেন কইরেন। 

আমি তাই করলাম। 

 

যাহোক আমার কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে থাকলো। পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছে যেই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কভিড নাইনটিন ভাইরাস  তারা এখন আমার শরীরের ভিতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আমি শরীরের ভিতরে নানান ‘মিথস্ক্রিয়া’ টের পেতে লাগলাম যেন। দ্রুতই একটা ঘরে বন্দি হয়ে গেলাম। শুরু হল ট্রিটমেন্ট। আমার স্ত্রী ঠান্ডা মাথার মানুষ। সে দু তিনজন বড় ডাক্তারে সঙ্গে কথা বলল, তার মধ্যে একজন তার কাজিন। এদিকে বাসার সবার মুখে মাস্ক। নিজেকে এক অস্পৃশ্য মানব সন্তান বলে বোধ হতে লাগল। এর মধ্যে রক্ত নিতে এল একজন, এক ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে। তাকে দেখে আমি ভিমড়ি খেলাম। প্রথমে মনে হল। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে নেমে  এসেছেন স্বয়ং নীল আর্মস্ট্রং না হলেও এডউইন অলড্রিন।  গায়ে সাদা পিপিই মুখে মাস্কতো আছেই  চোখে বড় গ্লাস তার উপর রাউন্ড সেপ মাউস সিল্ড। যাহোক  আমাকে জানানো হল ইনি চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে নেমে আসা কোনো নভোচারী নন। ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে আমার রক্ত নিতে এসেছেন। যেহেতু আমি করোনা পেশেন্ট তাই এই সাবধানতা। খুবই স্বাভাবিক। সে  চার-পাঁচটা সিরিঞ্জ ভরে আমার রক্তের গোডাউন স্টক মোটামোটি খালি করে দিয়ে  চলে গেল বলে মনে হল আমার।  

 

এখন রক্তের রেজাল্ট আনতে কে যাবে? ডায়গনস্টিক সেন্টারের ভিড়ের মধ্যে?  উন্মাদের সিনিয়র কার্টুনিস্ট আরিফকে পাওয়া গেল। সে আয়ারল্যান্ডে ফিল্ড পুলিশ ছিল । অনেক দুঃসাহসী কাজ করে এসেছে তার জন্য এটা কোনো ব্যাপার না। সে আমার সবচে কাছে থাকে। কাজে অকাজে প্রায়ই তাকে স্মরণ করি (সুস্থ্য হওয়ার পর শুনি সে সপরিবারে উত্তরা চলে গেছে। আমার  অত্যাচারেই চলে গেল কিনা কে জানে!)

 

যাহোক  জানা গেল আমার  রক্তের প্লাটিলেট অনেক নেমে গেছে। যেহেতু আমি হার্টের রিস্ক পেশেন্ট এ জন্য অতিরিক্ত দশটা ব্লাড থিনার ইনজেকশন দেয়া হল। প্রতিদিন ইনজেকশন নিতে হবে নাভীতে ( মানে নাভীর চারপাশে) সেটা কিভাবে দিবে বা দিতে হবে এর জন্য বাসায় এসে দেওয়ার কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি কার্টুনিস্ট  মিশুকে জানালাম কাউকে ধরে আনতে। সে কাছাকাছিই থাকে (তবে আরিফের থেকে একটু দূরে) । তার চুল গোঁফের যে রাসপুটিন টাইপ চেহারা যে কেউ ভয় পাবে সে ঠিক কাউকে না কাউকে ঠিক ধরে আনতে পারবে। অন্তত নাভীতে ইনজেকশন দেয়াটা একবার দেখিয়ে দিলে আমার মেয়েই দিতে পারবে  (সে করোনা সারভাইবার)। অতি দ্রুতই মিশু তার এক ডাক্তার বন্ধুকে ধরে নিয়ে এল। ছেলেটি চমৎকার, বলল ‘কোন ব্যাপার না। ঘরে বন্দি হয়ে আপনার সময় কাটে না বারান্দায় বসে সিগারেট খান, সমস্যা কি?’  আমার স্ত্রী হতভম্ব! আমি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি! মনে মনে বলি ‘বাছা তোমার মুখে ফুল চন্দন পরুক!’

 

প্রতিদিন জ্বর থাকে, ডাক্তার সন্দেহ করল টাইফয়েডও হয়েছে আমার।  ফ্রি ফ্রি কিছু পেতে ভালই লাগে। কিন্তু করোনার সাথে এই ফ্রি ফ্রি টাইফয়েড হজম করা আমার জন্য সত্যি একটু কষ্টকর হল। ট্রিটমেন্ট আরো বেড়ে গেল। মুড়ি-মুড়কির মত ট্যাবলেট খেতে হচ্ছে প্রতিদিন। 

ওদিকে ডাক্তার স্ট্রিকলি বলে দিয়েছে আঙুলের অক্সিমিটার  ৯২ এর নিচে নামলেই ছুটতে হবে হসপিটালে। এ আরেক টেনশন। ৯৪ থেকে ৯৭  দৌড়াদৌড়ি করে অক্সিজেনের লেভেল। শুধু বুড়ো আঙুলে দিলেই  এক ধাক্কায় ৯৯ আমার মনে হয় মিঃ থাম্ব আমাকে নিশ্চয়ই বুড়া আঙুল দেখায়! 

 

যাহোক তারপর ১৮ দিন পর একদিন  আবার টেস্ট করা হল। যে টেস্ট করতে এসেছে। সে মনে হল নাক দিয়ে কটন বাড ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার ব্রেনও খানিকটা নিয়ে এসেছে ( কারণ এরপর থেকে অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছি) । পরদিনই রেজাল্ট পেলাম। ‘করোনা নেগেটিভ’ । যাক এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়া গেল, হাসপাতালে না গিয়েই। যখন ভাবছি পুরোই সুস্থ্য আমি, তখন একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি সবাই আমাকে দেখে আৎকে উঠছে! ঘটনা কি? আয়নায় দেখি দুই চোখের সাদা অংশ টকটকে লাল। ‘টেস্ট দ্যা ড অফ ড্রাকুলার’  নাম  ভূমিকায় নামা যায় এমন অবস্থা আমার।  একেই বোধহয় বলে রক্তচক্ষু তাকানো। যাহোক ডাক্তারের সাথে কথা বলে আবার কিছু নতুন অষুধ-পত্র। তবে না দুদিন পরেই  ড্রাকুলার নাম  ভূমিকা থেকে স্বাভাবিক মানুষ জীবনে ফিরে এলাম। মনে হল 

 পৃথিবীটা সত্যি  সুন্দর! আরো কিছুদিন শুধু কার্টুন-কমিকস আঁকার জন্য বেঁচে থাকা যায়, এ ধরনের একান্ত ব্যক্তিগত লেখার জন্য অবশ্যই নয়! আমার ধারনা তরুণ কার্টুনিস্টরা আমার সাথে একমত না হলেও সহমত প্রকাশ করবে! 

 

লেখক: আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top