নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব চৌদ্দ) : শাহান আরা জাকির পারুল
প্রকাশিত:
২৪ মার্চ ২০২১ ১৮:৪২
আপডেট:
১৩ মার্চ ২০২৫ ০৭:২০
সুমন চলে যাবার পর দু মাস পর বাবা মা ও ভাইয়া ভাবি একদিন বাদ মাগরিব এসেছিলেন,আমাকে তাদের কাছে কিছুদিন রাখার জন্যে! সুমনই মা বাবাকে ফোন করে বলেছিলো!আমি কিছু জানতাম ও না ! জানিস নীলু আমার নম্র ভদ্র নিরীহ বাবা মাকে অনেক অপমানসুচক কথা শুনিয়ে দিলেন আমার শাশুড়ি!সবার সামনেই কটাক্ষ করলেন আমায়!আমি কেন তাদের নিয়ে যেতে বলেছি! আমার ভীষণভাবে গা গুলিয়ে বমি এলো!দৌড়ে বাথরুম এ যেতে গিয়ে পরে গেলাম! তেমন চোট পাইনি!ভাইয়া দৌড়ে এসে কোলে তুলে নিলেন! বমি করে ফেললাম! ভাইয়ার সমস্ত কাপড় চোপড় নষ্ট হয়ে গেলো! আমার শাশুড়ি চিৎকার করে বললেন, ছি ছি এটা কি করলে বৌমা! এবার আর আমার ভাইয়া চুপ থাকলেন না!
- আপনার মত এমন অমানবিক মানুষতো আমরা নই! আমাদের চার ভাইয়ের একমাত্র ছোট্ট আদরের বোনটিকে কোলে পিঠে ঘাড়ে নিয়ে অনেক আদরে মানুষ করেছি! ছোটবেলায় কাদামাটি দিয়ে খেলতে খেলতে কত জামা কাপড় নষ্ট করেছে সে!আজ না হয় বমিই করেছে!তাতে ঘেন্নার কি আছে!শরীরে একই রক্ত আমাদের! ঘেন্নাতো করবেন আপনি!
কথা শেষ না হতেই ভাবীও ভাইয়ার সাথে সাথে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললেন-----
এ সময়তো মেয়েরা বাবার বাড়িতেই থাকে! আমিতো বাবুকে তিন মাসের করে তবেই এসেছি শশুর বাড়ি! কই! আমাকেতো আমার শশুর বাবা কিংবা শাশুড়ি মা কোনোদিনও এ নিয়ে কিছু বলেন নাই! এ কেমন রীতি আপনাদের!
সেদিন বুঝেছিলাম গভীরভাবে, ভাইবোন এর আত্মিক আর হৃদ্দিক সম্পর্ক কত গভীর হতে পারে! ভাই বোন এর ভালোবাসা এক্কেবারেই অন্যরকম ভালোবাসা!যা শুধু অনুভবই কইরা যায় ঘটনা প্রবাহে!আমি ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম সেই শিশুকালের মতোই!আর মনে ভাবলাম, মেজো ভাইয়া ভাবী ও ছোট ভাইয়া আসেনি ভাগ্যিস!
এদিকে আমার শাশুড়ি এসব দেখে রেগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন!হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, বোনকে নিয়ে ভাইয়ের কত আদিখ্যেতা! কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কিছুই বলতে পারলেন না! কারণ, আমার বিচক্ষণ শশুর বাবা রক্তচক্ষে তার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছিলেন কটমট করে! ভাইয়া ভাবীর প্রতিবাদি কথায় তিনি খুশিই হয়েছিলেন বোঝা গেলো! তাছাড়া তিনি আমায় খুব পছন্দ করতেন ও ভালোবাসতেন!
মা আর বাবা দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন!
হঠাৎ এই অসময়ে সুমন এর ফোন এলো!আমার শশুর বাবা ফোনটি আমার হাতে দিলেন! আমি এখনো এ বাড়ি কেন আছি, জানতে চাইলো সুমন! আমি কোন কথাই বলতে পারলামনা!
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চললাম!
শশুর বাবাকে ফোন দিতে বললেন!
কথা শেষ হলে বাবা আমার কাছে এসে বললেন, -----মা' মনি, সবাই খাওয়া দাওয়া করে মা বাবার কাছ থেকে ঘুরে এসো কিছুদিন! কেমন!
তোমার শাশুড়ি একটা পাগল মানুষ মা! কিছু মনে কোরোনা মাগো!আমি তোমার পাশে আছি মা!
বিশ্বাস কর নীলু, আমি একটা শশুর পেয়েছিলাম ঠিক বাবার মতোই! তাঁর কথা শুনে মুহূর্তে আমার মনটা ভরে গেলো খুশিতে !
ইতিমধ্যে সেদিন দেখলাম ঐটুকু সময়ের মধ্যে এশার আজানের পর পরই নানান পদের মাছ, মাংস, সবজি মিষ্টান্ন দিয়ে টেবিল ভর্তি খাবার! বাড়ির এমন গরম পরিবেশকে শীতল করতে আমার অতি বুদ্ধিমান চতুর দুই জা ও ভাসুর দুজন মিলে এ আয়োজন করেছেন!খুব আপ্যায়ন করতে লাগলেন সবাইকে! কিছু খাবার দেখে আমার খুব লোভ হচ্ছিলো!
খেতে পারলামনা বমির ভয়ে! ইচ্ছে হচ্ছিলো জা'কে বলি, আমার জন্যে একটু খাবার দিয়ে দিতে! বলতে পারলামনা লজ্জায় ও অনুশোচনায়!
এমন ব্যবহারে কেউই তেমন কিছু খেতে পারলেন না! মনে হলো সবাই যেন আরো লজ্জা বোধ করছেন! জা'দের সাথে সাথে আমিও এটা ওটা সবার প্লেটে দিতে চাইলাম! ভাইয়া বাধা দিলেন !
কোনরকম সৌজন্যমূলক খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই আমাকে নিয়ে চলে এলো!
আসার সময় দেখলাম আমার জা দুজন খুব গলগোলে আহ্লাদিত!শাশুড়ি মাকে সালাম করলাম! কিছু বললেন না!ভাবলাম, নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন! কিন্তু গাড়িতে উঠতে উঠতেই স্পষ্ট কানে এলো-----যাচ্ছ যাও মেয়ে! এ বাড়িতে আর আসতে হবেনা তোমার! একটা হিল্লে আমি করেই ছাড়বো!
সবাই গাড়ি থেকে শুনে ফেললেন কথাগুলো!এতো সময়ের জমে থাকা বাকরুদ্ধ কথার তীব্র যন্ত্রনায় ডুকরে কেঁদে উঠলেন মা! পাশের সিট এ বসা বাবা, ঝাপসা চোখে মা'র মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন!
গাড়ি এগিয়ে চললো আমাদের বাড়ির দিকে! সুমনদের বাড়ি থেকে ঘন্টা দুয়েকের দূরত্ব আমাদের বাড়িটি! যেতে যেতে একটা বিশাল লেকমতো ঝিল পরে! মানুষের গড়া লেক! দুই পাড়ে সারি সারি নানাজাতের গাছ! পাখিদের কিচিরমিচির এই রাতেও শোনা যায়! এখনো এলাকার লোকজন লেকপাড়ে বসে গল্প করছে! মামা ভ্যান গাড়িতে চটপটি ল, ফুচকা নিয়ে ঘুরছে!
হঠাৎ মনে হোল আমার বমিভাব এখন আর নেই তেমন! গাড়ির সব জানালাগুলো হালকা খুলে রেখেছেন ভাইয়া! চাঁদনী রাত! ফাঁকা জায়গায় সবকিছু অন্যরকম দেখাচ্ছে! ঝির ঝির বাতাস!লেকপাড়ের কিছু সুগন্ধি ফুলের মিষ্টি ঘ্রান!ভলোলাগার মতো কেমন মাদকতায় ভরা যেন!
ঠিক এ সময়েই ভাইয়া হটাৎ গাড়ি থামিয়ে বললেন,সব্বাই নামো! আনন্দে হৈ হৈ করে উঠলাম আমি আর ভাবি! আমার এমন চেঞ্জই বুঝি দেখতে চেয়েছিলেন সব্বাই!দেখলাম বাবা আর মা ও অনেক খুশি হয়েছেন!
আমাকে জড়িয়ে ধরে, 'সোনা আমার' বলে মা আমার কপালে চুমু দিলেন! এতক্ষনে বুঝি মা তার সবটুকু আদর আমাকে ঢেলে দিয়ে সারা জীবনের জন্যে আবার ও আমাকে ঋণী ও স্মৃতি করে রেখে দিলেন! বাবা ও আমাকে খুশি দেখে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন! সুমন চলে যাবার পর আজ যেন আমি প্রথম অন্যরকম আনন্দের ছোয়া পেলাম!
আমার খুব কান্না পেলো!
এতদিনের জমানো কান্নার ঝড় বয়ে গেলো দুচোখে!
খুব কাঁদলাম!
কেউ কোন বাধা দিলোনা!
ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল সব্বাই!
কান্না শেষ হলে একসাথে সব্বাই লেকপাড়ের বেঞ্চ এ বসলাম!
এতো রাত, তবু পাখিরা ওড়াউড়ি করছে এদিক সেদিক! পানিতে ছোট ছোট ঢেউ ও উঠছে ! তাই দেখে ভাইয়া একটা পাথর ছুড়ে দিল পানিতে! কি অপূর্ব ধেয়ে খেলা! গোল হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া!
অপূর্ব ! ছোটবেলা নানু বাড়ি ও দাদু বাড়ির পুকুরে এমন কত ঢিল ছুড়ে থেকে করেছি! ভাইয়া নানু বাড়ির কেয়ার টেকার আব্দুল মামার সাথে বসে বসে পুকুর ঘটে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে বসতো! একদিন বড়শিতে একটি মাছ ঠোকর দিয়েছে কি ,অমনি আমি রক্ত ঢিল মারলাম!মাছটি পালিয়ে গেলো!
আর যাবে কোথায় !
কি মারটাই না সেদিন মেরেছিলো ভাইয়া আমাকে!
পরে বাজার থেকে যে কত্তরকম খেলনা, খাবার দাবার এনে আমাকে কাছে টেনে কত আদর করেছিলো ভাইয়া!
লেকপাড়ে বসে আজ কত কথাই যে মনে পড়ছে!
- এই যে আপুমনি, ভাইয়া খালামনি, কিছু লইবেন না! অনেক মজার ঝালমুড়ি, চানাচুর, বাদাম, চানা ভাজা! ইট্টু কইরা মুখে লন আর চাবাইতে চাবাইতে প্রকৃতির স্বাদ লন!
- কে কি খাবে নিতে পারো!
ভাইয়া সবাইকে বললেন!
বাইরের জিনিষ বেশি না খাওয়াই ভালো! শুধু গরিব মামাকে খুশি করার জন্য চীনাবাদাম কেনা হলো বেশি বেশি!সব মিলিয়ে দাম হোলো মাত্র পঞ্চাশ টাকা!
ভাইয়া আরো একশত মিলিয়ে দেড়শো টাকা দিলেন! আর আমাদের দিকে চেয়ে বললেন-----বখশিস দিলাম ! বুঝলি রিনি! ফাড়া কেটে যাবে! সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম বাবা ও মামাকে আরো দেড়শত টাকা দিলেন!
মামাতো হা করে তাকিয়ে রইলেন! আমরাও!
ভাইয়াকে বললাম, কি ব্যাপার, তোমরা এতো দান খয়ৱাত শুরু করলে যে !
ভাইয়া বললেন -----
ছোট সময় দাদুকে দেখতাম হেঁটে যেতে যেতে রাস্তায় গরিব যাকেই পেতেন, খুচরা টাকা পয়সা বিলাতেন! একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম দাদুকে ------ও দাদু ওদেরকে এতো টাকা পয়সা বিলাও কেন!
দাদু বলেছিলেন ------ এ সব হলো আমাদের ফাড়া কাটার আমলনামা! বুঝেছো দাদু ! মৃত্যুর পর এই ছোট ছোট দান খয়রাত আমাদের অনেক খারাপ কাজের অভিশাপ থেকে রক্ষা করবে! এগুলোই আমাদের রক্ষাকবচ ও সৎ আমলনামা!
জানিস, সেই থেকে দাদুর এই মহৎ কাজকে আমি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি ও পালন করে যাচ্ছি!
বাবাও বললেন -------ঠিক একইভাবে আমিও তোমার দাদুর এই মহৎ কাজটা পালন করে যাচ্ছি বাবা! আমি জানতামই না তুমি এটা পালন করছো!সবারই এরকম কিছু ছোটখাট মহৎ কাজ করা উচিত ! দেখো, তোমাদের এই সামান্য টাকা কটা পেয়ে মামা এতেই কত খুশি!তার চোখে ফুটে উঠেছে আনন্দের আভা! এইটুকু বাদাম বিক্রি করে মামা সে কি খুশি!তার মুখের এই হাসিটাই হোল আমাদের অনেক বড় পাওয়া! ওর অন্তরের নিখাদ ভালোবাসা আর দোয়া!
মামা, সব্বাইকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে চলে গেলেন!
ততক্ষনে আমাদের ও মনের গুমোট ভাব কেটে গেছে অনেকখানি!
ভাইয়া গাড়িতে স্টার্ট দিলেন!
চলবে
শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক
বিষয়: শাহান আরা জাকির পারুল
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: