গোলাপের রঙ লাল : আফরোজা অদিতি
প্রকাশিত:
৩১ মার্চ ২০২১ ২৩:১৫
আপডেট:
১ এপ্রিল ২০২১ ২১:১৩

প্রতিদিনের মত শুতে যাবার আগে পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে অফিসের ব্যাগের ভেতর থেকে ছড়ার বইটা বের করে সুরীতি। বইটি বের করতেই ছিটকে পড়ে কলম। অচেনা কলম। কলমটা কার? কে ব্যাগে রেখে দিলো এই কলম? ভাবনায় পেয়ে বসে ওকে। শুধু আজ নয়; সাতদিন ধরে লক্ষ্য করছে ওর ব্যাগে কে যেন ফুল রাখছে! ফুলগুলো একই মাপের, একই রঙের। হলুদ গোলাপ। এই কয়েকদিন ব্যাগে ফুল ছিল বলেই সুরীতি অবাক হলেও পাত্তা দেয়নি। আজ পাত্তা না দিয়ে পারলো না। কার কলম, কার? এই কলম ব্যাগে কি করে এলো? এসব ভাবনাতে পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না। মন বিষন্ন হয়ে যায় ওর।
সুরীতি চাকরি করে স্কুলে। কয়েকটা সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত। কবি-কথা সাহিত্যিক। অনেকে বলে খুব ভাল কবিতা লেখে। তবে সুরীতির নিজের কাছে ভালো লাগে না। নিজের লেখাগুলো ওর মনে হয় কিছুই হয়নি। যা লিখতে চায় তা আজও লিখতে পারেনি। ওর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল। এখন তো ভুলে গেছে, ছোট বেলায় নজরুল-রবীন্দ্রনাথের অনেক গান কবিতা মুখস্থ ছিল ওর। এখন বোধ হয় দু’চার লাইনের বেশি কোন কবিতাই আবৃত্তি করতে পারবে না। সুরীতি মনে মনে রবীন্দ্রনাথ আউড়ে যায়- ‘আমি ভিক্ষে করে ফিরতে ছিলেম গাঁয়ের পথে পথে, তুমি তখন চলে ছিলে তোমার স্বর্ণ রথে’- এরপর হাজার বার মনে করতে চেষ্টা করে এক লাইনও মনে করতে পারলো না। কী যে হয়েছে! কিছুই মনে থাকছে না। তবে কি ওর বয়স হয়ে যাচ্ছে!
বয়স হচ্ছে বৈকি। তা না হলে এই কলম কোথা থেকে এলো ও বুঝতে পারছে না কেন? নাকি ভুলে কারো কলম তুলে নিয়ে এসেছে? ছি ছি ছি! তুমি চোর হয়ে যাচ্ছো সুরীতি! নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিলো, তিরস্কার করলো। ওর মনটা ধীরে ধীরে বিষণ্ণ হয়ে গেল। বিষণ্ণতা কাটাতে ছড়ার বইটা খুলে বসে। ছড়া পড়তে যাবে এমনি সময় পাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে।
‘ঐ বই নয়, ঐ কবিতা নয়, পড় রবীন্দ্রনাথ।’
‘কে, কে আপনি?’ চমকে ওঠে সুরীতি। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না। আবারও প্রশ্ন করে, ‘কে.... কে আপনি? কোথায় আপনি?’
‘আমি শষ্প।’
‘শষ্প! এ আবার কেমন নাম! মানে জানেন?’
‘হ্যাঁ, ঘাস।’ নির্বিকার কণ্ঠ।
‘আপনি এখানে কেন? সামনে আসুন।’
‘আমি তো তোমার সামনেই।’
‘আমার সামনে?’ সুরীতি এ পাশ ওপাশ তাকায়, সামনে পেছনে কাউকে দেখতে না পেয়ে বলে, ‘মিথ্যা বলছেন আপনি। সামনে আসুন।’
‘আমি তো সামনেই আছি। আমাকে দেখার জন্য মন তৈরি হলে তবেই তো দেখতে পাবে তার আগে নয়।’
ওর কথা শুনে সুরীতির রাগ হলো যা কখনও হয় না। শব্দ করে বই বন্ধ করে ধপাস কর বিছানায় শুয়ে পড়লো।
‘রাগ করো না আমার ওপর, রাগ করে কোন লাভ নেই।’
সুরীতি কথা বলে না। সুরীতিকে চুপ করে থাকতে দেখে একটু ইতস্তত করে অদৃশ্য কণ্ঠ বলে, একটা কথা বলবো, রাগ করো না। সুরীতি তবুও কথা বলে না।
‘দেখ, কাল রাস্তায় বের হতে সাবধান। বিপদ হবে।’
‘বিপদ হলে হবে। তোমার তো কিছু না। তোমার কী? আমি তোমার কে? তুমি আমার কে?’ একটানা আবোল তাবোল এসব কথা বলে যায় সুরীতি।
‘ঠিক আছে।’ কান্নাভেজা শোনাল অদৃশ্য কণ্ঠ।
পরদিন সুরীতির স্কুল বন্ধ। একটি কবিতা পাঠের আসর আছে শাহবাগে। সুরীতি ভাবছে ওখানে যাবার আগে বেইলী রোড হয়ে যাবে। নাটকের একটি টিকিট কিনবে আর সাগর পাবলিশার্সে কোন নতুন বই এসেছে কিনা দেখবে। ভাল বই পেলে কিনেও নেবে। বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নেয় সুরীতি। বেইলী রোড, শান্তিনগরের মোড় কিছুটা সামনে। ওর রিকশা চলছে। হঠাৎ একটা ট্রাক। দ্রæতগতিতে ছুটে আসতে দেখলো, তারপর বিকট শব্দ। শব্দ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলো একটা সুদৃশ্য বাগানের ভিতর বসে আছে। নাম না জানা সব ফুলের গন্ধ। বাগানে হরেক রকম গাছ। পাতাগুলো এতো বেশি সবুজ যে চোখ আটকে থাকে। সুরীতির মন খুব খুশি হয়ে যায়।
একবার এ ফুলের কাছে যাচ্ছে আর একবার ও ফুলের কাছে। গাছের পাতাগুলো ছুঁয়ে দেখছে। ফুলগুলোকে চুমো খাচ্ছে। গুনগুন করছে- ‘ফুলের বনে যার কাছে যাই তারেই লাগে ভালো।’
‘খুব সুন্দর।’ সুরীতি হঠাৎ কথা শুনতে পেয়ে ফিরে দেখে সুঠাম সুন্দর সুপুরুষ একজন ওর সামনে দাঁড়িয়ে।
‘কে আপনি?’
‘আমি শষ্প। এই বাগানে থাকি।’
‘এই বাগানে?’
‘হ্যাঁ, আমি না আসলে এই বাগানে ফুল ফুটে না, পাখিও গান গায় না। পাতারা সবুজ থাকে না, হলুদ হয়ে যায়।’
‘ওমা তাই!’ সুরীতি বিস্মিত। ওর মনে পড়ে না শষ্প নামটা আগে একবার শুনেছে, নামটা ওর পরিচিত।
‘চলো হাঁটি।’ বলল শষ্প।
ওরা হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটলো আর হাঁটলো। হাঁটতে হাঁটতে বাগানের শেষ প্রান্তে সুন্দর পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। সুরীতি অবাক হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় তাকিয়ে থাকে। পাহাড়ের গায়ে সুন্দর বাড়ি; বাড়িটির মাথায় সোনালি রঙের প্রদীপ সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে, মনে হচ্ছে সোনার প্রদীপ জ্বলছে।
‘আমি ঐ বাড়িটায় যাব। ওটা কার বাড়ি?’
‘ওটা আমারই বাড়ি। তবে তুমি যেতে পারবে না।’
‘না না আমি যাবো।’ জেদী কণ্ঠ সুরীতির।
‘না, ওখানে এখন যাওয়া যাবে না। সূর্য ডোবার আগেই ওখানে পৌঁছুতে হয়। আর তুমি তা পারবে না।’
‘না আমি যাবোই যাবো। পারবো, পারবো’। ছোট মেয়ের মত আব্দার করে সুরীতি। শষ্প বারবার নিষেধ করে কিন্তু সুরীতির জিদের কাছে হার মানে শষ্প। ওরা পাহাড়ের ওপর উঠছে। কিছুটা ওঠার পর সুরীতি আর উঠতে পারে না। পা পিছলে যাচ্ছে ওর বারবার। শষ্প ওর হাত ধরে রেখেছে তবুও ক্লান্তিতে হাঁটতে পারছে না।
‘একটু বসি।’
‘না না। সূর্য ডুবে যাবে এখনি। সূর্য ডুবে গেলে মাঝপথে থামা যাবে না।’
‘মাঝপথে থামা যাবে না?’
‘না। সূর্য ডুবে গেলে হয় ঘরের ভেতর থাকতে হবে নয়তো পাহাড়ের নিচে।’ ওরা আবার উঠছে। উঠতে পারছে না সুরীতি। তবুও উঠছে। একবার বসছে আবার উঠছে।
‘আর পারছি না।’
‘পারতেই হবে তোমাকে। এসো।’ হাত ধরে জোরে টান দেয় শষ্প। সুরীতি এই টান সামলাতে পারে না। শাড়িতে পা জড়িয়ে ছিটকে পড়ে যায়। সুরীতি চিৎকার করে ওঠে। কিছুটা সময় পরে চোখ মেলে দেখে চারিদিকে সাদার ছড়াছড়ি আর ডেটল ওষুধের গন্ধ। সুরীতি বুঝতে পারে এটা হাসপাতাল। কিন্তু ও এখানে কেন? লাফ দিয়ে উঠে বসে।
‘না না উঠো না, শুয়ে থাকো। কঠিনে নরমে মেশানো একটা বাহুর আলিঙ্গন অনুভব করে সুরীতি। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না।
‘কে কে তুমি? আমি কোথায়?’
‘তুমি হাসপাতালে। দুদিন আগে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো।’
‘অ্যাকসিডেন্ট!’
‘হ্যাঁ, তবে এখন ভাল আছো। তুমি চুপ করে থাক। এখনি ডাক্তার আসবে।’ বলে অদৃশ্য কণ্ঠ।
‘কে তুমি! দেখা দাও।’ অনুনয় করে সুরীতি।
‘এভাবে বলো না। তুমি দেখতে চাইলেও তো দেখতে পাবে না আমাকে। কিছুটা সময়ের ভেতর দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে তবেই দেখতে পাবে।’
‘আমি এসব জানি না, জানি না, জানি না।’
‘এতো জেদ করে না সুরীতি। এই নাও।’
সুরীতি চোখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় ওর দিকে শূন্য থেকে ভেসে আসছে প্রথম দিনের মতো একটি গোলাপ। কিন্তু গোলাপের রঙ হলুদ নয়, লাল। সুরীতি অবাক বিস্ময়ে গোলাপটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আফরোজা অদিতি
কবি ও কথা সাহিত্যিক
বিষয়: আফরোজা অদিতি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: