নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব বিশ) : শাহান আরা জাকির পারুল
প্রকাশিত:
২৩ জুন ২০২১ ১৯:৪৩
আপডেট:
২৩ জুন ২০২১ ১৯:৪৬
বিছানায় শুয়ে জানালার গ্রিল এর ফাঁক দিয়ে নীল পাহাড়ের দিকে কতক্ষন তাকিয়েছিল মনে নেই নীলিমার। কটা বাজে এখন তাও জানতে মন চায়না। বুঝতে পারে এখন মাঝ রাতই হবে হয়তো।
এপাশ ওপাশ করে বিছানায় গড়াগড়ি করে। মাঝে মাঝেই এমন হয় তার। আজকাল একটু বেশিই হচ্ছে এমন। একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর আসতেই চায়না ঘুম। সারা ঘর পায়চারি করতে করতে একসময় ভোরের আলো ফুটে ওঠে।
রাতুল চলে যাবার পর থেকে ডায়বেটিক, প্রেসার, ডিপরেসান সব যেন পাল্লা দিয়ে শরীরের মধ্যে হাডুডু খেলছে দিনরাত।
চিত হয়ে দুপাশে হাত মেলে দিয়ে শুয়ে থাকে।
মনে মনে আওড়ায় নানা কথা। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, এই হাত আমার বড়ই পবিত্র। এই হাত দিয়ে কুপিয়ে মেরেছি ভয়ঙ্কর এক নর পিশাচকে। কি বীভৎসই না ছিল সেই কালরাত্রি। সেই দৃশ্য মনে পড়তেই দাপিয়ে ওঠে হাত দুটো তার। হাত দুটো সেদিন প্রতিবাদি হলেও এরপর আর নিজের সম্ভ্রম, লজ্জাকে রক্ষা করতে পারেনি এই হাত।
তড়িৎ উঠে বসে বিছানায়। ভোর হতে এখনো অনেক বাকি।
মাথাটা ঘুরছে বো বো করে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। বর্ষাকাল এখন। বাইরে ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে। আম, লিচু, কাঁঠালের সময় এখন। দারুন ফল পছন্দ নীলিমার। ফ্রিজ থেকে একটা পাকা আম কেটে খেয়ে ডিপ্রেসান এর ট্যাবলেট টা খেয়ে, আবার শুয়ে পড়ে। হাত দুটি খুব ঘামছে কেন আজ নীলিমার। জীবনের শেষ বেলায় এসে কেন আজ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে যাচ্ছে তার।
ও পাশের রুমে নিতু ঘুমুচ্ছে আজ নাক ডাকিয়ে।
নিতু আসার পর থেকে ওর জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাগুলো কোথায় যেন মিলে যাচ্ছে তার জীবনের অলি গলির সাথে।
হাত দুটি তার আরও সক্রিয় হয়। অস্থিরতা বেড়ে যায় ক্রমান্বয়ে। উথলে ওঠে চরম ঢেউয়ের নদীটি।
ভেসে আসে সেই মরমন্তদ বিশ্রী কণ্ঠস্বর।
আইজক্যা তুই এক্কেবারে আমার নীলমণি। তরে পাওনের লাইগ্যা কত সাধনা করছি।
মিলিটারির কাছে যাওনের আগে আমারে ইটটু আদর সোহাগ কইরব্যার দ্যাও ময়না পাখিডা।
রাজাকার পাড়ার বখাটে খয়বর এর কথা শুনে গা রি রি কোনো ওঠে ঘৃনায়।
আদর করবি আয়। আমার কাছে আয়।
নীলিমা চিৎকার করে প্রানপন।
কেউ আসেনা। গুলির আওয়াজ শোনা যায় কয়েকটা। সাথে সাথে লা ই লাহা ইল্লাল্লাহু মহাম্মাদুর রাসুলিল্ললাহ একসাথে যেন বিলাপ করে গভীর রাতে সে ধ্বনি মিলিয়ে যায়।
নীলিমা বুঝতে পারে বাবা, মা, ভাইয়া, কেউই আর বেঁচে নেই।
পুরো বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে রাজাকার ও মিলিটারিরা।
আজ রাতে মুক্তিবাহিনীর সদস্য দুই ভাইয়াই লুকিয়ে এসেছে সবার সাথে দেখা করার জন্য। এ খবর জানতে পেরেছিল নিশ্চয়ই রাজাকার শয়তানরা। প্রতিবাদ করায় শেষ করে দিল তাদেরকে। সঙ্গে বাবাকেও। পুরুষ মানুষ আর কেউ রইলো না।
কিছুক্ষন পর শোনা গেল প্রিয় দুই ভাবি আর মায়ের আহাজারি। বুঝলাম সব শেষ হয়ে গেল।
দেশের এমন নৃশংস পরিস্থিতিতে সবাই আমরা মেয়েরা বালিশের নিচে দা বটি, ছুড়ি চাকু রাখতাম। ওরা কেউ কোন কিছুতেই নিশ্চয়ই কিছু করতে পারে নাই আচমকা আক্রমনে।
নর পিশাচটা দাঁত বের করে লকলক করে আমাকে গিলতে এল মৃদু পায়ে।
আমিও প্রস্তুত। কাছে আসা মাত্র বালিশের নিচ থেকে ধারালো বটিটা বের করে দিলাম ঘার বরাবর বসিয়ে।
আহ...
শুধু একটি মাত্র চিৎকারই দিতে পেরেছিল বদমাইশটা।
এরপর আর কিছু মনে নেই আমার। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
জ্ঞান ফিরলে দেখি তখনো অন্ধকার। আসলে তখন ছিলাম আমি এক অন্ধকার বাঙ্কারে। সেখানে ছিল আমারই বয়সি আর ও চার পাঁচজন মেয়ে। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। পড়ে গেলাম যন্ত্রণায়। মেয়েগুলো কি বিশ্রীভাবে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো এ ওর গায়ের উপর।
বাঙ্কারের এক কোন দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ায় মনে হোল এখন দুপুর হবে হয়তো। সে আলোয় দেখলাম আমরা ওখানকার সব মেয়েই উলঙ্গ ! সেই থেকে উলটে গেল জীবনের সব হিসাব নিকেশ ! মনে পড়ে মাসটা ছিল নভেম্বার ১৯৭১ ! স্বাধীনতার মাত্র কমাস আগেই বিরাঙ্গনা হয়ে গেলাম !
নিজের শরীর নিজেই দেখলাম নতুন করে !দুহাতে তখনো ছিল নরপিশাচের দুষিত রক্তের ছাপ।
সারাদিন কেটে যেতে লাগলো। দুপুরে প্লেটে গুনে গুনে খাবার দিত ভালই। রাত হলে এক এক করে সবাইকে বের করে নতুন কাপর চোপড় ও সুগন্ধি স্নো পাউডার দিত। গোসল করে সেজে গুজে তাদের ভোগের যন্ত্র হয়ে যেতাম সব্বাই।
কেটে গেল এভাবেই দিনগুলো।
একদিন হটাত জয় বাংলা ধবনি শুনে আনন্দে আমরাও জয় বাংলা বলে চিৎকার শুরু করলাম।
ছুটে এলো এক ঝাঁক শান্তির পায়রা। কাঁধে রাইফেল, স্টেনগান। যে যার গা থেকে শার্ট খুলে লুঙ্গি গামছা ছুরে দিল আমাদের দিকে। সেখানে দাড়ি গোঁফ ওয়ালা রাতুলকে দেখে চমকে উঠি। মুখ ঘুরিয়ে না দেখা ও না চেনার ভান করি। রাতুল বাঙ্কার থেকে টেনে হেঁচড়ে বের করে আনে আমায়। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে থাকে জয়বাংলা। সবাই একসাথে জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত করে দেয় সোনার বাংলার আকাশ বতাসকে।
বুয়েট থেকে পাশ করে কেবল চাকরিতে ঢুকেছিল রাতুল। একপাড়ায়ই থাকতাম আমরা। প্রেম ট্রেম তেমন কিছু ছিলোনা আমাদের। তবে মনে মনে দুজনই দুজনকে পছন্দ করতাম। ছাদে গেলে দেখা হোতো। রাতুলের এক বন্ধুর বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি লাগোয়া। রাতুল প্রায়ই ওখানে আসতো। এলেই ছাদে আসা চাইই। আমিও যেতাম কী এক টানে। দুজন দুজনকে দেখতাম। একদিন রাতুল আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল ভাইয়াকে বলে। ওদের বাড়ির সবাই কি আদরই না করেছিলো সেদিন আমাকে। রাতুলের হবু বৌয়ের মত ভেবে হয়তো পছন্দ ও করে ফেলেছিল।
সেই রাতুলদের বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর সবাই কেমন আড়চোখে দেখতে থাকলো আমাকে। যেন আমি কোন অশুচি নোংরা প্রাণী। বাবা মা ভাই ভাবি কেউ নেই, সেতো জানতামই। অনেক খুজে রাতুল বড় খালামনিকে বের করলো। একদিন সাহস করে গেলাম তার বাড়িতে। যে খালা মণির অনেক আদরের ছিলাম একদিন, সে যেন চিনতেই পারলোনা আমাকে। যে ভরসা করে গিয়েছিলেম, তা আর হোল না আমার। ঠাই হোল না। ইতিমধ্যে ঢাকায় নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে বীরাঙ্গনাদের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে জেনে রাতুল আমাকে কিছুদিনের জন্য রেখে এলো সেখানে।
(চলবে)
শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক
বিষয়: শাহান আরা জাকির পারুল
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: