সাদা চিঠি : লিপি নাসরিন
প্রকাশিত:
১৯ জুলাই ২০২১ ২০:৩২
আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৬:১০

সকাল থেকেই ধুমচে বৃষ্টি- ঘন কুয়াশা মাখা রহস্যময় বৃষ্টি,যেন তুলট ধোঁয়া উড়ছে। মনটা যেন কেমন পড়ে আসে বৃষ্টি হলে। সেটা যে কেবল এখন হয় বা হচ্ছে তা নয় ,ছোট বেলা থেকে বৃষ্টি দেখলে আমার মন যেন কেমন করতো, কোথায় যেন হারাতে চাইতো। বৃষ্টির সাথে বিষাদের একটা গভীর সম্পর্ক আছে তেমনি সৃষ্টিশীল মানুষের কাছে বৃষ্টির আবেদন অনন্য। বৃষ্টি যেন বিরহের প্রতীক, কান্নার প্রতীক, অপেক্ষার প্রতীক। আমার এই বৃষ্টিবিষাদ নিয়ে বন্ধুরা ঠাট্টা করতো। বলতো ,এতো কিছু থাকতে তোর বৃষ্টি হলে মন খারাপ লাগে।? কিন্তু কেন এমন হতো জানি না। কলেজে পড়ার সময় আমার পড়ার টেবিলের জানালার কাছে সমান উঁচু একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিলো। একটু রাত হলে কেমন যেন শন শন আওয়াজ পেতাম। ওটা যৌগিক পাতার বাতাসের দোল আমি জানতাম তবুও মনে হতো কে যেন কথা বলছে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের রঙ আমাকে মোহিত করতো। বন্ধুরা বলতো আমি নাকি কবি হবো কিন্তু আমি কবি হইনি কিংবা জীবন আমার পথটা অন্য এক বাঁকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চা বা কফি কিছু একটা দরকার কিন্তু এখন কে যাবে কিচেনে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। যুঁথি মানে আমার স্ত্রী মেয়েকে সাথে নিয়ে গেছে বাবার বাসায় , ফিরবে দেরি করে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে আছে। কতকগুলো জার্নালের কাজ শেষ করতে হবে।
বৃষ্টি কখন থামবে কে জানে। পাশে থাকা Streat fighting years বইটার পৃষ্ঠা উল্টাই। হঠাৎ করে একটি এয়ার মেইলের ভাঁজ করা খাম আমার বুকের উপর পড়ে বইয়ের ভাঁজ থেকে। নীরব বিস্ময় ছেয়ে আসে আমার চোখে মুখে। এই খাম এই বইয়ের মধ্যে কীভাবে এলো? ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরি খামটি। বাম পাশে প্রেরকের জায়গায় কালো অক্ষরে লেখা লরেন্স ফ্লোরা। সঙ্গে সঙ্গে আমার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা আরেকটি মানুষ জেগে উঠে আমাকে নিয়ে গেলো প্রায় তিন দশকেরও বেশি পূর্বে আটলান্টার একটা বাড়ির দোতলায় একটা ঘরে যেখানে আমি কয়েক বছর কাটিয়েছিলাম উচ্চতর লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে। আমি এই স্মৃতি আজও পর্যন্ত একাকী বয়ে চলেছি। খুব ঘনিষ্ঠ কোন বন্ধুকে হয়তো বলতে পারতাম কিন্তু ভেবেছিলাম কিছু ঘটনার সৌন্দর্য একা শান্ত থেকে নীরবে উপভোগ করতে হয়। এক সময়ের তাজা টকটকে বর্তমান আজ বিস্মৃত এক অতীত, কিন্তু এটাতো আমার জীবনে বিস্মৃত হবার কথা নয় তবু কেন হলো? মানুষকে হয়তো একটা নির্দিষ্ট সময় পর সব ভুলে যেতে হয় কিংবা হয়তো যৌবনের সৌন্দর্যময় আনন্দ এক সময় বিবর্ণ প্রজাপতির মতো সব রঙ ঝরিয়ে দেয়। কিন্তু যাই হোক, সেই স্মৃতির মসৃণতা সময়ের দূরত্ব মেপে এবড়ো থেবড়ো হয়নি ঠিকই কিন্তু বাঁক নিতে নিতে গতি হারিয়ে হয়তো মুখ থুবড়ে পড়েছিল তা এই মুহূর্তে জানলাম আমি। বিদেশের বিরান সেই দিনগুলোর ব্যস্ততা আর ক্লান্তি যখন আমাকে কষ্টকর বাস্তবতার মুখোমুখি করেছিল তখন হঠাৎ লরেন্স এসেছিল এক ঘাম ওড়ানো বাতাস হয়ে। সেই অকস্মাৎ বিহ্বল রাত আর পার্কের পুষ্প ঝরানো গুটিকয় বিকেল আমার জীবনে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। হ্যাঁ, তাই আমি বলবো। জীবনের সবকিছু একেবারে তোলা মেপে পরিমাপ করা যায় না, সেখানে যোগ- বিয়োগ বা গুণ-ভাগের চিহ্নগুলো বসিয়ে হিসাবটাকে মিলিয়ে নিতে পারলে হয়তো দেনা- পাওনার ব্যাপারগুলো মিটে যায়।
রাত বোধহয় বারটা ছিলো সেদিন। কয়েকদিন ধরে বরফ পড়ছিল। সূর্যের দেখা প্রায় নেই।ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছিল তবুও যেন সামান্য ফাঁক-ফোঁকরে হিমের ফলা এসে বিঁধেছিল।
আমি টেবিলে আমার অ্যাসাইমেন্টগুলো নিয়ে কাজ করছিলাম। আমার ছোট্ট ক্যাসেট প্লেয়ারে আমার প্রিয় গান বাজছিল। আমি হয়তো ঘুমুতে যাবার কথা ভাবছিলাম কারণ সকালে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো। আমি বোধহয় উঠতে যাবো ঠিক এ সময় দরজায় মৃদু অথচ বেশ জোরালো শব্দ শুনলাম। বাইরে কোন সমস্যা হলো কিনা ভেবে দরজা খুলতেই ও উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরের মধ্যে যেন লাফিয়ে পড়লো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও আমাকে দরজা লাগিয়ে দিতে আদেশ দিলো। আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। কেই এই নারী !
কিছুটা ভয়ার্ত ধরা গলায় বললাম, কে তুমি? আমার কাছে কী চাও? কে তুমি? কে...?
ও তখনো হাপাচ্ছিল। বললো, আমাকে রাতটুকু আশ্রয় দাও প্লিজ। ভোর হতেই আমি চলে যাবো।
আমি তোমাকে চিনি না, কোন উদ্দেশ্যে এসেছো জানি না, আমি তোমাকে আশ্রয় দিতে পারবো না। না জানি আমি কোন ঝামেলা পড়ি বলে দরজা খুলতে যেতেই ও প্রায় দৌড়ে এসে আমার হাত চেপে ধরলো।
বিশ্বাস করো আমি তোমার ক্ষতি করবো না। প্লিজ রাতটুকু থাকতে দাও। আমি তোমার কোন অসুবিধা করবো না, ওর গলা থেকে ঝরে পড়ে অনুনয় আর বিনয়ের শব্দগুচ্ছ।
আমি নিরীহ বেচারা এসেছি লেখাপড়া করতে, এ কোন পরিস্থিতির মধ্যে পড়লাম কে জানে।
আমার মধ্যে ভয়, সন্দেহ সবকিছু যেন দলা পাকিয়ে উঠছিল। মুহূর্ত তাকিয়ে ফিরে এসে আমার টেবিলে বসলাম। ওকে সোফা দেখিয়ে বসতে বললাম। ভালো করে তাকালাম ওর দিকে। বয়স কতো হবে? আমার থেকে হয়তো দু-একবছরের ছোট বা বড়ও হতে পারে। কী যায় আসে তাতে? ও মুখ নিচু করে এক হাতের মধ্যে আরেক হাত ঢুকিয়ে বসে রইলো। হঠাৎ আমার খেয়াল হলো ওর গায়ে কোন গরম কাপড় নেই যদিও ঘর ঈষদুষ্ণ ছিলো
তবুও ও কাঁপছিল। আমি উঠে গিয়ে ওকে আমার একটা শাল দিয়ে জড়িয়ে নিতে বললাম।
টেবিলে ফিরে এসে কাজের অজুহাতে ওকে চোখে চোখে রাখলাম। সাদা চামড়ার মানুষগুলোর মধ্যে আমি দৃশ্যমান সুন্দর বা অসুন্দরের পার্থক্য তেমন করতে পারি না।
ওকে বললাম, তোমার যদি খুব বেশি শীত অনুভূত হয়, না হয় ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়ে বসো।
ও কোন কথা না বলে কালো দুটি উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বললো, সরি, সরি ফর এমব্রাসিং ইউ অ্যাট দিস কোল্ড নাইট, বাট হাউ আই ক্যান গেট এ সেফ প্লেস রাইট নাও?
আমি একটু অবাক হলাম। বাহিরে বিরক্ত ও ভয় থাকলেও ভেতরে ভেতরে একটু বোধহয় উচ্ছ্বাস ছিলো আমার। ও আস্তে করে উঠে ফায়ারপ্লেসের কাছে গেলো।
আগুনের নীল শিখায় ওর সোনালি চুলগুলোতে যেন দ্যুতি খেলছিল। গোধূলিগন্ধে ভরে গিয়েছিল আমার ঘর সে রাতে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম তোমার বুঝি এক কাপ কফি প্রয়োজন। ও কোন কথা বললো না। আমি কিচেনে গিয়ে দু কাপ কফি বানিয়ে ফায়ারপ্লেসের কাছে গেলাম। ও আমার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে ধন্যবাদ দিলে আমি ছোট্ট করে একটা হাসি দিলাম। আমি প্রথম থেকে লক্ষ্য করছিলাম ও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না, সেটি হয়তো ভয় থেকে। বিপদে পড়ে কোথায় এসে পড়লো, আমি মানুষটাই বা কেমন ও তো কিছুই জানে না তাই কথা কম বলাই ওর জন্য অপরিহার্য ছিলো। আমি ফিরে এলাম টেবিলে। রাত গভীর হচ্ছে আর বাইরে বরফ পতনের শান্ত ধ্বনি আমি শুনতে পাচ্ছি আমার বুকের মধ্যে। ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে ভয়বিহ্বল চোখে। আমি তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলো। আমি যেন অন্য কাউকে বলছি এমন ভাব করে বললাম, ভালোবাসা বিহীন আমার ভিতরের মানুষটা জেগে ওঠে না। ও আবারও সেই ভাষাহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার দিকে। আমার নিজেকে কেমন অসহায় লাগছিল। ও কী ভাবছে আমার সম্পর্কে? আমি এখনই ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে আস্বাদনের ভোগে মেতে উঠবো? কারণ এই নির্জন রাতে একজন নারী এক অচেনা পুরুষের কাছে নিজেকে কতোটা নিরাপদ বোধ করতে পারে? ও সোফায় এসে বসলো। সেই রকম নিস্পৃহ ভাব তবে ভয়ার্ত মুখ দেখে বোঝা যায় ভিতরে কী নিদারুণ ঢেউ ওকে ভেঙে দিচ্ছিল। আমি কাজে মন দেবার ভান করলাম। সকাল সকাল আমাকে বেরুতে হবে। ঘুম হবে বলে মনে হয় না। মাথাটা মাঝে মাঝে অকেজো হবার ঘোষণা দিচ্ছিল। কী এক উটকো ঝামেলায় পড়লাম! চিনি না, জানি না কে একজন হুড়মুড় করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। আমার কী জানতে চাওয়া উচিত ওর কী বিপদ। যাকগে আমার শুনে লাভ নেই। কাল সকালে বিদেয় হলেই বাঁচি। না জানি আমি আবার কোন বিপদে পড়ি। এইসব মনের মধ্যে খেলাতে খেলাতে ওর দিকে তাকাই। ও মুখ নিচু করে আছে। হঠাৎ দেখলাম ওর মাথাটা বেশ খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো।
আমি লরেন্স বলে ভাকতেই যেন ত্রস্ত হরিণী মতো উঠে দাঁড়ালো। আমি অভয় দিয়ে বললাম, তোমার যদি খুব বেশি ক্লান্ত লাগে তাহলে আমার বেডে ঘুমিয়ে পড়তে পারো। ও কোন কথা না বলে আস্তে করে আমার ব্লাঙ্কেটের নিচে ঢুকে পড়লো। বুঝলাম আজ আমার আর ঘুম কপালে নেই। রাতটা আমি সোফায় কাটিয়ে দিয়েছিলাম নানামুখী ভাবনায় আর প্রতীক্ষায় ছিলাম কখন ভোর হবে। লরেন্স গভীর ঘুমে মগ্ন, ওর রেস্টিং সিমফোনি শুনতে পাচ্ছি আমি। একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। অনেকটা কারনেশন ফুলের গন্ধ। আমি এখানে আসার পর টবে লাগিয়েছিলাম। সে ফুল তো ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ ফুটবে আবার। সেই শীতের গভীর রাতে আমার খুব তৃষ্ণা পেলে আমি উঠে গিয়ে পানি খেলাম তারপর এক অনিয়ন্ত্রিত কৌতূহল নিয়ে আমি আস্তে করে বেডের পাশে গেলাম। লরেন্সের কপাল থেকে নাক অবধি একটু আলগা আর পুরোটাই ঢেকে আছে, নিশ্বাস পড়ছে খুব ঘন। আমার খুব ইচ্ছে হলো ওর মুখটা আলগা করে দেখি। আমার ভিতরে কি অন্য আরেকজন জেগে উঠছে? আমি ওকে কষে বেঁধে টেনে নিয়ে এলাম হুঙ্কার দেবার আগেই। ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে, আমি অপেক্ষা করে আছি একটা ভোরের, একটা বিপদহীন সোনালি সকালের। আমার অনেক কাজ। মাথা যেন কাজ করছে না আর। কখন একটু তন্দ্রার মতো লেগেছিল জানি না। ঘড়িতে এলার্ম বাজতেই আমি জড়িয়ে থাকা চোখ মেলি। হঠাৎ সোফায় কেনো আমি? মুহূর্তে মনে পড়ে যায় রাতের ঘটনা। আমি তাকিয়ে দেখলাম বেডে লরেন্স নেই। আমি উঠে কিচেনে গেলাম, না নেই। তবে কি ওয়াশরুমে? না তাও নয়। তাহলে? ও কি সকাল হবার আগেই চলে গেলো? দরজায় দেখলাম দুকপাটের মাঝে সরু রেখা। বুঝলাম লরেন্স ভোর হবার আগেই চলে গেছে। নাকি সবটাই আমার ইল্যুশন। আসলে কাল রাতে কেউ আসেনি। হঠাৎ মনে পড়লো আমি ওর নাম জানতে চাইলে ও একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি এশিয়ান? আমি হ্যাঁ বলে আর একটু বাড়িয়ে বলেছিলাম, আমার দেশ বাংলাদেশ। ওর চোখে আমি হঠাৎ লক্ষ্য করেছিলাম মেঘ উড়ে গিয়ে আলোয় উদ্ভাসিত বরফদ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে।
আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সারাদিন কাজের ফাঁকে ঐ এক ঘটনা আমাকে মুহ্যমান করে রেখেছিল। কে ,কোথা থেকে আসলো, কোথায় বা চলে গেলো ইত্যাদি ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন রেখেছিল। ধীরে ধীরে আমার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ল্যাবে কাটতে থাকে আমার বাহিত সময়গুলো। কাজের চাপে মাথা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল লরেন্স ফ্লোরা। প্রায় বছরখানেক পর একদিন আমি এক বসন্তের সন্ধ্যায় নিকটস্থ পার্কে হাঁটছিলাম। ঠিক আমাদের জারুল ফুলের মতো দেখতে ফুলগুলো থোকায় থোকায় ঝুলে ছিলো পার্কে জায়গায় জায়গায়। আমি অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিলাম হঠাৎ দুজন মেয়েলি কন্ঠের হাসি শুনে সামনে তাকাতেই আমার বিস্ময়ে ঘোর লাগে। লরেন্স না? হ্যাঁ,হ্যাঁ লরেন্সই তো! আমি ভুল দেখছি না। সে রাতে আমি তাকে খুব ভালো করেই চিনেছিলাম। কিন্তু লরেন্স কি আমাকে চিনতে পারেনি নাকি সেই রাতের স্মৃতি মনে করতে চায় না? ওরা পাশ কেটে বেরিয়ে যেতেই আমি বললাম, লরেন্স!
দুজন দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি দুপা এগিয়ে ছিলাম ওদের থেকে। লরেন্স এগিয়ে এসে আমার চোখে চোখ রাখলো। ওর চোখে মৃদু হাসি। আমি বুঝতে পারলাম ও আমাকে মনে রেখেছে।
আমিই প্রথম কথা বললাম। তুমি সেদিন আমাকে না বলে ওভাবে চলে গেলে যে? আর তো দেখাই হলো না তোমার সাথে। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। তোমাকে তো আমি জানতেই পারলাম না।
লরেন্স হাসি দিয়ে বললো, আজ আমার তাড়া আছে, তোমার কি কাল এ সময় এখানে আসার সময় হবে? আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।
আমি সম্মতিতে মাথা নাড়তেই সঙ্গী মেয়েটার সাথে ও চলে গেলো। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।
ঘরে ফিরে ভাবছিলাম এভাবে এতোদিন পর লরেন্সের সাথে আবার দেখা হওয়া কি কাকতালীয় নাকি এর পিছনে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে স্বয়ং বিধাতা খেলছে। যাই হোক পরদিন ঠিক সেই সময়ে পার্কের ঠিক সেই জায়গায় গিয়ে আমি দাঁড়িয়েছি মাত্র ,দেখি লরেন্স বিপরীত দিক থেকে আসছে। আশ্বস্ত হলাম দেখে। ও বললো, তোমার আপত্তি না থাকলে চলো ওখানটাই গিয়ে আমরা বসি। আমি যেন আদিষ্ট হয়ে ওর সাথে চলছি। ও এই বসন্ত সন্ধ্যায় ফুল ,পাখি আর বাতাসের গুণগান করতে করতে হেঁটে চললো কিন্তু আমার ভেতর নানান প্রশ্ন আর দ্বিধার সম্মিলনে এক সুখকর অনুভূতি ফিরে আসে আবার দূরে মিলিয়ে যায়।
আমরা একটা বেঞ্চে বসলাম।
সেদিনের সেই রাতের জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি বলে ও আমার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে থেমে গেলো।
মেহেরাজ, আমি বললাম।
ও খুব লজ্জিত হয়ে বললো, সরি সেদিন তোমার নামটা আমি জেনে নিতে পারিনি।
আমি কেবল ওকে দেখছি মুগ্ধ চোখে। ওর মধ্যে কোথাও যেন একটা আন্তরিকতার ছোঁয়া আছে। অন্যান্য বিদেশিনীর মতো নয়। আমি লক্ষ্য করলাম ওর চোখ দুটো বেশ কালো তবে চুলটা সোনালি। গায়ের রঙটা ঠিক লাল গোলাপি নয়, কোথাও যেন একটু তামাটের ছোঁয়া আছে।
তুমি বলেছিলে তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো।
হ্যাঁ, বলে আরো কিছু শোনার অপেক্ষায় আমি রইলাম।
মেহেরাজ আমিও কিছু বাংলা বলতে পারি।
চমকে উঠে বললাম, কীভাবে?
ও তখন হাসছে। ভাঙা বাংলায় বললো সেটি অন্যদিন বলবো। আজ সন্ধ্যা হয়ে আসছে চলো উঠি। মাম্মা ভীষণ রাগ করে ,সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে।
আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম। আবার কবে দেখা হবে আমাদের।
আমি তোমাকে জানাবো। তুমি তো সে বাড়িতেই আছো?
আমরা উঠে পড়লাম। ও বললো তাদের বাড়ি বেশি দূরে নয়। এই পার্কটার ওপাশে একটা লেক আছে সেই লেকের ওপাশে তাদের বাড়ি।
তারপরও প্রায় মাসখানেক পার হয়েছে।লরেন্সের অপেক্ষায় থেকেছি আমি। কেনো থেকেছি জানি না। ওকে তো আমি ভালোবাসি না তাহলে কেন এই অপেক্ষা? তাহলে কি কৌতূহল? কেনো সে রাতে ওর সেই ঝড়ো হাওয়ার গতি তা জানা হয়নি তখনো, আর ও বাংলা বলতে পারে জেনে হয়তো আমার আকাঙ্ক্ষার মাত্রা পারদ ছাড়িয়েছিল। সময় গড়ায় আর আমি অস্থির হয়ে উঠি। অবশেষে একদিন সেই পরিচিত টোকা আমার দরজায় আঘাতে ভেসে এলো। আমি যেন বুঝেছিলাম এ লরেন্স। দরজা খুলতেই ওর হলুদাভ মুখে হাসির ঝিলিক। আজ ওর মধ্যে কোন জড়তা নেই, আমার মধ্যেও না। আমরা পাশাপাশি সোফায় বসলাম।
আজ তুমি সেই ঘটনা না বলে যাবে না লরেন্স।
সেটা তেমন কিছু নয়। আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। বাবা আমাকে ধরতে পারলে পাগল বানিয়ে হসপিটালে রেখে আসতো।
পাগল! পালিয়ে ছিলে? আমি একটু অবাক হলাম। আমি ইচ্ছে করে সোফা থেকে উঠে গিয়ে কাঠের চেয়ারটাকে সঙ্গ দিলাম।
তুমি কি আমাকে আগে থেকে চিনতে লরেন্স যে একেবারে আমার ঘরে এসে উঠলে?
ঠিক চিনতাম না তবে তোমাকে এ রাস্তায় কয়েকবার দেখে একদিন তোমার পিছে চুপিচুপি এসে তোমার বাসা চিনে গিয়েছিলাম।
বলো কী? তা এতো লোক থাকতে আমার বাসা কেন লরেন্স?
আমার মনে হয়েছিল তুমি এখানে পড়তে এসেছো এবং একা কারণ আমি তোমাকে সবসময় একাই দেখতাম।
ওহ! তাই পালিয়ে আমার ঘরে চলে এলে?
হয়তো তাই। আবার আমার মনে হয়েছিল তুমি এশিয়ান কারণ আমি আমার বাবাকে দেখেছিলাম।
দেখেছিলাম এই অতীত শব্দটাকে ঠিকমত বোধগম্যতায় না আনতে পেরে বললাম তার মানে?
ও যেন শুনতে পাইনি এমন ভাব দেখিয়ে বললো, তোমাকে একদিন মাম্মার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।
কৌতূহলী হয়ে বললাম, কবে নিয়ে যাবে তোমাদের বাড়িতে?
তোমার কথা মাম্মাকে বলেছি। জানো ঐ ভদ্রমহিলার জন্যই আমি এখনো ও বাড়িতে আছি।
ও যা বলছে তার কিছুই তেমন না বুঝলেও বুঝতে পারছিলাম কোথাও একটা সমস্যা আছে।
আমি ওকে আমার সাথে ডিনারের অফার করলাম।
ও ধন্যবাদ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি একটু ইতস্তত করে ওর হাত ধরলাম।
আবার দেখা হবে বলে ও সেদিন সন্ধ্যায় বিদায় নিয়েছিল।
ও চলে যাবার পর ভাবলাম একটা রাতের একটা ছোট্ট ঘটনা আমাদের দুজনকে অনেকদিনের চেনা জানা মানুষে পরিণত করেছে। অথচ লরেন্স আমার সম্পর্কে কিছুই জানতে চায়নি, শুধু নাম আর দেশ ব্যতিরেকে।
আমিও তেমন কিছুই জানি না ওর সম্পর্কে।
এভাবে পড়ালেখা আর লরেন্সের সাথে মাঝে মাঝে কথা হওয়ার মাঝে একদিন ও আমাকে ওদের বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত দিলো। দেশে পরিচিতজনের বাড়িতে আমরা মিষ্টি নিয়ে যাই কিন্তু বিদেশের চলনটা আমি তখনো রপ্ত করতে না পেরে একগুচ্ছ ফুল আর ফল নিয়ে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ওর মাকে বেশ আন্তরিক মনে হলো। সে রাতের জন্য সরি বলার পাশাপাশি লরেন্সকে আশ্রয় দেবার জন্য ধন্যবাদ দিলো। ওর একটা ছোট ভাই আছে। কিন্তু লরেন্সের সাথে তার চেহারা একেবারেই অমিল, এই ব্যাপারটা আমার দৃষ্টি এড়ালো না।
ওর মায়ের- আমি এখানে কোথায় পড়ছি, আর কতোদিন থাকবো এইসব ছোট ছোট প্রশ্নে ডিনারপর্ব শেষ হয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় লরেন্সের বাবা হয়তো বাসায় ছিলো না- হয়তো বলছি কারণ সে সন্ধ্যায় আমি তাঁকে দেখিনি।
এরপর আমার ব্যস্ততা বাড়লো, লরেন্স আমার ঘরে আসে, বেশ কিছুক্ষণ থাকে, আমার জন্য কফি বানিয়ে আমার সামনে এসে বসে, আমি ফাঁক বুঝে কফিতে চুমুক দিই আর ওর মুখের দিকে তাকাই। দুষ্টুমি হাসিতে ওর মুখটা ভরে থাকে। কখনো হয়তো পার্কে অবসরের মুহূর্তগুলো কাটে আমাদের সোনালি সন্ধ্যার।
আমাদের জীবনে হয়তো অবশ্যম্ভাবী ছিলো সেই সন্ধ্যাটি, সেদিনও লরেন্স এসেছিল। সন্ধ্যা পার হয়ে একটু রাতের দিকে সময় এগোচ্ছে। আমি ওকে তাড়া দিচ্ছিলাম বাসায় যেতে কারণ সন্ধ্যার পর ওর মায়ের নিষেধ বাইরে থাকা যদিও এদেশে মেয়েদের বেশি রাত করে বাড়ি ফেরাটা অস্বাভাবিক বা মন্দ কিছু নয় তবু লরেন্স তার মায়ের একান্ত বাধ্যগত।
লরেন্স আমার খাতাটা, কলমটা নিয়ে খেলছিল কিন্তু বাড়ি যাবার কোন তাড়া দেখালো না। আমি আর একবার একটু জোর দিয়ে বলতেই লরেন্স হঠাৎই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে ওকে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে নিয়ে ওর পাতলা শরীরের অলিগলি, আর বাঁক পেরিয়ে অবশেষে গভীর সমুদ্রে মন্থনে থিতু হলাম। ও চলে যাবার সময় আমাকে আবারো আলিঙ্গন করলো, আমি ওর ঠোঁটের মিষ্টি হাসিটুকু ফিল্টার পেপারের মতো শুষে নিলাম।
তারপর শীত আর বসন্তের দিনগুলো পড়ালেখা, সেমিনার, পেপার লেখা করতে করতে পার হতে লাগলো। লরেন্স ছিলো আমার ব্যস্ততা আর ক্লান্তিকর দিনগুলোতে এক আনন্দ সরোবর। ওর সাথে আমার আন্তরিকতা ওর মাও মেনে নিয়েছিল। লরেন্সকে আমি প্রায় রাতের মেট্রোয় পৌঁছে দিয়ে ফিরতি মেট্রোয় ফিরে আসতাম।
দেখতে দেখতে আমার সময় শেষ হয়ে গেলো। লরেন্সকে খুব অন্যমনস্ক দেখতাম আমার ফেরার সময় ঘনিয়ে আসার দিনগুলোতে।
একদিন দরজায় লরেন্সের টোকা শুনেই দরজা খুলে আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম। লরেন্সের মা দাঁড়িয়ে। আমি শতদ্বিধা নিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করে ভেতরে আসতে আহ্বান করলাম।
উনি বললেন, আমি সরি তোমাকে এ সময় বিরক্ত করার জন্য। তুমি হয়তো লরেন্সকে আশা করেছিলে, কিন্তু ওর শরীরটা তেমন ভালো নেই। তাই আমি তোমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন থেকে এই সময়টা নিলাম।
আমি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কী হয়েছে ওর?
ভয় পেয়ো না, তেমন মারাত্মক কিছু নয়। ওর বাবা চলে যাবার পর থেকে মেয়ের আমার এই অসুখ।
আমি কিছু জানতে চেয়ে কথা পাড়বার আগেই ওর মা বললো, আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল তা প্রায় দশ বছর হলো। ওর বাবা ছিলো তোমার দেশের মানুষ। এদেশে পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করতো। আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে লরেন্সের বাবার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।
এতদিনে আমার কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হতে লাগলো যা বারবার জানতে চাইলেও লরেন্স কোনদিন আমাকে বলতে চায়নি।
ওর বয়স যখন দশ তখন আমরা দুজনে পরস্পরের প্রতি আর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বজায় রাখতে পারিনি। তাই বলে ভেবো না ওকে আমি দোষ দিচ্ছি। আমরা যে যার অবস্থান থেকে সঠিক ছিলাম।
তিনি কি এদেশেই আছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না, ও চলে গিয়েছিল। মেয়েকেও সাথে নিতে চেয়েছিল, আমি দিই নি। কিন্তু লরেন্স ভীষণ বাবার ন্যাওটা ছিলো। ওর বাবা চলে গেলে ও খুব চুপচাপ থাকতো সারাক্ষণ। আমার সাথে কথা বলতে চাইতো না, ঠিকমত খেতো না। অচিরেই লরেন্স বিছানা নিলো। আস্তে আস্তে ওর মনোবিকার ঘটতে লাগলো। আমার বর্তমান স্বামী একজন মনোচিকিৎক। ওকে সেসময় চিকিৎসা করতো।
আমি গল্প শোনার মতো মনোযোগ দিয়ে লরেন্সের মার কথা শুনছিলাম।
মাঝে মাঝে এখনো পাগলামি করে। চোখে চোখে রাখতে হয়। সেদিন রাতেও...
জানতে চাইলাম লরেন্সের বাবার বর্তমান অবস্থান তিনি জানেন কিনা।
বললেন, প্রথমদিকে লরেন্সকে চিঠি লিখতো, মাসে একবার হলেও ফোনে কথা বলতো। আমি লরেন্সের মানসিক অবস্থার কথা তাকে জানিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে তার চিঠি, ফোন সব বন্ধ হয়ে যায়।
আপনি কখনো বাংলাদেশে গিয়েছিলেন?
দুবার গিয়েছি শাহেদের সাথে।খুব ভালোবাসতো ওর ফ্যামিলি আমাকে।
এরপর লরেন্সের মা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো , মেহেরাজ তুমি লরেন্সকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। আমি বলছি নিয়ে যাও। তুমি চলে যাবে শুনে লরেন্স আবার চুপচাপ হয়ে গেছে।
লরেন্সের মায়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
আমি বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন। কী বলা উচিত জানি না। দেশে আমার পরিবার ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে এসব সাত পাঁচ ভাবনা সরিয়ে দিয়ে বললাম, ঠিক আছে লরেন্স রাজি থাকলে আমি ওকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।
সেই সন্ধ্যায় তিনি নিজেকে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বিদায় নিয়েছিলেন।
শেষ কটা দিন লরেন্সের সাথেই আমার সময় কেটেছে। তবে অধিকাংশ সময় ও বিষণ্ণ থাকতো। আমি চেষ্টা করতাম ওকে ভালোবাসা দিয়ে আনন্দে ভরে রাখতে। অধিকাংশ সন্ধ্যা পার্কে কাটাতাম আমরা। আঁধার ঘিরে আসার মুহূর্তে পার্কের বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে দুজনে গোধূলির রঙে স্নান করতাম। ঝরাপাতা হাত দিয়ে ভেঙে ওর গায়ে ছড়িয়ে দিতাম। ও কখনো খুব হাসতো, কখনো প্রচণ্ড রোদে ঈশান কোণে মেঘপুঞ্জের ন্যায় চোখে ঘন মেঘ জমাট বাঁধতো।
লরেন্স কিন্তু মোটেই আমার সাথে আসতে রাজি হয়নি। আমি অনেক বুঝিয়েছি, ও কেবলই বলেছে মাম্মাকে রেখে সে কোথাও যাবে না তাছাড়া বাবা তাকে ভুলে গেছে তাই আর যেতে চায় না।
ওর মা অনেক বোঝানোর পরও কিছুতেই রাজি হয়নি। তাই শেষ চেষ্টা হিসাবে আমাকে বললেন আমি যেন থেকে যাই ও দেশে।
একবার আমার মনে হয়েছিল থেকে যাই লরেন্সকে ভালোবেসে কিন্তু বাবা-মার স্বপ্ন আর আশা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
আমার ফেরার তারিখ ঠিক হয়ে গেলে আমি শেষ বিদায় নিতে ওদের বাড়িতে যাই। সেদিন প্রথম আমি লরেন্সের সৎ পিতাকে দেখেছিলাম। কয়েক মিনিটের আলাপে তাঁকে খুব অমায়িক মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু যার জন্য উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গেলাম তার দেখা পেলাম না। আমার আসার খবর পেয়ে লরেন্স নিজের ঘরের দরজা
বন্ধ করে দিলো। আমার করার কিছুই ছিলো না কারণ আমাকে ফিরতে হবে। ওর মা জানালো গতো দুই দিন ও একদম চুপচাপ আছে। তেমন কথা বলে না। গত দুদিন আমাদের দেখাও হয়নি ,আমি ব্যস্ত ছিলাম ও দেশের পাঠ চুকিয়ে নিতে।
ফিরে এসেছিলাম সেদিন প্রচণ্ড আহত হয়ে। কিই বা আমার করার ছিলো আমি জানি না।
তারপর থেকে স্ফুলিঙ্গের ঝুরি উড়তে উড়তে একসময় আগুন নিভে যায়। কতো বসন্ত এলো, ঝরাপাতারা ভেঙে গেলো, আমাদের সেই সময়গুলো পড়ে রইলো সেই ছোট্ট ঘর আর পার্কের গোধূলিরঙা ছোট ছোট বিকেলগুলোতে।
দেশে ফেরার বছর খানিক পর একদিন লরেন্সের এই একটি মাত্র চিঠি এলো। আমি আর যুঁথি তখন সংসারের ঘেরাটোপে বন্দি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানাটা দিয়ে এসেছিলাম। বিভাগের ঠিকানায় চিঠি এসেছিলো। বিস্ময়ে, আনন্দে খাম ছিঁড়তে গিয়েও যেন হাজার বছর পার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু চিঠিটা খুলে দেখলাম কেবল সাদা একটা পৃষ্ঠা। শুধু মাঝখানে একটা রক্তাক্ত আঙুলের শুকনো ছাপ। আমি হয়তো কোনদিন ওকে বলেছিলাম আমাদের দেশে প্রেমিক-প্রেমিকারা হৃদয়ে রক্ত আঙুলে কেটে চিঠি লেখে। লরেন্স সেই কথা মনে রেখেছিল। কিন্তু এতোদিন পর এ চিঠি এ বইয়ের ভাঁজে কীভাবে আসলো? তবে কি যুঁথি!
বাইরে বৃষ্টি বোধহয় কমে এলো। লরেন্সকে মাথা থেকে সরিয়ে দিতে মোবাইলের নেট অন করি। একটা নোটিফিকেশন আসলো বন্ধুত্বের অনুরোধের। টেলিপ্যাথি কি এটাকেই বলে?
আমি লরেন্সের প্রফাইল পিকচারটাকে ক্লিক করে চেয়ে থাকি। সে ছবি গুমরে ওঠা কান্নার!
বিষয়: লিপি নাসরিন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: