মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
৩ ডিসেম্বর ২০২১ ০২:১৪

আপডেট:
১৩ মার্চ ২০২৫ ০৭:১৩

ছবিঃ জননেতা মওলানা ভাসানী

 

মাওলানা ভাসানী মজলুম জননেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী জন্ম গ্রহন করেন ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জের সয়া-ধানগড়া গ্রামে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পরিবারে। পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খাঁ, মাতার নাম মজিরন বিবি। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাস “স্বরাজ্য পার্টি” গঠন করলে মাওলানা ভাসানী সেই দলকে সংগঠিত করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে মাওলানা ভাসানী ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ চিন্তাধারার।
মাওলানা ভাসানী মজলুম জননেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
ঘটনাবহুল তাঁর দীর্ঘ জীবন। তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন এমন অনেকের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে তাঁর জীবনের অনেক অজানা দিক। সৈয়দ আবুল মকসুদ এর লেখা বই ' ভাসানী কাহিনী' থেকে জানা যায় তার অনেক অজানা কাহিনী। এ বইয়ের প্রতিটি পাতায় ভাসানীর জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র গল্পের আদলে ফুটে উঠেছে।
শুধু গল্পের আদলে লেখাগুলো লেখেননি, বরং বয়ানদাতার পরিচয় এবং তখনকার পরিচয় তুলে ধরার পাশাপাশি তিনি ভাসানীর সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন সেটাও অনুসন্ধান করেছেন। যার ফলে গল্পগুলো শুধু আর গল্প থাকেনি, হয়ে উঠেছে প্রামাণ্য দলিল।
মাওলানা ভাসানী একাধারে ছিলেন পীর ও রাজনৈতিক নেতা, যদিও অন্যদের সঙ্গে তার তফাৎ ছিলো এই যে তিনি কৃষকদের অধিকার নিয়ে কথা বলতেন। পাশাপাশি উঠে এসেছে মাওলানার অনাড়ম্বর জীবনের নানা অজানা কাহিনী। উঠে এসেছে মাওলানার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের গল্প। কিন্তু নীতির প্রশ্নে কখনও আপোষ করেননি তিনি। মাওলানা একদিকে যেমন রাজনীতি সচেতন ছিলেন অন্যদিকে ছিলেন সমাজ সংস্কারক। উনি ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন সমাজের অর্ধেক নারীকে অশিক্ষিত রেখে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নারী শিক্ষার পাশাপাশি তাদেরকে ঘোড়ায় চড়াসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের কথাও বলেছেন। এ বইয়ে ঘুরেফিরে এসেছে মাওলানার আটপৌরে জীবনবোধের গল্প। যা পড়লে মনেই হয় না যে এসব কোন রাজনৈতিক নেতার জীবনের গল্প, বরং মনে হয় গ্রামের কোন সাধারণ কৃষকের গল্প। পাশাপাশি এসেছে মাওলানার ভাষা এবং রাজনৈতিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গল্প। মাওলানা বাংলার পাশাপাশি দরকার হলে হিন্দি ও উর্দু ভাষাতেও বক্তব্য দিতেন, এমনকি তাঁকে দেখা যায় বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইংরেজিতেও আলাপ করতে। সবকিছু ছাপিয়ে এসেছে মাওলানার আন্তরিকতার গল্পগুলো। মানুষকে আপ্যায়ন না করে ছাড়তেন না কখনও, দরকার হলে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন।
শক্তিমান লেখক আহমদ ছফা ‘মাওলানা ভাসানী’ বলেছেন, “বাঙলার কৃষক সমাজের সত্যিকার নেতা ছিলেন মরহুম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা সাহেব কৃষক সমাজের একেবারে ভেতরে গাছের মতো বেড়ে উঠেছিলেন। গাছের বেড়ে ওঠার জন্য যেটুকু আলো, জল, হাওয়ার প্রয়োজন কৃষক সমাজের দাবিগুলোকে অনেকটা সেই চোখেই দেখতেন তিনি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাঁকে রাজনীতির দিকে ধাবিত করেছে। তাঁর ছিলো এক অনন্য সংবেদনশীল সহজাত প্রবৃত্তি। মাওলানার প্রথম জীবনের রাজনীতি থেকে শুরু করে জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ের বিভিন্ন ঘটনা এ বইয়ে স্থান পেয়েছে। যেমন মাওলানার প্রথম জীবনের রাজনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘...বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শেষ দিকে তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হন। মাওলানা ভাসানী তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সবসময়ই সাধারণ জনমানুষের অধিকারের জন্য লড়েছেন। আর শোষক বিরোধী বিভিন্ন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ওয়াজ মাহফিলেও শোষক বিরোধী বক্তব্য দিতেন। তাই উনার ওয়াজ মাহফিলে সব ধর্মের এবং সব বর্ণের শ্রোতাদের সমাবেশ ঘটতো। মাওলানা বাস্তব জীবনে ইসলামের নিয়ম কানুন পালন করলেও মনেপ্রাণে ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হয়েও মাওলানা কিন্তু জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা বাংলা ভাষার সঙ্গে নামাজ তথা ধর্মের সাংঘর্ষিক একটা ব্যাখ্যা পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই দেওয়ার চেষ্টা করে আসছিলো। একবার পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মাওলানার কথা হলে তিনি বলেন, “ধর্মের সঙ্গে ভাষার কোন সম্পর্ক নাই। ধর্ম এক জিনিস আর ভাষা আর একটি জিনিস। একটির সঙ্গে অন্যটিকে যারা মেশায় তারা অসৎ ও মতলববাজ।
মাওলানা সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বিরুদ্ধে বলেছেন, “যেসব মুসলমান হিন্দুদের বিধর্মী মনে করে, তাদের ক্ষতি করতে চায়, আমি তাদের বলি তোমরা কারা? খুব বেশি হইলে চার-পাঁচ পুরুষ আগে তোমরা কারা ছিলা? তোমাদের বাপ-দাদার বাপ-দাদারা ছিলেন হয় হিন্দু নয় নমঃশূদ্র। এ দেশের হিন্দু আর মুসলমানের একই রক্ত।
তবে নিজে বৈষয়িক না হয়েও অনেককে বৈষয়িক উপদেশ দিতেন। মাওলানা সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেন, “আসলে তিনি সোজা-সরল ধরনের মানুষ। রেখেঢেকে মেপেবুঝে কথা বলতে জানেন না। মনে যা ভাবেন মুখে তাই বলেন। খোলামেলা মানুষ। তাতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
‘ভাসানী কাহিনী’ বইয়ের মুখবন্ধে লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেন, “জাতীয় জীবনের রাজনীতির অঙ্গনে মাওলানা ভাসানী আজ অবহেলিত। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের কাছে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাস “স্বরাজ্য পার্টি” গঠন করলে মাওলানা ভাসানী সেই দলকে সংগঠিত করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে মাওলানা ভাসানী ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ চিন্তাধারার।
১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে তিনি প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এই সম্মেলনের পর তিনি সর্বমহলে ভাসানীর মাওলানা নামে পরিচিতি লাভ করেন। মূলত এরপর থেকেই তাঁর নামের শেষে “ভাসানী” উপাধি যুক্ত হয়। ভাসান চরের সফল সম্মেলনের পর কৃষক-মজদুর মহলে মাওলানা ভাসানী হয়ে উঠেন এক অবিসংবাদিত নেতা। প্রগাঢ় স্বদেশপ্রেম, প্রগতিশীল আদর্শ ও প্রতিবাদী চেতনার আলোকবর্তিকা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top