বিশ্ব বই দিবসে- বইগ্রাম : সিদ্ধার্থ সিংহ
প্রকাশিত:
২৭ এপ্রিল ২০২২ ০১:৩৩
আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২২ ০১:৩৬

বিস্ময়কর এক গ্রাম। যেখানে বইয়ের জন্য আপনাকে যেতে হবে না কোনও লাইব্রেরিতে। পুরো গ্রাম জুড়েই ক'হাত দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে শুধু বই আর বই। হ্যাঁ, গ্রামটির প্রতিটি মোড়ে মোড়েই রাখা আছে বুকশেলফ। আর সেখানেই থরে থরে সাজানো আছে বই।
বলছি আমাদের এই ভারতেরই কেরালার কোল্লাম জেলার কোত্তারাক্কারা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট এক গ্রাম পেরুমকুলামের কথা।
এই গ্রামের পথে-প্রান্তরে হাঁটতে হাঁটতেই আপনি পেয়ে যাবেন একের পর এক বইঘর। সেখানে বসে বই থেকে শুরু করে খবরের কাগজ সবই পড়তে পারবেন। ২০১৭ সালে এই গ্রামটিকে ‘বইগ্রাম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসের গুলিতে প্রাণ হারান মহাত্মা গান্ধী। বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে গোটা দেশ৷ বিষাদগ্রস্ত হয় কেরালার ছোট্ট গ্রাম পেরুমকুলমও। কিন্তু শুধু মন খারাপ করে বসে থাকলেন না এই গ্রামের যুবকেরা। তাঁরা ঠিক করলেন, এমন একটা কাজ করবেন, যাতে মহাত্মা গান্ধীকে সম্মান জানানো হয়, আবার সেই সঙ্গে দেশও উপকৃত হয়।
ফলে ওই গ্রামেরই যুবক কৃষ্ণা পিল্লাই ও তাঁর বন্ধুরা মিলে বেশ কিছু বই কিনে ফেললেন। গ্রামবাসীদের থেকে সংগ্রহ করলেন আরও কিছু বই৷ সব মিলিয়ে শ'খানেক বই জোগাড় হল। রাখা হল গ্রামেরই পিল্লাই পরিবারের একটি ঘরে৷ এভাবেই স্থাপিত হল পেরুমকুলমের প্রথম গ্রন্থাগার--- ‘বাপুজি মেমোরিয়াল লাইব্রেরি’৷
মানে ১৯৯৫ সালে ২৩ এপ্রিল দিনটিকে ঘটা করে
বিশ্ব বই দিবস হিসেবে রাষ্ট্রপুঞ্জ ঘোষণা করার বহু আগে থেকেই কিন্তু বই নিয়ে মেতে ছিল সাধারণ মানুষ।
কিন্তু কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস বা বিষয়ভিত্তিক বই পড়ার আগ্রহ থাকলেও বই কেনার মতো আর্থিক সংগতি সবার ছিল না। ফলে বই পড়ুয়াদের উদ্যোগেই এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠেছিল পাঠাগার। নামমাত্র মাসিক চাঁদায় সেখান থেকে বই নিয়ে অনায়াসে পড়া যেত।
কিন্তু শুধু লাইব্রেরি গড়লেই তো হবে না, তার সঙ্গে জাগিয়ে তুলতে হবে বই পড়ার সংস্কৃতি। তাই ১৯৪৮ সালে পেরুমকুলামের যুবক-যুবতীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে শুরু করলেন বইগ্রামের প্রাথমিক কর্মকাণ্ড।
গ্রন্থাগারটি ১৯৫৭ সালে একটি নিজস্ব ভবন পায়। যেটা ২০০৮ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে গ্রামবাসীরা সবাই মিলে পুনর্নির্মাণ করেন। ২০১৬ সালে গ্রন্থাগারটি আবারও সংস্কার করা হয়। গ্রন্থাগারটি এখন প্রতি বছর ৩২ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান পায়।
১০০টি বই নিয়ে শুরু হওয়া এই লাইব্রেরিতে আজ প্রায় ৮০০০ বই রয়েছে। গোটা দেশে পাঠাগার সংস্কৃতি যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, পড়ুয়াদের অভাবে একের পর এক পাঠাগার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন ওই লাইব্রেরিটির রমরমা দেখে এবং পড়ুয়াদের প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে ২০১৬ সালে এখানকার বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণী ঠিক করলেন, পুরো পেরুমকুলমকেই তাঁরা গ্রন্থাগার হিসেবে গড়ে তুলবেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়ে তাঁরা ছোট্ট ছোট্ট বইঘর বানাবেন।
সেই মতো রাস্তার পাশে একের পর এক গড়ে তোলা হল ছোট ছোট বুকসেলফ। ওই বুকসেলফের দরজা খুলে বই নিতে হয়। আর দরজা বন্ধ করলেই একদম নিরাপদে বই।
কাঠের বাক্সের বুকসেলফগুলোর ভিতরে থাকা বইগুলো যাতে বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট না হয়, তারও ব্যবস্থা করা হল উপযুক্ত আচ্ছাদন দিয়ে।
এই বইঘরগুলির একেকটি থাকে ৫০টি করে বই। এখান থেকে বই নিয়ে পড়ার এক অভিনব নিয়মও আছে। এ সব বইঘর থেকে বই নিয়ে পড়তে কোনও দক্ষিণা দিতে হয় না ঠিকই, এখানে কোনও পাহারাদারও থাকে না ঠিকই, তবে এখান থেকে একটি বই বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে নিজেকে আগে একটি বই এখানে রাখতে হয়। মানে এই বইঘর থেকে যে যত বইই নিয়ে যাক না কেন, সব সময় ৫০টি বইই মজুত থাকে।
আজ বিশ্ব বই দিবসে পেরুমকুলামের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য।
সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা
বিষয়: সিদ্ধার্থ সিংহ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: