ভাষা আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধু : এস ডি সুব্রত
প্রকাশিত:
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০২:২৬
আপডেট:
১৩ মার্চ ২০২৫ ০৭:৩৪
-2020-11-16-16-16-55-2023-02-22-15-26-19.jpg)
ফাগুন এলে যেমন পলাশে শিমুলে কৃষ্ণচূড়ায় রঙের আগুন লাগে তেমন করে বাঙালির বুকের ভেতর চেতনার ঢেউ জাগে। মা, মাতৃভূমি আর মায়ের ভাষার মতো আপন কিছু হয় না।আর মায়ের ভাষার জন্য যখন রক্ত ঝড়ে তখন সেটা হয়ে উঠে আরো মহিমান্বিত। মাতৃভাষার আন্দোলনে ভাষা সৈনিকদের পাশাপাশি আরও অনেকেই রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আমাদের মাতৃভাষা সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানের রয়েছে অনন্য অবদান যা আমরা অনেকেই জানি না।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায় যে সে আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রনেতা হিসাবে, আইন প্রণেতা হিসাবে রাষ্ট্র নায়ক হিসাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কাজ করে গেছেন আজীবন। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান অনেকেরই অজানা। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী অর্থনীতি, ভাষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিমাতা সুলভ আচরণ করে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী পূর্ব বাংলায় উর্দু কে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিতে চাইলে মূলত তখন থেকেই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই কলকাতার সিরাজদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী করণীয় বিষয় নির্ধারণে সমবেত কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি যেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যাপারে একমত হয়, সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঢাকায় ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠনের কর্মী সম্মেলনে ভাষা বিষয়ে কিছু প্রস্তাব উত্থাপন ও গৃহীত হয়। ভাষা সৈনিক গাজিউল হক বলেন----সেদিন সে কর্মী সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান পাঠ করেছিলেন এভাবে -- পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষা কে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎ সম্পর্কে আলাপ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহনের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক। এবং জণগনের সিদ্ধান্ত ই চুড়ান্ত বলিয়া গ্রহন করা হউক। এভাবেই ভাষার দাবি প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল।শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে ফিরে এসে তমুদ্দন মজলিস এর রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। অধ্যাপক ডঃ মযহারুল ইসলাম বলেন---- " শেখ মুজিবুর রহমান এই মজলিস কে রাষ্ট্র ভাষা সংক্রান্ত বহুকাজে সাহায্য ও সমর্থন করেন। " বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে বাংলা ভাষার দাবির স্বপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর খাজা নাজিমুদ্দিন এর বাসভবনে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে রাষ্ট্র ভাষা র দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান অংশ গ্রহণ করেন ও বক্তব্য রাখেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন রাজনীতিবিদ ও ১৪ জন ভাষা সৈনিক ভাষা আন্দোলন সহ অন্যান্য দাবি নিয়ে ২১দফা ইস্তেহার ঘোষণা করেছিল। এই ২১ দফর দ্বিতীয় দফা ছিল রাষ্ট্র ভাষা সংক্রান্ত। রাষ্ট্র ভাষা সংক্রান্ত যে পুস্তিকা সেদিন রচিত হয়েছিল তা ছিল একটা ঐতিহাসিক দলিল।এ ইস্তেহার প্রণয়নে সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষর দাতা এবং তার অবদান ছিল অন্যতম। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ডঃ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন ---- এই পুস্তিকাটি প্রকাশনা ও প্রচার পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের জন্য পাকিস্তান নামে র স্বপ্ন সম্পৃক্ত মোহভঙ্গের সুচনার প্রমাণ করে। এই পুস্তিকা যাদের নামে প্রদর্শিত হয়েছিল তাদের সাথে ছিলেন যেসব নিবেদিত প্রাণ কর্মী এদের একজন ছিলেন ফরিদপুরের শেখ মুজিবুর রহমান যিনি পরবর্তী কালে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ধর্ম ঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক তমুদ্দন মজলিস এর প্রধান আবুল কাশেম এর নেতৃত্বে এক মহাসমাবেশ হয় ।তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র রা ক্লাশ বর্জন করে সমাবেশে যোগ দেয়।এ ধর্ম ঘটে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে ডঃ মযহারুল ইসলাম বলেন ----- " এখানে উল্লেখ্য যে এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা য় শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দেন।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমুদ্দন মজলিস ও মুসলিম ছাত্র লীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পূনর্গঠন করা হয়।এ সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, সামছুল হক,অলি আহাদ,আবুল কাশেম,রণেশ দাশগুপ্ত,অজিত গুহ অন্যতম।
১৯৪৮ সালে ১১মার্চ রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সফল সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এ হরতালে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্দাব দেন এবং গ্রেফতার হন। ভাষা সৈনিক অলি আহাদ তার " জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫" গ্রন্থে লিখেছেন --- শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ থেকে ১০ মার্চ ঢাকায় আসেন ১১ মার্চ হরতালে শেখ মুজিবুর রহমান এতটা উৎসাহিত ছিলেন যে এ হরতাল তার জীবনের গতিধারা নতুন ভাবে প্রবাহিত করেন। রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন--- " রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন মূলত ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারি নয় মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ।
১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্য মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এর ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কারাবন্দি অন্যান্য নেতাদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান এ চুক্তি টি দেখেন এবং স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং এ চুক্তির শর্ত সাপেক্ষে শেখ সাহেব সহ অন্য ভাষা সৈনিকরা কারামুক্ত হন। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য সাধারন ছাত্র সমাবেশ হয়, সেখানে সভাপতিত্বে ছিলেন সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান। আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৯ সালে ২ বার গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে শেখ সাহেব জেলে থেকেও নিয়মিত আন্দোলন কারীদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দানকারী আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান ও আব্দুল মমিন একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে বঙ্গবন্ধু জেলখানা এবং পরে হাসপাতালে থেকেও আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন । ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিব এবূ তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারি কে শহীদ দিবস ঘোষণার দাবি জানান।
শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জন কাজ করে গেছেন। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করেছেন শেখ মুজিব। বিশ্ব সভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তার প্রথম সফল উদ্যোগ ছিল ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দান যা এক ঐতিহাসিক ক্ষণ হিসেবে স্বীকৃত।
এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক
বিষয়: এস ডি সুব্রত
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: