আরজ আলী মাতুব্বর: ঋষিপ্রতিম চিন্তাবিদ ও বস্তুবাদী দার্শনিক : এস ডি সুব্রত
প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২৩ ২১:২৩
আপডেট:
১৬ মার্চ ২০২৩ ২০:৪৭

দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর ১৯০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে বরিশাল জেলার অন্তর্গত চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামছড়ি গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এবং মৃত্যু বরণ করেন ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ । তার প্রকৃত নাম, আরজ আলী। আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাধে তিনি মাতুব্বর নাম ধারণ করেন। তিনি ছিলেন লোক দার্শনিক ও ঋষিপ্রতিম চিন্তাবিদ।
স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিবাদী এই বিশেষণ যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তিনি দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর। নিরন্তর সংগ্রাম, সংঘাত ও প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে আপন জীবন অভিজ্ঞতায় পরিচ্ছন্নবােধ অর্জন করেছিলেন। কৃষিকাজ ও আমিন পেশায় রত থেকেও এই অগ্রগামী মহাপুরুষ অবিচল আস্থায় সংস্কার ও অন্ধ আবেগের পশ্চাৎমুখীতাকে ক্ৰমাগত শনাক্ত করেছেন নিপুণভাবে। তার ওপর পাকিস্তানি শাসনামলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, মামলা ও মতপ্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। নিজের জন্মভূমি স্বাধীন বাংলাদেশেও মৌলবাদীসহ সমাজের বিভিন্ন মহল কর্তৃক নিগৃহীত হতে হয়েছে তাকে। সংস্কারবিমুখ মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য পাঠাগার স্থাপন, মানবকল্যাণে চক্ষু ও শরীর দান এবং দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, গণিত, কবিতা ও আত্মজীবনীসহ গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি রচনা করে গেছেন তিনি।
৭ কন্যা ও ৩ পুত্রের জনক এই মহতী ব্যক্তি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তাঁর লেখায় ও কর্মে। গ্রামের মক্তবে কিছুকাল পড়াশোনা করেন, যেখানে শুধু কোরআন ও অন্যান্য ইসলামিক ইতিহাসের উপর শিক্ষা দেয়া হতো। তিনি নিজ চেষ্টা ও সাধনায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন। ধর্ম, জগত ও জীবন সম্পর্কে নানামুখি জিজ্ঞাসা তার লেখায় ওঠে এসেছে। তিনি তার ৮৬ বছরের জীবনকালে ৭০ বছরই লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন পড়াশোনা করে। জ্ঞান বিতরণের জন্য তিনি তার অর্জিত সম্পদ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’। তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্যপদ (১৯৮৫), বাংলাদেশ লেখক শিবিরের ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৭৮) ও বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর (বরিশাল শাখা) সম্মাননা (১৯৮২) লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে মৃত্যুবরণ করেন।আরজ আলীর পিতার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। তার মা অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন। পরিবারে তারা ছিলেন পাঁচ ভাইবোন। পৈতৃক পেশা কৃষিকাজ দিয়েই তার কর্মজীবনের শুরু। কৃষিকাজের অবসরে জমি জরিপের কাজ করে তিনি আমিনি পেশার সূক্ষ্ম গাণিতিক ও জ্যামিতিক নিয়ম সম্পর্কে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন।
শৈশবে তার মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি তোলার দায়ে গ্রামের মানুষ তার মায়ের জানাজা পরতে রাজি হয়নি। শেষে বাড়ির কয়েকজন লোক মিলে তার মায়ের দাফন করেন। এ ঘটনা আরজ আলীর ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার বিরোধিতার এবং সত্যানুসন্ধিৎসা হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছিল।
আরজ আলী মূলত বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি অনেক অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন। আরজ আলীর রচনায় মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদী দার্শনিক প্রজ্ঞার ছাপ রয়েছে। মানবকল্যাণ ও বিশ্বধর্ম আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রদান, পাঠাগার স্থাপন ও রচনা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনি নিজ দেহ ও চক্ষু মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন। মাতুব্বর বরিশালের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির, অধ্যাপক মুহাম্মদ সামসুল হকসহ অসংখ্য সাম্যবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো। তার বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার কথা তিনি একাধিক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। তার লিখিত বইয়ের মধ্যে ‘সত্যের সন্ধান’, ‘সৃষ্টি রহস্য’, ‘সীজের ফুল’, ‘শয়তানের জবানবন্দী’ অন্যতম। আরজ আলীর রচিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এর মধ্যে তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি। এই বইগুলো হলো- ‘সত্যের সন্ধান’ (১৯৭৩), ‘সৃষ্টি রহস্য’ (১৯৭৭), ‘অনুমান’ (১৯৮৩), ও ‘স্মরণিকা’ (১৯৮৮)। আরজ আলী মাতুব্বর তার প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদও আঁকেন। বইটি লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে ‘সত্যের সন্ধানে’ শিরোনামে বইটি তাকে এলাকায় ‘শিক্ষিত ব্যক্তি’ হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিল। আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন একজন বস্তুবাদী দার্শনিক। বস্তুবাদ বা জড়বাদের মূলকথা হলো, জড়ই এ জগতের আদি উপাদান অর্থাৎ যাবতীয় বস্তুর মূল উপাদান জড় বা পরমাণু ও তার গতি। বস্তুবাদের মতে, এ জগতের যাবতীয় বস্তুই জড়ের আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ফলে উদ্ভূত হয়। পাশ্চাত্য দর্শনের জনক নামে খ্যাত থেলিসের মতবাদে প্রথম বস্তুবাদের সাক্ষাত মেলে।
আরজ আলী মাতুব্বর প্রশ্ন করতে ভালোবাসতেন।
শুধু প্রশ্ন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, সেগুলোর উত্তর সন্ধানের চেষ্টা করেছেন। মানুষের জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মনে কৌতুহল বা কোনোরকম প্রশ্নের উদয় হলে তিনি ‘বস্তুবাদ’ বিষয়টা নিয়ে নড়াচড়া করতেন। বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান এবং নিজের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তিনি নিজস্ব চিন্তার জগৎ তৈরি করতেন। একজন মননশীল দার্শনিক ‘আরজ আলী’ হয়ে উঠার পিছনে এক করুন ঘটনা আছে। আরজ আলীর কিশোর বয়সে তাঁর মা মারা যান। মা মারা যাবার পর তিনি হঠাৎ খেয়াল করলেন মায়ের কোনো ছবি তাঁর কাছে নেই। আসলে কোনোদিন ছবি তোলাই হয়নি। কিশোর বয়সের আবেগ থেকে তিনি বুঝলেন মায়ের একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। যখন মাকে দেখতে মন চাইবে তখন যেন দেখতে পারেন। তিনি বরিশাল শহর থেকে ফটোগ্রাফার এনে মৃত মায়ের ছবি করালেন ।সেই সময় গ্রামে ধর্মীয় কুসংস্কার আর গোঁড়ামি ছিলো প্রচন্ডভাবে। ছবি তোলা ছিলো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাঁর উপরে আবার মৃত মানুষের ছবি তোলার তো প্রশ্নই উঠে না। আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর মৃত মায়ের ছবি তুলেছেন- এটা মসজিদের ইমাম সাহেব জানতে পারার পর তিনি জানাজা পড়তে অস্বীকৃতি জানায়। কোন মোল্লাই সেদিন জানাজা পড়াতে রাজি হয়নি। আরজ আলী সেখানে প্রশ্ন তুলেন, ছবি তুলে ভুল বা দোষ করলে তিনি করেছেন তাঁর মৃত মা তো কোন দোষ করেননি, তাই শাস্তি দিতে হলে তাকে দিক, তিনি মাথা পেতে নেবেন। কিন্তু তাঁর মা একজন নামাজী এবং পরহেজগার মহিলা ছিলেন তাঁর জানাজাটা যেন ঠিকমত পড়ানো হয়।
ইমাম সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। এই ঘটনা আরজ আলীর মনে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলে এবং ধর্ম সম্পর্কে তাকে উৎসাহী করে তোলে।
তারপর থেকেই আস্তে আস্তে অন্ধকার, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয় আরজ আলীর। তাঁর লেখালেখির সবটাই ছিল ধর্মের নামে ব্যবসার বিরুদ্ধে। আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে মাতুব্বরের পক্ষে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এই সত্যান্বেষী মানুষটির জ্ঞানের পিপাসা মেটানোর জন্য নিজ জেলার পাবলিক লাইব্রেরিরই ছিল একমাত্র এবং শেষ ভরসা। তাঁর প্রেম ছিল দর্শনের সাথে৷ তবে দুঃখের বিষয় হলো লাইব্রেরিতে দর্শনশাস্ত্রের তেমন বই ছিল না।
ঘটনাক্রমে বিএম মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক কাজী গোলাম কাদির তাঁর শেখার প্রতি আগ্রহ দেখে যারপরনাই বিমোহিত হন এবং কলেজের লাইব্রেরি থেকে বই ধার নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
আরজ আলী তাঁর জীবনের ৮৬ বছরের প্রায় ৭০ বছরই লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন পড়াশোনা করে এবং এভাবেই সাধারণ একজন কৃষক থেকে হয়ে উঠেন প্রখ্যাত দার্শনিক। দর্শন ছাড়াও ইতিহাস, ধর্ম, বিজ্ঞান বিষয়েও ছিল তাঁর অসামান্য পান্ডিত্য যা মানুষকে আজো আলোড়িত করে।
এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক
বিষয়: এস ডি সুব্রত
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: