মুক্তিযুদ্ধের গল্প-০৫; একাত্তরের নরপশু : শাহান আরা জাকির পারুল
প্রকাশিত:
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৫৫
আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২০:১৭

গুড়ুম....গু....ড়ু.....ম....ঠা....ঠা .....ঠা।
গুলির শন্দে চারদিক উত্তপ্ত। নিশুতি রাতে গ্রামবাসী আতঙ্কিত। যে যার মত ছুটছে। সারি সারি মানুষ বন জঙ্গল পার হয়ে সামনে এগুচ্ছে। কেউ জানে না, কোথায় তাদের গন্তব্য।
সদর হাসপাতালের সামান্য দুরে, পাবনা জেলার শালগাড়ীয়া মহল্লায় ছোট্ট একটি বাড়ীতে বিধবা মায়ারাণী বাস করে। দু’বছরের রেয়তীকে নিয়ে মায়ারাণী বিধবা হয়েছিল। সুখের সংসার ছিল তার। স্বামী সুখেন্দু দাস হঠাৎ করে স্ট্রোকে মারা যান। মায়ারানী ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল। পরবর্তীতে এই বিদ্যেটুকু তার অমৃতের সন্ধান দিয়েছিল।
পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সংগ্রহ করে গভীর মমতা দিয়ে বাড়ীর আঙ্গিনাতে পড়ালেখা শেখাতেন। খুব তাড়াতাড়ি মায়ারানীর সুনাম ছড়িতে গেল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো তার যশ। ছাত্রছাত্রী বাড়তে থাকে।
গ্রামের দশজনের সহায়তায় একসময় মায়ারানী ছোটখাট একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলটির নাম দেন- “মায়ারানী পাঠশালা।”
রেয়তী মায়ের স্কুলেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে। পরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বি এ পাশ করে। ক্লাশমেট বিশ্বজিৎ এর সাথে প্রেম হয়। পরে সবার মতামতেই বিয়ে হয় ওদের। রেয়তী খুব সুন্দর গান করতো। ওর কন্ঠের কৃত্তন শুনে স্বর্গের দেবতারাও হয়তো নেমে আসতো। গুলির আওয়াজ আরও বেশী শোনা যাচ্ছে। রেয়তী অন্তঃত্তা। মায়ারানী অসহায়। গ্রাম প্রায় শূণ্য। দুচারটে বাড়ীর লোক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংসারের মায়ায় পড়ে আছে। এই গোলাগুলির মধ্যে রেয়তীর এই অবস্থায় কোথায় যাবে সে?
কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। মুহুর্তে আশাপাশ ফাঁকা হয়ে গেল। গোলাগুলি আরও বেড়ে গেল। গু-ড়.ম.গু...ম..। মনে হয় তাদের ঘরের কাছাকাছি কেউ চলে আসছে। রেয়তীকে জড়িয়ে ধরে মায়ারানী, হরিনাম জঁপতে লাগলো। এমন সময় বুটের ভারী আওয়াজে গা ছমছম করে উঠলো মায়ারানীর। কোই হ্যায়? দরজা খোল। ওমা...মা গো... মিলিটারী আমাগর বাড়ী ঘেরাও করছে। মাগো, আমাগরে মার্যা ফেলবি। এখন কি করব্যা মা? ভগবানকে ডাক মা। আর কোন উপায় নাই। রেয়তী মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকে। দরজায় বুটের লাথি পড়ে জোড়ে জোড়ে। দরজা খোল। কোই হ্যায়? মায়ারানী রেয়তীকে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ভগবানকে ডাকতে থাকে। এই কেডা আছস? মাসী দরজাডা খোল তো। ভয় নাই। আমরা এই পাড়ারই ছাওয়াল পাল। মায়ারানী একটু সাহস পায়। তুমাগরে সাথে আর কিডা আছে বাজান?
কয়জন মিলিটারী আছে। উরা তুমাগরে কিছুক্ষতি করবি নানে। উরা খুব বাল মানুষ। উন্যাদের নাকি ক্ষিধে লাগছে। দরজাডা খোল। উরা চিড়েমুরি কিছু খায়া যাবি নে। সহজ সরল মায়ারানী দরজা খুলে দিল। সাথে সাথে ঘুরে ঢুকে পড়লো সবাই হুরমুর করে। রেয়তীর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছে পাকি শকুনরা। বিশ্বজিৎ ভারতে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে, সে খবর নাদের আলী খুব ভালভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছে। এবার প্রতিশোধের পালা। মায়ারানীর আঁচলের নীচ থেকে হ্যাচকা টান মেরে রেয়তীকে বের করে আনে নাদের আলী। একজন মিলিটারীর গায়ের উপর ফেলে দেয়। শয়তানটার জিহ্বা দিয়ে যেন রস পরতে থাকে। মায়ারানী শকুনটার দু’পা জড়িয়ে ধরে।
বাবা, আমার মিয়াডা পুয়াতী। অরে ছাড়্যা দ্যাও বাজান। তুমার ছোড বোনের মত। আমি তুমাগের মায়ের মত। চুপ মাগী, কোন কতা কইস ন্যা। মা? কিসির মা? আমার বাপ তোরে নিক্যা করছিল নাহি? মিয়ালোক, মিয়ালোকই। থো ফালায়া তোর মা আর বুন। নাদের আলী ফুঁসে ওঠে। ও বাজান, আমার কথা শোন বাজান। চুপ্ থাক তো মাসী। তয় রেয়তী যহন পুয়াতী, অয় এই গাঁয়েই থাকবিনি। যা অওনের এই গরেই হবিনে। তুমি মাসী, অগো সাথে অন্যহানে যাও। কি কই বুঝবার পারতাছ না? তুমি না ছাত্র পড়াও? এইডা বুঝবার পারতাছ না ক্যা? মাইয়া মানুষ লয়া মর্দা মাইনষে কি করে?
ভগবান তোদের মাফ করবি না। তোদের পাপের শাস্তি হবি। মায়ারানী চিৎকার করতে থাকে। আইচ্ছা, শাস্তি হয়, হবিনি। অহন অগো সাথে যাও তো মাসী। যাও, যাও। তিনজন পাকসেনা টেনে হেঁচড়ে মায়ানীকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে গেল। রেয়তী ঘরে থাকলো, নাদের আলীসহ আরও কিছু আর্মী। সারা রাত ধরে রেয়তীর উপর চললো পাশবিক নির্যাতন। মায়ারানীও রেহাই পেল না পশুদের হাত থেকে। যৌবনে স্বামীকে হারিয়েছে। আজ পঞ্চাশোর্ধ মায়ারানী তার মান সম্ভ্রম বিসর্জন দেবে? জানপ্রাণ দিয়ে এতদিন যা রক্ষা করেছে, তা আজ নষ্ট হযে যাবে পশুদের হাতে? না! কিছুতেই না। অনেক কাকুতি মিনতির পরও পাকি শকুনরা মানলো না তার কথা। একটি রুমে আটকিয়ে রেখে পাকি শয়তান একজন ঢুকে মায়ারাণীকে জাপটে ধরলো। মায়ারানীর চোখে ভেসে উঠলো, রেয়তী ছেলে হয়ে জন্মালে এই বয়সেরই হোত।
ছেলের হাতে মায়ের সম্ভ্রম নষ্ট? এত বড় সাহস? পাকি শকুনটা মায়ারাণীর শাড়ী ধরে ঝটকা টান মেরে খুলে ফেলে, চিৎ করে ফেলে দেয় মেঝেতে। মায়ারানী প্রাণপন শক্তি দিয়ে পাকসেনার কোন এক স্পর্শকাতর অঙ্গে কামড় দিয়ে ছিয়ে ফেলে। পাকি শয়তানটা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়। কাতরাতে থাকে। ছুটে আসে অন্যসব মিলিটারী। হাতের কাছেই একটি ধারালো চাকু পায় মায়ারাণী।
একজন কাছে আসতেই বুকে বসিয়ে দেয়। ফিনকি মেরে রক্ত ঝরে। পাকি দস্যুরা আরও ক্ষিপ্ত হয়। কয়েকজন মিলে মায়ারাণীকে ধরাসাৎ করে ফেলে। এদের হাত থেকে আর রেহাই পেল না মায়ারাণী। সারা রাত তার উপর পাশবিক অত্যাচার করেও নরপশুরা ক্ষান্ত হোল না। মায়ারানীর বুক বরাবর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেললো। মায়ারানী অনেক অনুরোধ করেছিল, তাকে গুলি করে মারার জন্য।
কিন্তু তার প্রতিবাদী আচরনে শয়তানরা এতই ক্ষিপ্ত হয়েছিল যে, তাকে বেশী নির্যাতন করে মারলো। মেরে বাড়ীর পাশে মায়ারানীর ধান ক্ষেতেই বিবস্ত্র অবস্থায় ফেলে রাখলো। রাত ভোর হোল। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। হঠাৎ করে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলো। সূর্যের আলো যেন করুন আর্তনাদে মায়ারাণীর দেহ খানাকে ক্ষনিক মেঘে ঢেকে দিল। এদিকে, রেয়তী ঘরের মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। পাশবিক অত্যাচারে অন্তসত্ত্বা রেয়তীর রক্তস্রাব হতে হতে এক সময় শীতল হয়ে যায় দেহ। সারা গ্রাম শুন্য। পড়ে থাকে মা মেয়ের দুটি লাশ দুই দিকে। এভাবে কেটে যায় দুইদিন।
হঠাৎ আবার গুলির শব্দ। হ্যা, এদিকেই তো আসছে।
ঠা...ঠা...ঠা...গুড়ুম..গু..ম।
আবার কিসের গুলি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর।
বিজয়ের আনন্দে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় ধ্বনিতে জয়বাংলা রবে মুখরিত।
বিশ্বজিৎও ফিরে এসেছে। ধানক্ষেতের আল ধরে সারিবদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামে ফিরে আসতেই মায়ারানীর বিবস্ত্র বিভৎস লাশ দেখে চমকে ওঠে। লাশে পচন ধরেছে। ফুলে গেছে। চেনা যাচ্ছে না মোটেই। আরও অনেক লাশ পড়ে আছে এদিক সেদিক। মুক্তিযোদ্ধারা নাক চেপে ধরে যে যার বাড়ীর দিকে যায়। পুরো পাড়াইটাই ফাঁকা। লোকজন দু একজন ছাড়া বেশী কেউ নাই। গুলির আওয়াজে স্বাধীনতার কথা শুনে আস্তে আস্তে সবাই আসা শুরু করলো। মায়ারাণীর ছোট বোন মমতারাণী লাশ দেখেই চিনে ফেললো।
সে চিৎকার করতে করতে মায়ারাণীর ঘরে এসে রেয়তীকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়। রক্তের বন্যায় মুখ থুবরে নিস্তেজ পড়ে আছে রেয়তী। সারা মেঝেতে জমাট বাঁধা রক্ত। চাঁদের মত সুন্দর মায়াময় মেয়েটের এমন নৃশংস মৃত্যু গ্রামবাসী ভাবতেই পারছে না। বিশ্বজিৎ ফিরে এল। বিজয়ের আনন্দে ঠা ঠা করে গুলি ছুড়লো আঙিনায়। কিন্তু একি? তাদের ঘরে এত লোক কেন? বিশ্বজিৎ দৌড়ে গেল। সব দেখে শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। কিসের বিজয়?
কোন আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকবে সে? মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ায় বিশ্বজিতের পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলেছে মিলিটারীরা। এক লাইনে দাঁড় করিয়ে সমস্ত হিন্দু পরিবারকে ব্রাশফায়ার করে মেরেছে।
স্বাধীনতার দু’দিন আগে রাজাকার নাদের আলীর নেতৃত্বে এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ হয় গোটা গ্রামে। যুদ্ধশেষে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে সারা জীবনের জন্য সর্বশান্ত হয়ে গেল বিশ্বজিৎ। হায় ভগবান, এ তুমি কেমন শাস্তি দিলে আমাকে? কি নিয়ে বেঁচে থাকব আমি? আমার যে কিছুই রইলো না। রেয়তীর লাশের পাশে বসে বিলাপ করতে থাকে বিশ্বজিৎ। সব মুক্তিযোদ্ধারা মায়ারাণীর ও রেয়তীর লাশ আঙিনায় লাগানো পূজার লাল ফুল দিয়ে ঢেকে মায়ারানীর পাঠশালার পেছনে মাটি চাপা দিল।
জ্যোস্না রাত।
রেয়তী এ ঘরে বসে কৃত্তন করতো। গ্রামের মুসলমানরাও কান পেতে শুনতো। বিশ্বজিৎ তবলা বাজাত। মায়ারাণী বাজাত ঘন্টা । সব মিলে এক অপূর্ব সুরের সমাহার। এমন সুরেলা কন্ঠ ছিল রেয়তীর। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত সবাই। পুতুলের মত মুখখানা। বিশ্বজিৎ দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে পূজার ঘরে বসে থাকে। মনে হয়, ঐ তো রেয়তী সুর করে কৃত্তন করছে। দেবীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বিশ্বজিৎ। মা....মাগো, এ কেমন শাস্তি দিলে আমায়? এখন আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকব?
বিশ্ব, আয় বাবা আমার কাছে আয়। আমি তো মরিনি। কে? মমতা মাসী? হ বাবা। মিলিটারী সব্বারে মার্যা ফ্যাললো। আমাক মারব্যার পারে নাই। পায়খানার পেছনে পলায়া ছেলাম। হে...হে..হে....। মমতা রাণীর হাসি দেখে ভড়কে যায় বিশ্বজিৎ। কেমন পাগলের মত হাসছে মমতা মাসী। ভগবান সব দেখবে বাপ। চল্ চল্। আমরা দুই জনে ঘর বাঁধব নে হ্যাঁ?
বিশ্বজিৎ চমকে ওঠে। অ্যা, কি বলছে মাসী? তবে কি মাসী পাগল হয়া গ্যাছে? মমতারানী আপন মনে অনর্গল বিরবির করতে করতে চলে যায় অন্য দিকে। বিশ্বজিৎ স্বাধীন বাংলাদেশের সুধাময় মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার সন্ধান করতে থাকে। কে জানে কে দেবে তাকে স্বাধীনতার সন্ধান। শন্ শন্ শব্দ তুলে বৈরী বাতাস উদাস করে দেয় বিশ্বজিৎকে। মায়ারাণীর পাঠশালার সাইন বোর্ডটি যেন বিদ্রুপ করতে থাকে বাতাসে দুলতে দুলতে।
শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক
বিষয়: শাহান আরা জাকির পারুল
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: