আদি কৃষক নারী; গ্রামীণ জীবন কৃষির উপর নির্ভরশীল (১ম পর্ব) : রীনা তালুকদার
প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৪৪
আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২১:০৫

মানুষের আদিম পেশা হচ্ছে কৃষি। মাটির জৈবিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত সকল কাজকে বলা হয় কৃষি কাজ। এদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসাবে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের আশি ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কৃষির সাথে জড়িত। কর্মজীবনের অনেকাংশেই গ্রাম-বাংলার লোক সংস্কৃতিতেও কৃষি একটি স্থান দখল করেছে। বিশ্বের অনেক দেশ আছে যেগুলো শিল্প নির্ভর। কিন্তু বাংলাদেশে শিল্পের সে রকম পরিবেশ না থাকায় শিল্পে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে দীর্ঘ সময়েও শিল্পে অনেক কিছুই বাংলাদেশে রয়েছে। বাংলাদেশ একটি খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় অর্থের যোগানের অভাবে এসব খনিজ সম্পদ মানুষের ব্যবহার জন্য উত্তোলন বা কাজে লাগানো যায়নি বা এখনো আশানুরূপ ভাবে হচ্ছে না। সব সময়ই চেষ্টা চলে কিন্তু চেষ্টা আর আলোর মুখ দেখেনা। বাংলাদেশের এক সময় পাটের জন্য দেশে বিদেশে বেশ সুনাম ছিল। কিন্তু তারপর পাটের সে সুনাম আর ধরে রাখা যায়নি। হিমায়িত খাদ্য চিংড়ি, কাঁকড়া এবং পোশাক শিল্প এক নতুন বিপ্লব সূচনা করেছিলো।
কিন্তু বর্তমানে এ দুটো পথও সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পৃষ্টপোষকতার অভাবে আজ হুমকির মুখে। আমাদের মূল ভিত্তি কৃষিই এখন পর্যন্ত আমাদের একমাত্র জীবন জীবিকার শক্ত একটি মাধ্যম। যদিও নানা প্রতিকূলতা বিদ্যমান। উন্নত আবাসন শিল্প বা পরিকল্পিত বসবাস ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের আবাদী জমি চলে যাচ্ছে বাড়ী ঘর বানানোর আওতায়। কৃষক তার মেরুদণ্ড ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। গ্রামে বর্তমানে নব্বই ভাগ লোকের বসবাস। এ নব্বই ভাগ মানুষ কমবেশি কৃষির উপর নির্ভর। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ গ্রামে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের সচ্ছলতা এসেছে ঠিকই অন্যদিকে মানুষের অপরিকল্পিত নগরায়ন ও ব্যক্তি বসবাসের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এছাড়া জমি গ্রাস করার জন্য বর্তমান সময়ে একদল লোক মিশন চালিয়ে যাচ্ছে কিভাবে অন্যের জমি এবং সরকারী জমি, ফসলী জমি, নদী, খাল, বিল, পুকুর ডোবা, নালা ইত্যাদি দখল করে ভরাট করে বড় বড় হাউজিং বানাচ্ছে এবং নিজেদের উদর পূর্তি করছে। অন্যদিকে প্রচার করছে তারা মানুষের সেবা করছে।
বিশ্বের বয়স প্রায় ১৫০০ কোটি বছর। তাহলে পৃথিবীর সৃষ্টি আজ থেকে ৪৬০ কোটি বছর আগে। প্রাণের আবির্ভাব ১০০ কোটি বছরের মধ্যে। এ সময়ে কখন, কোথায়, কিভাবে মানুষের জন্ম তা কেউই সঠিক ভাবে বলতে পারেননি। তবে বিশেষজ্ঞদের অনুমানে হোমো ইরেক্টাসকেই প্রথম মানুষ হিসাবে আবিস্কার করা হয়েছে। তবে বনমানুষ ও হমিনিত্তের বংশের এ পৃথিবীতে আগমন ঘটে প্রায় ৩৫ লক্ষ বছর পূর্বে। যদিও তাদের অস্ট্রালোপিথেকাস জাতীয় অমানুষ মনে করে মতামত ব্যক্ত করেন অনেকেই। বিতর্ক যাই থাক এ হোমোইরেকটাস একজন মানুষ হিসাবে কাঁচা মাংস ঝলসে ভক্ষন করেছেন বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সে সঙ্গে পরবর্তী সময়ের ইতিহাসে দেখা যায় যে নেআন্ডাটাল মানুষ ইউরোপের তুষার যুগে কঠিন শীতে নিজেকে রক্ষা করে জীবন বাঁচিয়েছেন এবং সে সময় প্রিয় মানুষকে কবর দেয়ার প্রচলন শুরু করেছেন। তারপরই আবিস্কার হয় ক্রোমানীয় মানুষ। যার ধারাবাহিকতায় আজকের হোমোসেিিপয়েনস্ জাতি। ক্রমশ : তুষার যুগ হতে প্রস্তুর যুগ-মধ্যপ্রস্তুর যুগ- অস্ত্র আবিস্কারের যুগ এবং নব প্রস্তর যুগ। আর এ যুগে এসে মানুষ দেহ সজ্জার পাশাপাশি উৎপাদন শুরু করল। খাদ্যের জন্য আর প্রকৃতির উপর নির্ভর না করে নিজেরাই উৎপাদনে নেমে পড়ল।
উৎপাদনের সাথে গৃহ পশু পালন জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে ঘটিয়েছে এক নব বিপ্লব। এ নব প্রস্তর যুগই কৃষি ও পশু পালন যুগ হিসাবে আজকের বর্তমান সময় পর্যন্ত মানুষের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। নব প্রস্তর যুগের উত্থানের মধ্য দিয়ে ক্রমেই মানুষ চাষাবাদের কাজের সহায়ক হিসাবে বিভিন্ন দ্রব্যাদি আবিস্কার করে। শস্য উৎপাদনের পাশা-পাশি ফল মূল ও গৃহপালিত পশু ইত্যাদি মানুষের জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে দারুনভাবে অবদান রেখেছে। পরবর্তীতে সময়ে যখন বিনিময় ব্যবস্থার শুরু হয় তখন দ্রব্যের বিনিময়ে দ্রব্য বিনিময় হতো আর এভাবেই মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাত। সভ্যতার নতুন দিক উম্মোচন করে মুদ্রা ব্যবস্থা। মুদ্রা ব্যবস্থার পথ ধরেই শুরু হয় বাণিজ্যের প্রসার। বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা তারই একটি রূপায়ন। ক্রমেই মানুষ বিশ্ব বাণিজ্যকে গতিশীল করে মানুষের জীবন-জীবিকা সহজ থেকে সহজতর করে চলেছে। মানুষ গ্রাম থেকে শহর এবং শহর থেকে বিভিন্ন দেশ এভাবেই আজকের সভ্য পৃথিবীতে মানুষ মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে একটি কৃষি ভিত্তিক কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। কৃষি ব্যবস্থার গতানুগতিক ধারা থেকে বিশ্বায়নের যুগে খুব দ্রুতই উন্নতি লাভ করেছে বিশেষত:আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে। কৃষির যন্ত্রপাতি তৈরী ও ব্যবহার সহজতর হওয়ায় কৃষি ক্ষেত্রে এর সুফল মানুষ ভোগ করেছে অদ্যাবধি।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের অর্থনৈতিক দূর্বলতায় কৃষি গবেষণা সেভাবে অগ্রায়িত হতে পারেনি। তবুও যতটুকু সামর্থ আছে তাতে সাধারণ লোক সহ সকলেই বিংশ শতাব্দী শুরুর দিক হতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে টাক্টর এবং মাড়াই যন্ত্র অনেকটাই পরিশ্রম, সময় ও আর্থিক সাশ্রয় করাতে আমাদের কৃষকরা এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বঙ্গখাতের বাংলাদেশ অঞ্চলের গঠনরূপ তিন প্রকার যথা ঃ প্রাক্ ক্যামব্রিয়ান উচ্চভূমি, মধ্য গভীর খাত অঞ্চল ও চট্রগ্রাম ভঙ্গিল পর্বতমালা। এই হিসাবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ খাদ্যে বিশেষ করে ২০০০ সালে ধানে স্বয়ং সম্পূর্নতা অর্জন করেছে। ধান উৎপাদনে পৃথিবীতে বাংলাদেশের স্থান চতুর্থ এবং ২০০০-২০০১ অর্থবছরে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ছিল। কিন্তু ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যার কারনে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ কৃষির উৎপাদনের সঙ্গে তাল মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আমাদের একদিকে আবাদী জমি হাতছাড়া হচ্ছে অন্যদিকে অনাবাদী জমি পড়ে থাকছে। কৃষির সঙ্গে আরেকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটি হচ্ছে খাল-বিল, নদী-নালা গুলোও মানুষের বসবাসের দখলে চলে গেছে বা যাচ্ছে। ফলে কৃষির চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে এবং জনসংখ্যার চাপও বেড়ে যাচ্ছে। কৃষিতে আগের চেয়ে ফল কম নয় বরং হাইব্রিড পদ্ধতিতে এক ফসলী জমি দোফসলী বা তিন ফসলীতে পরিণত হয়েছে। পূর্বের কৃষকের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় হিসেব-নিকেশ ও ঔষধের ব্যবহার সঠিক ভাবে জানতনা।
বর্তমান সময়ে বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে এ বিষয়ে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। পূর্বে যেমন অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষই কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো। বর্তমান ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে কৃষি যোগান বাড়াতে শিক্ষিত লোকও বেকার যুবকরাও এগিয়ে এসেছে। এছাড়া কৃষি সেক্টরের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষিজ বিষয় গুলোকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে ওঠেছে। যা আমাদের অর্থনীতির একটি ইতিবাচক দিক। যেমন: হাঁস-মুরগি, মৎস, গো-খামার, ছাগল পালন ইত্যাদি। আবার এগুলোর বিষ্ঠা দিয়ে তৈরী সার ও জ্বালানি আমাদের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। তবুও অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত নগরায়নে আমাদের অর্থনীতি টালমাটাল।
লেখক: রীনা তালুকদার
কবি ও সংগঠক
বিষয়: রীনা তালুকদার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: