কালো বিড়াল : শ্রাবন্তী কাজী আশরাফী
প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৫৫
আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২১:০২

তখন আমি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হলে আমি এটাচ্ ছিলাম। হলের যে রুমটাতে আমি থাকতাম, সেখানে আমরা চারজন এলোটেড ছিলাম। কিন্তু দু’জনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা হলে থাকত না। যারফলে, রুমে আমরা দু’জন ছিলাম। আমার বাসা আবার ঢাকা হওয়াতে আমি প্রতি বৃহঃস্পতিবারই বাসায় চলে আসতাম। আর শনিবার চলে যেতাম। আমার রুমমেট কে প্রায়ই রুমে একা থাকতে হতো।
যার জন্য সেও রুম বদলে অন্য রুমে চলে যায়।
এরমধ্যে আমার পরীক্ষা শুরু হবার কারণে আমাকে হলেই থাকার উদ্দেশ্যে চলে আসতে হলো। রুম খালি, পড়াশুনাটা ভালভাবে করা যাবে এই কথা ভেবে মহা আনন্দ আর উৎসাহে আমি হলে চলে আসি। কিন্তু এবার হলে আসার পর কিছু অস্বস্তিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে থাকি। যেমন, সবসময় ক্লাসে বাাইরে যাবার আগে আমি রুমের দরজা জানালা ভাল তালা দিয়ে করে লাগিয়ে রেখে যাই। একদিন যথা নিয়মেই ক্লাসে যাই। ক্লাস থেকে ফিরে রুম গোছানোর সময় হঠাৎ কেমন যেন খুটখুট শব্দ কানে এল। প্রথমে ভাবলাম মনের ভুল। কিন্তু আরও কয়েকবার শব্দটা কানে যেতেই মনে হলো তা খাটের নিচ হতে আসছে।
খাটের নিচে তাকিয়ে দেখি কাল কুচকুচে চারটি বিড়ালের বাচ্চা ঘাপটি মেরে বসে আছে, আর জ¦লজ¦ল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের হলে আবার বিড়ালের ভীষণ উৎপাত। একটু ফাঁক পেলেই রুমে ঢুকে খাবার দাবারতো চুরি করে খেয়ে যায়। সেই সাথে তারা বিছানার উপর প্রাকৃতিক কাজটাও সেরে যেতে ভুল করে না। যারজন্য আমাদেরকে সবসময় সতর্ক থাকতে হতো। যাহোক, রুমে যেহেতু আমি একাই ছিলাম তাছাড়া বাইরে যাবার আগে রুম ভালবাবে চেক করে বন্ধ করে গিয়েছিলাম। তাই কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না বিড়ালের বাচ্চা কি করে রুমে আসল। তাছাড়া এদের কে আগে কখনো হলে দেখিনি। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার হার্টবিটটা ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে এবং আমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি।
মুহুর্তেই সব আজগুবি ঘটনা মনে হতে লাগল। বিভিন্ন ধরনের হরর মুভিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। অধিকাংশ হরর মুভিতে আমরা সাধারণত বিড়াল দেখে থাকি। বিড়ালের রূপেই তারা এসে থাকে এবং ওদের বর্ণনাটাও থাকে কালু কুচকুচে। ঠিক আমার রূমের বিড়াল ছানাগুলোর ওতাই। তবে কি এরা তারাই? আবার মনে হচ্ছে, দূর ছাই ভূত-প্রেত বলে কি কিছুই আছে নাকি? কিন্তু যখনি মনে হচ্ছে, তবে এরা রুমে এলো কিভাবে? তখনই ভয়ে কুঁকরে যাচ্ছিলাম। আমি যখন এ ধরনের সাত সতের ভাবছিলাম ঠিক ঐ মুহুর্তে আমার পাশের রুমের হাসির ডাকে সম্বিৎ ফিরে পাই। ওকে সব বলতেই ওতো হেসে কুটি কুটি।
ও বলল, আরে ওসব ভূত-টুত কিছু না। আমাদের হলের বিড়ালটা বচ্চা দিয়েছে। সবার রূমেই বিড়ালটা বাচ্চাগুলোকে রেখে আসে। ওর রুমেও রেখিছিল। ও বের করে দেবার পর আমার রূমে এসেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আমার রুমে ঢোকার তো কোন পথই ছিল না। তবে এলো কিভাবে? তখন হঠাৎ হাসি বলল আচ্ছা তোর রুমমেট রুমে আসেনিতো। তখন আমার মনে পড়ল, হ্যাঁ আমার রুমমেট রুম ছাড়ার পর, আমার রুমের দরজায় তালার ডুপ্লিকেট চাবিটা দিয়ে যায়নি। রুমটা অন্ধকার অন্ধকার লাগায় বাতি জ্বালাতে গিয়ে দেখি আমার বাল্বটা নেই। তখন নিশ্চিত হলাম আমার এক্স রুমমেট রুমে ঢুকে বাল্ব এবং ওর ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র নেবার সময় দরজাটা হয়তো খোলা রেখেছিল। আর ঐ সুযোগেই বিড়াল তার বাচ্চাদেরকে রেখে গেছে।
আমি আর হাসি দু’জন মিলে বাচ্চা গুলোকে বের করে দিলাম।
আর মনে মনে বেশ লজ্জা পেলাম এই ভেবে যে, আমি বাচ্চাদের মতো কিসব আবোল তাবোল ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম। যাহোক, সমস্যা সমাধান হয়ে গেল। নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালাম। পরেরদিন বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। কিন্তু পরীক্ষা থাকায় বাধ্য হয়েই ক্লাশে যাবার জন্য রেডি হতে হলো। এবার বেশ ভাল করে দরজা-জানালা বন্ধ করে গেলাম। ক্লাশ থেকে ফিরে আজকে একটি নতুন ঘটনা চোখে পড়ল।
দেখলাম আমার খাটের কোনায় অর্থাৎ আমার পড়ার টেবিলের নিচে পানি জমে আছে এবং কেমন যেন দূর্গন্ধ আসছে। বুঝলাম, বিড়াল রুমে ঢুকে প্রাকৃতিক কাজ সেরে গেছে। এবার কিন্তু আমি আমার এক্স রুমমেটের উপর প্রচন্ড ক্ষেপে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম সে কেন আমার অনুপস্থিতিতে বারেবারে রুমে ঢুকবে? তার তো এই রুমে আর কোন প্রয়োজন নেই। রাগে গজগজ করতে থাকলাম। আবার এই ভেবে বিড়ালের নিকট কৃতজ্ঞ হলাম যে, সে আমার বিছানায় কাজটি সারেনি। আমার বিছানায় যদি সে তার এই অতি প্রয়োজনীয় কাজটি সারতো তবে এই বৃষ্টির দিনে কি দূর্গতিই না হতো আবার। পরেরদিন থেকে সামার ভ্যাকেশন শুরু হওয়ায় রুমের সবকিছু ভালভাবে গুছিয়ে, রুম ভাল করে চেক করে এবং একটা নতুন তালা রুমের দরজায় লাগিয়ে ভালভাবে রুম বন্ধ করে নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে আসলাম।
আর ভাবলাম যাক এবার আর কারও পক্ষে রুমে ঢোকা সম্ভব না। কারণ নতুন তালার চাবিটা একমাত্র আমার কাছেই আছে। দীর্ঘ একমাসের ছুটি শেষে হলে ফিরে রুমে ঢুকে তো আমার “চক্ষু চড়কগাছ”। একি! আমার পড়ার টেবিলের নীচে আবার পানি জমে আছে। এবার পানির পরিমানটা যেন একটু বেশি। রুমে ও কেমন যেন একটা ভ্যাবসা গন্ধ। অনেকদিন রুম বন্ধ থাকায় এসব গন্ধ হতেই পারে। কিন্তু আমার এত সতর্কতার পরও বিড়াল কিভাবে আমার রুমে ঢুকে প্রাকৃতিক কাজ সারল?
তাই মাথায় ঢুকছিল না। আর পানির পরিমানটা দেখে মনে হচ্ছিল তারা স্ব-পরিবারেই একদিন এখানে অবস্থান করেছে। এটাও বুঝলাম না, একদিন তারা রুমে খাকল, শুধু ছোট বাহিরই করল, বড় বাহির করল না। সারা রুম খুঁজেও কোন কিছুর চিহ্ন পেলাম না। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না এটা কি করে সম্ভব? এবার তো কাউকে সন্দেহও করতে পারব না। কারণ চাবিটা একমাত্র আমার কাছেই ছিল। যা হোক, রুম পরিষ্কার করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই রহস্যের সমাধান খুঁজছিলাম।
আর বর্ষাকাল হওয়াতে, বাইরের ঝমঝম বৃষ্টি পড়া দেখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ আমার খাটের পাশে অর্থাৎ পড়ার টেবিলের কোনায় লাইট জ্বালাবার সুইচটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। ইউরেকা........
আমার রহস্যের সমাধান পেয়ে গেছি এবং কোথ থেকে বিড়ালের পিশু আমার রুমে আসে বুঝতে পারলাম। এটা আসলে কিছুই না। আমার রুমে পড়ার টেবিলের পাশটা ছিল বেশ স্যাঁতস্যাঁতে। বর্ষাকাল হওয়াতে এবং প্রচুর বৃষ্টি পাতের কারণে দেয়াল চুইয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে, তা এমন ভাবে জমে থাকত।
আর আমি ভাবতাম বিড়াল বেছে বেছে আমার পড়ার টেবিলটার নিচই পছন্দ করল, তার প্রাকৃতিক কাজ সারবার জন্য। এই ভেবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম যে, একটা বড় ধরনের দূর্ঘটনার হাত থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি।
যদি পানি কোন ভাবে কারেন্টের সংস্পর্শে আসত, তবে বিরাট দূর্ঘটনা ঘটতে পারত। আর দেরি না করে হোস্টেল সুপারকে ডেকে এনে আমার এই দূর্গতি দেখালাম এবং তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা নেবার জন্য অনুরোধ জানালাম। তিনি পরেরদিনই আমার রুম মেরামতের নির্দেশ দেন এবং আমার রুমের ভূতটাকে তাড়িয়ে দেন।
আসলে-
“ভূত-প্রেত কিছু নাই
মনের ভয়ে, ভয় পাই”
শ্রাবন্তী কাজী আশরাফী
প্রধান সম্পাদক, প্রভাত ফেরী ও
ডিরেক্টর, অস্ট্রেলিসিয়ান ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি (AIA), অস্ট্রেলিয়া
বিষয়: শ্রাবন্তী কাজী আশরাফী
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: