গল্প: চাওয়া পাওয়া (১ম পর্ব) : ড. বেগম জাহান আরা
প্রকাশিত:
১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৫৮
আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১০:৫১

রাত দেড়টার সময় এসে ঢুকলো সবাই। বিমান দেরি করার ফলে এই বিভ্রাট। এতক্ষন বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। হঠাত বাহরাইন বিমানবন্দরে রব উঠলো, বিমানে বোমা আছে। আর যায় কোথায়? সমস্ত যাত্রী নামিয়ে দিয়ে শুরু হল তল্লাশি। টানা তিন ঘন্টা চললো তল্লাশির কাজ। ফলে মাসকটে পৌঁছে দেখা গেল, জেদ্দার বিমান চলে গেছে। তাই সাতঘন্টা অপেক্ষা করে পরের বিমানে আসতে হয়েছে জেদ্দায়। কোথায় বিকেল পাঁচটা, আর কোথায় রাত দেড়টা?
ক্লান্ত সবাই। বিমান বন্দরে অপেক্ষা করার মত বিরক্তিকর ঘটনা আর কি হতে পারে? নাসিম কি বিরক্ত? দেরির জন্য তো কেউ দায়ি নয়। কপালে গেরো থাকলে সবখানেই ধরা খেতে হয়। জেদ্দায় নেমেও লাগেজ পেতে বেশ দেরি হল। উচ্চ রক্তচাপের রোগি শাহেরা খাতুন। সময়মত ঔষধ না খেলে মাথা ঝিম ঝিম করে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে এখন রীতিমত। হোক না ছেলের বাড়ি, এসেই শোয়ার কথা বলতে পারছেনা শাহেরা।
তের বছর পর ছেলে নাসিমের সাথে দেখা। কেমন যেন হয়ে গেছে ছেলে। ছত্রিশ বছর বয়সেই মনে হয় ছাপান্ন পেরিয়ে গেছে। রোগাটে শরীর একটু নাদুশ নুদুশ হয়েছে। ভালোই দেখাচ্ছে তাতে।কিন্তু মাথার চুল পড়ে গেছে অনেক। আর গম্ভীর হয়েছে বেশ। সারাটা রাস্তা বলতে গেলে কথাই বলেনি। মনে হয় মা আর ছেলে নয়, যেন দূরের কোন আত্মীয় বিমান বন্দরে নিতে এসেছে। এখনও কি মনে পুশে রেখেছে সেই অভিযোগগুলো? কেমন করে ওঠে শাহেরার বুকের ভেতর।
বৌ আর দুই বাচ্চা বাসাতেই ছিলো। দরজা খুলে দিলো বৌ রাবেয়া। দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশীর মেয়ে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালেখা করেছে। চাকরীও করে বাচ্চাদের একটা স্কুলে। পেছনে পেছনে এসে ঘা ঘেষে দাড়ালো জমজ দুই ছেলে রনি আর জনি। বয়স ছয়। দাদির সাথে আগে দেখা হয়নি তাদের । রাবেয়ারও না। পা ছুঁয়ে সালাম করলো রাবেয়া। ছেলেদের বললো, দাদিকে সালাম করো। নাসিম বেশ জোরে ক্যারিঅনটা মেঝেতে রাখলো। আঁতকে উঠলো শাহেরা। বলে, এত জোরে কেন বাবা? খেলনা আছে, ভেঙে যেতে পারে। তটস্থ হয়ে উঠলো বেটা। কথা না বলে বড়ো সুটকেসটা গড়িয়ে নিয়ে চলে যায় নাসিম ভেতরে।
অবাক হয় শাহেরা। এখানে আসার আগে তো ফোনে অনেক কথা হয়েছিল ছেলের সাথে। অনেক দিন থেকেই ছেলের বাড়ি আসার কথা। নাতিদের দেখার ইচ্ছে। সেই যে নাসিম দেশ ছেড়ে গেল, তারপর যোগাযোগ ছিলো না সাত বছর। কি যে দু:সহ সময় কেটেছে তখন শাহেরা আর তার স্বামী সাদেক আলীর। মায়ের উপর না হয় রাগ ছিলো কিন্তু বাবাতো তাকে প্রাণের অধিক বেশি ভালোবাসতো। নাসিমের রাগ ছিলো বাবার উপর। মা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে বাবা কেন সেটা মেনে নিলেন? তাই সে ক্ষমা করেনি বাবাকেও। সাত বছর পর খবর পেয়ে বাবা কতবার আসতে চেয়েছে জেদ্দায়। রাজি হয়নি নাসিম। বলেছে, কে নাসিম? সে তো মরে গেছে।
-এমন করে বলো না বাবা। কেঁদে কেটে বলেছে সাদেক আলী।
মা যখন বেত দিয়ে মারতো তখনো তুমি প্রতিবাদ করোনি। লেখাপড়ার সময় আমরা কত বেতের বাড়ি খেয়েছি। ওসব কথা কি মনে রাখতে হয় বাবা?
তুমিও মেরেছো অঙ্ক করাতে গিয়ে। শরীর কেটে রক্ত ঝরছে, ভোলা যায় না সেসব কথা।
বুঝতে পারি খুব ভুল হয়েছে। সেটা তো আর ফিরবে না বাবা। আমি চাই না ফেরাতে। আমার এখন কোনকিছুর অভাব নেই।
আমাদেরও নেই । তুই যা চাবি তাই দেবো। শুধু বাড়ি চলে আয়।
অভাব তখনো ছিলো না তোমাদের। একটা খেলনা ভেঙে গেলে মায়ের সে কি মার।
মা তোমার খেলনাগুলো রেখে দিয়েছে যত্ন করে, তোমাদের বাচ্চাদের দেবে বলে।
এখন আমার ঘরেই কত খেলনা এখানে ওখানে পড়ে থাকে। অথচ........
তুমি যে একেবারে খেলোনি সেটাও তো ঠিক কথা না বাবা।
কথা ঠিক। কিন্তু ছোট ভাইয়ের একটা খেলনা ভাঙার জ্ন্য কাপড় খুলে ন্যাংটা করে ঘরের বাইরে বের করে দেয়ার কথা শুনছো কোনদিন?
শেষ হয়ে যায় কথা সাদিকের। কিছু বলার থাকে না আর।
দিন যায়। আবার কথা বলে সাদিক। আর কথা তো একটাই, কি করলে নাসিমের রাগ পড়বে। সে বাড়ি আসতে চাইবে, সে জন্য সাজিয়ে গুছিয়ে প্রসঙ্গ টানা।
ড. বেগম জাহান আরা
সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সক্রিয় ভাষাবিজ্ঞানী এবং কথা সাহিত্যিক
বিষয়: বেগম জাহান আরা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: