ঋণ : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২৪ জানুয়ারী ২০২০ ১১:১৮

আপডেট:
১৪ এপ্রিল ২০২০ ০১:২২

 

চুলায় হাঁড়ি চাপিয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখে নিলীমা। পানি ফুটে টগবগ করছে। ঘরে এক মুষ্টি চাউলও নেই। ডাল, আলু, শব্জি কিছুই নেই।  পানি শুকিয়ে যায়। আবার পানি দেয়।  ফুটফুটে দুটি ছেলে মেয়ে নিলীমার। শান্তুনু আর অতনু। আজ চার পাঁচদিন স্কুলে যায় না। স্কুলের বেতন বাকী। রিক্সা ভাড়ার অভাবে পায়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসাতে দুজনেরই গা’টা গরম। জ্বরজ্বর ভাব।  
সকালে নাস্তাবানানোর মত আটাও ছিল না। পাশের দোকান থেকে বাকীতে চানাচুর মুড়ী এনে সবাই নাস্তার কাজ সেরেছে।  
নাস্তা খেয়ে শান্তনু আর অতনু আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
নিলীমা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে চোখ মোছে।
দুজনের পেটটা কেমন অভূক্ত মানুষের মত লেপটে আছে।
শাহ্রিয়ার ঐ যে বাজারের ব্যাগ হাতে বেরিয়েছে, আর ফেরার নাম নেই।
দুপুর গড়িয়ে এল।
বাচ্চা দুটোর ঘুম ভাঙ্গঁলেই খাবার চাইবে।
কি খেতে দেবে নিলীমা?
ধার দেনায় একাকার হয়ে গেল নিলীমার সংসার।
চুলার হাঁড়িটা ফোঁস ফোঁস করে ওঠে। নিলীমা ঢাকনা তুলে আবার পানি দেয়।
কত কথাই মনে পড়ে নিলীমার।
এমনতো ছিল না তাদের সংসার।
চারজন মানুষের স্বপ্নের জীবন ছিল।
শাহ্রিয়ার একটা বিদেশী কোম্পানীতে চাকুরী করতো।
ভাল বেতন পেত। প্রমোশন হয়ে কোম্পানী থেকে বাসা পাওয়ারও কথা ছিল।
হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল।
অফিসের আভ্যন্তরীন কোন্দলের শিকার হোল শাহ্রিয়ার।
মিথ্যে ষড়যন্ত্রে আচমকা চাকরীচ্যুত হোল।
নীলিমার জীবনে নেমে এল সুখের উল্টো পিঠ দুঃখের অমানিশা।
বাড়ী ভাড়া বাকী থাকায় বাড়ীওয়ালার দুর্ব্যহারে একদিন নিলীমা আর শাহ্রিয়ার, দিশেহারা হয়ে ছোট খাট একটা বাসা খুজতে বেরিয়েছিল।
হঠাৎ “ঞড় খবঃ” দেখে একটা বাড়ীর সামনে থমকে দাঁড়ায় শাহ্রিয়ার।
দেখতো বাড়ীটা.........
নিলীমা অবাক হয়।
এত বড় বাড়ী।
কি হলো এখানে দাঁড়ালে কেন? “ঞড় খবঃ” দেখে?
না, না।
তবে?
এটাতো মনে হচ্ছে আমার বন্ধু ইমতিয়াজের বাড়ী।
ইমতিয়াজ ভাই? বল কি?
নেম প্লেটের নামটা তো ওরই মনে হয়। কতদিন যোগাযোগ নেই।
এমন সময় প্রাইভেট কারের হর্ন শুনে দুজন সরে দাঁড়াল।
গাড়ী থেকে ইমতিয়াজ নেমে এল।
আরে, শাহ্রিয়ার না? দোস্ত তুই কোথা থেকে? ভাবী নাকি? আস্সালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম ইমতিয়াজ ভাই।
তা, কেমন আছিস দোস্ত?
বড় বিপদে আছি দোস্ত। বাসা খুজতে বেরিয়েছি।
বলিস কি? চল চল ভেতরে চল। আমার একটা ফ্ল্যাট খালি আছে।
নিলীমা আর শাহ্রিয়ার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।
না, না, দোস্ত আমরা চলি। এতবড় ফ্ল্যাট নেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
আরে ভেতরে চল তো। ওসব পড়ে দেখা যাবে।
ইমতিয়াজ টেনে ওদেরকে ঘরে নিয়ে যায়।
ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাট দেখায়।
দুই ইউনিট এর আটতলা বাড়ী।
চারতলার পুরো ইউনিট নিয়ে ইমতিয়াজ থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একসংগে পড়াশোনা করেছে ওরা।
একই রুমে থাকতো। ইমতিয়াজ ছিল ডাকসেল ছাত্রনেতা।
আর শাহ্রিয়ার নিরীহ মেধাবী।
পড়াশোনা নিয়েই থাকতো।
দুইজন দুই মেরুর।
অভাবী ঘরের গ্রামের ছেলে ইমতিয়াজ তার ভাগ্য পরিবর্তন করে ফেলেছে।
তবে অন্তরটা আগের মতই বিশাল আছে।
নীচতলার ফ্ল্যাটটিতে তা হলে তাড়াতাড়ি উঠে পর দোস্ত।
না, না দোস্ত, তুই জানিস না.....
কিচ্ছু জানতে হবে না। যা বলছি, তাই কর।
শাহ্রিয়ার এবার আর কোন দ্বিধাদ্বন্ধ না করে অকপটে তার ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা খুলে বললো।
সব শুনে ইমতিয়াজ হেসে বললো- দোস্ত তুইনা একসময় আমাকে বলতিস্ আল্লাহ্ যা করেন সবই মঙ্গলের জন্যই করেন।
হ্যাঁ তা তো অবশ্যই। এটাই চিরন্তন সত্য।
তবে আপত্তি করছিস কেন? ছাত্র জীবনে তুই ছিলি আমার বিপদের বন্ধু। আজ তোর বিপদে আমি থাকব না, তা কি হয়? নইলে, এমন অদ্ভুতভাবে তোর সাথে সাক্ষাত হবে কেন?
না, না ঠিক তা নয় ইমতিয়াজ ভাই?
তবে আপত্তি কেন ভাবী? মনে আছে দোস্ত, হঠাৎ বাবা মারা যাবার পর লেখাপড়া আমার বন্ধই হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। আর আপত্তি করিস না। সে সময় তুই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলি।
তারপর থেকেই নিলীমা এই ফ্ল্যাটে বাস করছে বিনা ভাড়ায়।
একবছর হতে চললো ভালই চলছিল।
চার পাঁচটা টিউশনি করে ইমতিয়াজ।
বছরের শেষ বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ।
নতুন ক্লাশ শুরু হতে দেরী।
তাই আপাততঃ টিউশনি বন্ধ। নতুন কোন কাজও যোগার করতে পারছে না। দুমাস ধরে এমন অবস্থা চলছে।
সঞ্চয়ের সব টাকাই শেষ।
আজ তিনদিন হোল বলতে গেলে উপোসই রয়েছে সবাই।
যখন তখন ইমতিয়াজ সাহায্য সহযোগিতা করে।
কত আর মানুষকে বিরক্ত করা যায়।
এবার আর নিলীমা তাকে কিছু জানায়নি লজ্জায়।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো জলে ঝাপসা হয়ে ওঠে নিলীমার।
ছেলে মেয়েরা ঘুম থেকে উঠে খাবার জন্য কান্না জুড়ে দেয়।
মা গো, ক্ষিধে পেয়েছে। খাবার দাও।
এই তো আর একটু হবে বাবা।
মিছে মিছে বাচ্চাদের শান্তনা দেয় নিলীমা।
কত দেরী হবে মা? অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।
তোমার বাবা এলেই খাবার দিব।
বাবা কখন আসবে?
এক্ষুনি এসে পড়বে সোনা।
না, আমাকে আগে দাও খেতে। বাবা পরে এলে খাবে। অতনু আরো জোড়ে জোড়ে কাঁদতে থাকে।
শান্তুনুও। দুজনের কান্না ক্রমেই বেড়ে যায়।
কী করবে ভেবে পায় না নিলীমা।
মিছে মিছি চুলার হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখে।
এই তো ভাত হয়ে আসছে।
তুমি মিথ্যে বলছো।
কান্নার আওয়াজ শুনে ইমতিয়াজ বাসা থেকে বাইরে যাবার পথে নিলীমার দরজায় নক্ করে।
দরজা খুলে নিলীমা চমকে ওঠে।
ইমতিয়াজ ভাই!
বাচ্চারা কাঁদছে কেন ভাবী?
নিলীমা চুপ করে থাকে।
ইমতিয়াজ বাচ্চাদের কাছে যায়।
কি বাবা তোমরা কাঁদছো কেন?
আঙ্কেল, মা খেতে দিচ্ছে না।
বল কি? এতবেলা হয়েছে। ভাবী রান্না করেন নাই?
করেছি।
তবে? দেখি কি রান্না করলেন? ইমতিয়াজ সরাসরি কিচেনে গিয়ে হাঁড়ির ঢাকনা তোলে। ফুটন্ত পানি টগবগ করছে।
ভাবী, এতো শুধু পানি।
নিলীমা হু হু করে কেঁদে ফেলে। সব ঘটনা খুলে বলে।
শাহ্রিয়ার আমাকে বলেনি কেন?
আর কত জ্বালাতন করবো আপনাকে? এমনিতেই তো আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। ঋণের বোঝা আর কত বাড়াবো ইমতিয়াজ ভাই!
ইমতিয়াজ দ্রুত বাসায় যায়।
ফ্রীজ থেকে মাছ, মাংস তরিতরকারী বের করে নিজে এনে দিয়ে যায়।
বাচ্চাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। নিজের ভাই মনে করে সবকিছু নিঃসঙ্কোচে জানাবেন ভাবী। আর শাহ্রিয়ার এলে অবশ্যই দেখা করতে বলবেন।
ঠিক এসময়েই শাহ্রিয়ার কিছু চাল, ডাল, আলু নিয়ে ঘরে ঢোকে।
ক্লান্ত অবসন্ন।
সারাশরীর ঘামে ভেজা।
শাহ্রিয়ার, দোস্ত আমার। কেন তুই জানাসনি আমাকে এসব কথা?
কত আর ঋণের বোঝা বাড়াব দোস্ত।
ওসব কথা পরে হবে। কাল সকালে অবশ্যই আমার সাথে দেখা করবি। কেমন? এখন বিশ্রাম নে।
পরদিন ইমতিয়াজের হজ্ব ফ্লাইটের টাকা জমা দেয়ার শেষ তারিখ। ব্যবসা বানিজ্যের সবকিছু গোছগাছ করে ফেলেছে হজ্বে যাবে বলে।
সারারাত গভীর ভাবে চিন্তা করলো ইমতিয়াজ।
ঘুম আসছিল না কিছুতেই।
ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো।
স্ত্রী রেহানা খেয়াল করছিল সব।
কি হয়েছে তোমার বলতো? এতরাতে ছাদে পায়চারী করছো।
রেহানাকে সব খুলে বললো।
কি করা যায় বলতো?
মুহুর্তে সব সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললো ইমতিয়াজ।
কিসের হজ্ব আমার?
কি হবে হজ্ব করে?
আমার চোখের সামনে ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যাচ্ছে একটি পরিবার।
হজ্বের এই টাকাটা যদি একটি বিপদগ্রস্থ পরিবারকে রক্ষা করে, তবে সেটাই হবে আমার প্রকৃত কাজ।
আল্লাহ্, তুমি আমায় মাফ করে দাও। আমাকে তৌফিক দাও, এরপরের হজ্ব যেন আমি পালন করতে পারি।
স্ত্রীকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
স্বামীর উদারতার গর্বে বুক ভরে যায় রেহানার।
পরদিন সকালে শাহ্রিয়ার ও নিলীমা দ্’ুজনেই যায় ইমতিয়াজের ঘরে।
ইমতিয়াজ একটি প্যাকেটে পুরো হজ্ব এর টাকাটা তুলে দেয় শাহ্রিয়ার এর হাতে।
প্যাকেট খুলে শাহ্রিয়ার অবাক হয়।
কিছু ভেবে পায় না।
এত টাকা!
এই প্রথম একসঙ্গে এতটাকা চোখে দেখলাম। কিসের টাকা দোস্ত!
এই টাকা দিয়ে কিছু একটা ব্যবসা শুরু কর দোস্ত। জীবন এভাবে চলতে পারে না।
কী বলছিস তুই? এত টাকা আমি পরিশোধ করব কিভাবে?
সে চিন্তা তোকে করতে হবে না।
না, না দোস্ত, এত বড় ঋণের বোঝা আমার ঘাড়ে চাপাস না।
কোন আপত্তি নয়। আগে বাঁচতে হবে। একদিন তুই আমাকে বাঁচিয়েছিলি। সে কথা তুই ভুলে গেলেও আমি ভুলে যাইনি দোস্ত।
দোস্ত, তুই তোর সুপ্ত মনের ঋণ শোধ করছিস, কিন্তু আমিতো ঋণী হয়ে গেলাম অনেক বেশী।
বিপদের সময় এমনি করে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা কিছুটা ঋণী না হয় হয়েই গেলাম দোস্ত, ক্ষতি কী?
দোস্ত!
শাহ্রিয়ার ইমতিয়াজকে বুকে জড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
আত্নতৃপ্তিতে ইময়িাজের চোখেও জল আসে।

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top