সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

অন্ধকারের গোলাপ : তিয়েন আন্দালিব (১ম পর্ব)


প্রকাশিত:
২৭ মার্চ ২০২০ ০৬:০৮

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:২১

 

--‘ও মতিন ভাই, একটা সিগারেট দেও ত দেহি।‘ কাশেম শার্ট থেকে পাঁচ টাকা বের করতে গিয়ে দেখে, টাকাটা নেই! কি আশ্চর্য ব্যাপার! টাকাটা একটু আগেও তো ছিল। কোথায় গেল? -কি সিগারেট দিমু? কাশেম বিমর্ষ মুখে বলে, স্টার দেন একটা। -চার টেকা দে।

কাশেম সিগারেট নিয়ে বলল,’ মতিন ভাই তোমার লগে মিছা কথা কমু না। একটু আগেও পকেটে পাঁচটা টাকা ছিল। এহন কিছুতেই খুইঁজা পাইতেছিনা। কই যে গেল টাকাটা... -মশকরা করস? আমার লগে মশকরা? এক্কেরে ঘুষাইয়া দাঁত ভাইঙ্গা ফেলমু! দে আমার সিগারেট।

-ভাই এই সিগারেটই আজকে আমার রাইতের খাবার। আর কিছু খাওনের নাই। পরে আমি টাকা দিয়ে দিমু নে। আমি তো টাকা কখনো না দিয়া থাকি নাই। -আইচ্ছা, যা ভাগ। চোখের সামনে থেকে ভাগ।

কাশেম মতিন মিয়ার দোকান থেকে উঠে এল। নিজের উপর অত্যন্ত বিরক্ত। পাঁচ টাকা অনেকক্ষন ধরেই তো শার্টের পকেটে ছিল। গেলটা কোথায়? হাওয়ায় উড়ে গেল নাকি? এতটা অসাবধান সে কবে থেকে হল? যাক মতিন ভাই সিগারেট দিয়েছে এটাই বড় কথা। মতিন ভাই মাঝে মাঝে খারাপ ব্যবহার করলেও মানুষটা খুবই ভাল। কতবার কাশেমকে বাকিতে চা খাইয়েছে।  পরে টাকা দিতে গেলে বলেছে,’ ওই কিসের টাকা? বড় ভাই ছোট ভাইরে চা খাওয়াছি। আবার টাকা দিতে হইব নাকি? ছাগল!’

কাশেম মমতা নিয়ে স্টার সিগারেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন সে এই সিগারেটের অর্ধেক খাবে। তারপর নিভিয়ে ফেলবে। তারপর রাতে ঘুমানোর আগে বাকি অর্ধেক খাবে। এতেই রাতটা কেটে যাবে। এখন রাতে ঘুম আসলেই হয়। সে পকেটের ম্যাচটা বের করে। ম্যাচে কাঠি আছে দুইটা। সে একটা কাঠি দিয়ে সিগারেটটা ধরায়। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে একটা চিন্তা মাথায় এল। গভীর রাতে ম্যাচের এক কাঠি দিয়ে যদি বাকি সিগারেটটা ধরাতে না পারে? তাহলে মহা ঝামেলায় পড়তে হবে। ম্যাচ পাবে কোথায়? মতিন ভাইয়ের দোকানও বন্ধ হয়ে যাবে। কি করবে তখন? বস্তির বাসাটায় কি ম্যাচ আছে? কাশেম একটা নিশ্বাস ফেলে বস্তির দিকে যেতে থাকে।

বস্তিতে নিজের ছোট বাসাটার সামনে এসে কাশেম দাঁড়ায়। সিগারেটটা নিভায়। তারপর অদ্ভুতচোখে বাসাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবু জন্ম নেয়ার আগে এই বাসাটা ছিল হালিমা আর তার এক সুখের আস্তানা। সে রেলস্টেশনে সারাদিন কুলির কাজ করে বাসায় ফিরত। কিছু বাজার করে আনত। হালিমা হাঁড়ি বসিয়ে রান্না করতে লেগে যেত। রান্না করার সময় কাশেম মুগ্ধ চোখে হালিমার দিকে তাকিয়ে থাকত। কি মায়া ছিল যে হালিমার মুখটায়! রান্নার ফাকেঁ ফাঁকে হালিমা বার বার তার বুকে এসে শুয়ে পড়ত। কি যে ভাল লাগত! কত হাসি, কত গল্প! রান্না হলে ওরা একে অপরকে খাইয়ে দিত আর সে কি হাসাহাসি। আহ কি দিন ছিল সেগুলো। কাশেম সেই দিনগুলোর কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। কিন্তু ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না। সে ছোট ঘরটার দিকে এগিয়ে যায়। বাবুটা ক্যা ক্যা করে কাঁদছে।

কাশেম বলল,’বাবু কান্দে কেন?’ হালিমা একটু চেঁচিয়ে উঠে,’ বাবু কানবে না তো আমি কানমু? এই বয়সে কান্নাকাটি করে বস্তি ভাসাইয়া দিমু?’ -না তা না। ওরে দুধ খাওইয়াছ? -হ মায়ের এই দুধই তো ভরসা। আর কি খাইবে? আছে কিছু খাওনের? - এই বয়সে শুধু দুধ খাওয়াই ভালা। -হ। তুমিও আহ, আমার দুধ খাও। খাইবা? -এসব কি কথা কও হালিমা? -আর কি কমু, তোমার খাইতে হইব না? এই অসুস্থ শরীলে কিছু না খাইলে তো মইরাই যাইবা।

-আমি কি আর অসুস্থ? শুধু কাইন্ধে একটু ব্যাথা। -হ এই একটু ব্যথার লাইগাই তো কাম কাজ বন্ধ হইয়া গেল। আর সারাদিন করটা কি শুনি? এখানে থাইক্যা বাবুটারেও তো একটু দেখতে পার! -দেখমু নে। কাল থেইকা দেখমু। আজ একটু ঘুরবার মন চাইল।

হালিমা কিছু বলল না। কাশেম হালিমার পাশে শুয়ে পড়ল। আজ অনেকদিন পর বড় ইচ্ছা করছে হালিমাকে বুকে টেনে নিতে। কিন্তু বাবুটা ক্যা ক্যা করে কেঁদেই যাচ্ছে। এত কাঁদছে কেন? এত কান্না তো সহ্য হয় না। বুকের মধ্যে ব্যথা লাগে । অনেক ব্যথা।

কাশেম হালিমার হাত ধরে বলল,’ বাবুটা আজ একটু বেশি কানতেছে না?’ হালিমা ঝটকা মেরে বলল,’ এই খবরদার! শরীরে হাত দিবা না। তোমার জন্য শরীর পাইত্যা বইস্যা নাই! নাও, বাবুরে ধর! বাবুরে নিয়া আমারে উদ্ধার কর।‘ হাশেমের মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। শুধু একটু হাতই তো ধরেছে। এতে এত রেগে যাওয়ার কি আছে? হালিমা কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে? অবশ্য বদলানোরই কথা। হাশেম বাবুকে নিয়ে বলতে লাগল, ‘ওরে আমার বাবা! আমার চান্দের বাবা! চান্দের বাবার কি হইছে? চান্দের বাবা হাসে না কেন? একটু হাইস্যা দেখা তো...

হাসেম বাবুকে পেটের উপর বসিয়ে নাড়াতে থাকে। একবার উপরে উঠায়, আবার ধপ করে পেটে বসায়। এভাবে কিছুক্ষণ চলতে থাকে। আর কি আশ্চর্য! বাবুটা ফিক করে হেসে ফেলে! হাশেমের বুকটা ধক করে উঠে। কি সুন্দর হাসি! এই ছেলেটা কি তার? এত সুন্দর ছেলের বাবা হওয়ার যোগ্যতা কি তার আছে?

কাশেম লাফিয়ে উঠে বলল,’এই হালিমা, দেখছ? হাসতাছে!’

হালিমা কিছু বলল না। পাশ ফিরে শুয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। বাবুটা তার বাবাকেই বেশি পছন্দ করে। বাবা তার সাথে অনেক ধরনের খেলা খেলে, যা সে পারে না। বাবার খেলায় মজা পেয়ে সে মাঝেই মাঝেই ফিক করে হেসে দেয়। তখন তাকে দেবশিশুর মত লাগে। তার বাবুটা এত সুন্দর হল কেন? সেও কি ছোটবেলায় এমন সুন্দর ছিল? বাবার বাচ্চা ভুলানো খেলায় মজা পেয়ে সেও কি ফিক ফিক করে হেসে দিত?

সকালে ঘুম ভেঙে হাশেম দেখে, হালিমা সাজগোজে ব্যস্ত। তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। আবার একই সাথে পেটের ক্ষুধা মিটবার আসাও যেন মনে উঁকি দিল। সে শান্তস্বরে বলল,’ হালিমা আজ কাম পাইছো নাকি?’

হালিমা বলে, ‘যে সাজা সাজতেছি, বুঝ না? জিজ্ঞেস কর কেন?’ হাশেম বলল,’ এক ফোটাঁ চা হবে কি হালিমা? চায়ের বড় চেষ্টা হইছে।‘ -বাসায় কিচ্ছু নাই জান না? চা হবে কই থেকে? তয় চিন্তার কিছু নাই। আজকে একটা বড় পার্টির কাছে যামু। অনেক টাকা পাওনের কথা। দুপুরে বাজার করে আনমু। চা পাতাও নিয়া আমুনে।‘ -আইচ্ছা। হালিমা সাজ গোজ শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’ দেহ তো আমারে কেমন লাগতেছে?’ হাশেম বুকে বিচিত্র এক কষ্ট অনুভব করে। তবু বলে,’বড়ই সৌন্দর লাগতেছে। তয় হালিমা...’ হালিমা বলে,’ কি?’ -একটু সাবধানে থাইকো।

-সাবধানে আর কি থাকুম? বেশ্যার আবার সাবধানে থাকনের কি আছে? -এভাবে কইয়ো না... -কিভাবে কমু? শরীরটাই তো খাবো আমার, আর তো কিছু না! -হালিমা এভাবে কইয়ো না। বুকে ব্যথা লাগে। -তাই নাকি? মলম কিইন্যা আনুম নে, বুকে মালিশ কইরা দিমু। কি কও? -এম্নে কথা কইতাছ কেন? -বেশ্যার স্বামীর আবার বুকে ব্যথা! হা হা। হাসাইলা তুমি হাসাইলা! কাশেম চুপ করে গেল। কি আর বলবে? সবই তো তার দোষ। হ্যা তারই দোষ। ভালই তো চলছিল সব। সারাদিন ট্রেনের মানুষের মালামাল বহন করে কঠোর পরিশ্রম করা। এরপর রাতে দু’চারটা ভাত খেয়ে শুয়ে পড়া। শোবার পর হালিমার সাথে বিচিত্র সব আনন্দের খেলা। পরে শান্তির ঘুম। এরমাঝে হটাত একদিন বাবুর জন্ম হল। কি যে আনন্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই ভুবনে তাদের চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। সারাদিন কাজ করে বাসায় ফিরে বাবুকে নিয়ে কি যে মাতামাতি! ঘন্টার পর ঘন্টা বাবুর সাথে অর্থহীন কথা বলা। খেলা করা। জড়িয়ে ধরা। চুমু খাওয়া। বাবু যেন আনন্দের ঢেউ হয়ে খেলা করতে থাকত। একবার বাবার কাছে। আরেকবার মায়ের কাছে।

 

তিয়েন আন্দালিব
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top