মুখোশ : আহসান হাবীব


প্রকাশিত:
২ এপ্রিল ২০২০ ০৬:১৪

আপডেট:
১২ নভেম্বর ২০২১ ০১:২৪

আহসান হাবীব

 

আফজাল সাহেব একজন সৎ সরকারী কর্মকর্তা। কখনো এক পয়সাও ঘুষ খান না। কিন্তু আর বোধহয় সৎ থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তার দিকের আত্নিয়স্বজন সবাই গাড়ি বাড়ি করে ফেলেছে, তার স্ত্রীর দিকের আত্নিয়স্বজনও বাড়ি গাড়ী করে ফেলেছে, আর তিনি এখনো ভাড়া বাসায় দিন আনি দিন খাই অবস্থা। কিন্তু অতি সম্প্রতি তার স্ত্রী তাকে অনুরোধ করেছে তার জন্য একটা মুখোশ কিনে আনতে। প্রথমে বুঝতে পারেন নি আফজাল সাহেব, হঠাৎ মুখোশ কেন?

করোনা ভাইরাসের কারণে আজকাল অবশ্য নানা রকম মাস্ক বের হয়েছে বাজারে, হয়ত সাবধানতার জন্য ঐরকম কোন মাস্ক বা মুখোশ কিনতে বলছে স্ত্রী।

- না না পুরো মুখ ঢাকে এরকম মুখোশ।

- আরে করোনা ভাইরাসের জন্য শুধু নাক মুখ ঢাকলেইতো হয় পুরো মুখ ঢাকার কি দরকার?

- আরে মর জ¦ালা... আমি করোনা ভাইরাসের মাস্ক চাচ্ছি না। আমার বোনরা এ সপ্তাহে বেড়াতে আসবে। তাদের আমি এই পোড়া মুখ দেখাতে চাই না...ওরা নিজেদের দামী গাড়িতে করে এসে তাদের নতুন ফ্ল্যাটের গল্প করবে। কাজেই ... আমি আর ওদের আমার এই মুখ দেখাতে চাই না। তখনই আফজাল সাহেব বুঝলেন খোঁচা ঠিক কোথায়! না, আর না অনেক সৎ থাকা হয়েছে ঘরের শান্তি আগে।

তিনি পরদিনই অফিসে গিয়ে তার পিয়নকে ডেকে পাঠালেন - স্যার?

- মবিন তোমার সাথে জরুরী কথা আছে

- স্যার বলেন

- ইয়ে... বলতে একটু অস্বস্থি লাগে আফজাল সাহেবের। তিনি কেশে গলা পরিস্কার করে বললেন ‘ ইয়ে মানে বুজছো মবিন যে দিনকাল পড়েছে ... তাতে করে এমনি এমনি কোন ফাইলে আর সাইন করা ঠিক হবে না। ’ আফজাল সাহেব খেয়াল করলেন মবিনের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

-  এই তো স্যার এদ্দিনে লাইনে আইছেন। স্যার যে দেশের যে ভাও। আর বলতে হবে না স্যার। আপনি খালি চেয়ারে গেট হয়া বইসা থাকবেন। কাম করারও দরকার নাই। বাকিটা আমি দেখতাছি। বলেই ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেল। এবং দ্রুত এক কাপ চা বিস্কুট রেখে আবার ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেল। দিনের শেষে একটা বেশ কারু কাজ করা চটের ব্যাগ ধরিয়ে দিল মবিন। তারপর গলা নামিয়ে ফিস ফিস করল

- স্যার?

- বল

- স্যার করোনা ভাইরাসের কারণে অফিসে লোকজন কম আসতাছে তাই আজ বেশি সুবিধা হইল না। তবে এখানে তিনটা প্যাকেট আছে। আপনে স্যার আজকে আার টেম্পুতে উইঠেন না। - তাহলে?

অফিসের গাড়ি একটা ম্যানেজ কইরা দিতাছি একদম আপনের বাসার সামনে নামায়া দিব, এখন থেকে স্যার গাড়িতেই যাইবেন। এতদিন লাইনে ছিলেন না বলে কিছুই পাইতেন না, এখন সব পাইবেন। আফজাল সাহেব চমৎকৃত হলেন। তিনি শুধু হ্যাঁ বলেছেন, তাতেই কত সুবিধা। একবেলার মধ্যে তিন তিনটা ভারি প্যাকেট... মাবুদে এলাহী ভিতরে কত টাকা আছে কে জানে। এক ফাকে তিনি জান্নাতবাসী পিতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন মনে মনে। কারণ তিনি তার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কখনো ঘুষ খাবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেন নাই... আফসোস। রুমাল দিয়ে চোখ মুছেন। আফজাল সাহেব গাড়িতে যেতে যেতে হিসাব করলেন এবার মনে হয় আস্তে ধীরে একটা ফ্লাটের বুকিং দেয়া যেতে পারে। কিন্তিতে একটা ছোট খাট গাড়ী...। আচ্ছা তিন প্যাকেটে কত টাকা থাকতে পারে? একটা প্যাকেটতো বেশ ভারী। মেয়েটাকে ভাল দেখে একটা দামী স্মার্ট ফোন কিনে দিলে কেমন হয়? মেয়েটা কি খুশীটাই হবে!

- এই এখানে একটু দাড়াওতো

- জি স্যার। গাড়ি থামলো একটা অত্যাধুনিক মোবইিল ফোনের দোকানের সামনে। তিনি কাচের দরজা ঠেলে ঢুকলেন।

- স্যার কি দিব?

- ভাল দেখে একটা স্মার্ট ফোন দেখানতো আমার মেয়ের জন্য।

- তারা মুহুর্তে চার পাঁচটা দামী দামী সেট আফজাল সাহেবের সামনে সাজিয়ে দিল। তিনি একটা পছন্দ করলেন ‘ এটার দাম কত?’

- স্যার এমনিত ৬৫ হাজার তবে আমরা এ সপ্তাহে স্প্যাশাল ছাড় দিচ্ছি.. একদাম ৪৫ হাজার।

- বেশ পাকেট করুন

- স্যার কি পেমেন্ট কার্ডে করবেন না ক্যাশে?

- ক্যাশে। বলে তিনি কারু কাজ করা চটের ব্যাগটার ভিতরের সবচে ছোট প্যাকেটটা টান দিয়ে খুল্লেন। একি? সুুন্দর করে সাজানো শ খানেক ( বেশিও হতে পারে) মাস্ক। নবেল করোনা ভাইরাসের মাস্ক। নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে কোনো! দ্বিতীয় ছোট পাকেটটা টান দিয়ে ছিড়েন। এটাতেও একই কাহিনী মাস্ক। তবে রং আলাদা। এবার বড় প্যাকেঁটটা ছিরলেন টান দিয়ে এটাতে ডজন খানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। মানে কি? নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোন ভুল হয়েছে কোথাও। - স্যার কোন সমস্যা? সেলস ম্যান জানতে চায়।

- একটু... ফ্যাকাশে ভাবে হাসেন আফজাল সাহেব। একটু সরে গিয়ে মবিনকে ফোন লাগান।

- হ্যালো মবিন?

- জি স্যার

- প্যাকেটে এসব কি?

- ক্যান স্যার মাস্ক আর স্যানিটাইজার পান নাই? দুইশ নীল মাস্ক আর দেড়শ কাল মাস্ক আর একডজন হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ও স্যার আপনেরে বলি নাই। ঘুষের বাজারে স্যার এখন এইগুলাই চলতাছে। এই জিনিষ স্যার আউট অফ মার্কেট। ফোন না কিনে কারুকাজ করা চটের ব্যাগটা নিয়ে বাইরে আসেন আফজাল সাহেব। এক ফেরিওয়ালা আড়াআড়ি লাঠির মাথায় ঝুলিয়ে নানারকম প্লাসটিকের মাস্ক নিয়ে যাছে। বানর সিংহ বাঘ হরিণ গাধা ... নানান ধরনের রংবেরংয়ের মাস্ক। আফজাল সাহেব গাধার মাস্ক একটা কিনলেন। না স্ত্রীর জন্য নয়, নিজের জন্যই।


আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট
সম্পাদক, উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top