সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

রিনার ভালবাসা : তিয়েন আন্দালিব


প্রকাশিত:
৩ এপ্রিল ২০২০ ০৮:০৫

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৩

 

করিম সাহেব মাগরিবের আযানের সুর শুনতে শুনতে একটা সিগারেট ধরালেন। আযান শুনতে শুনতে বিরক্তিতে তার ভ্রু কুঞ্চিত হল। এতো বেসুরো গলায় আযান দেয় কেন ওরা? আযাবের সুর হবে মধুর। মক্কার এশার আযানের মত মধুর। এসব বেসুরো আযান শুনতে কি আর ভাল লাগে? ইদানিং মাগরিবের আযান শুনলে করিম সাহেবের মন বড় বিষন্ন হয়ে যায়। এটা তো ভাল কথা না। আযান হচ্ছে আল্লাহপাকের রাস্তায় যাওয়ার জন্য আহবান। আর সেই আযান শুনে তিনি বিষন্ন হয়ে যাবেন, এটা কেমন কথা ?

করিম সাহেব একটা মিশ্বাস ফেললেন। বয়স হয়েছে, এখন ধর্মের দিকে মন দেয়া উচিত। অথচ তার মন ধর্মের দিকে যাচ্ছেই না। অনেকদিন হল এক ওয়াক্ত নামাযও পড়া হয় নি। বড়ই চিন্তার বিষয়। অনেক পাপ কামানো হয়ে যাচ্ছে । করিম সাহেব তার স্ত্রী শরিফাকে ডাক দেন, শরিফা! ও শরিফা! শরিফা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন, স্বামীর ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসে বলেন, ‘কি হয়েছে? ডাক কেন? করিম সাহেব বলেন, বস একটু আমার পাশে। পাশে বসতে বসতে শরীফা আতঁকে উঠে বলেন, একি! তুমি সিগারেট ধরিয়েছ কেন? ডাক্তার না বললেন সিগারেট একদম নিষেধ? করিম সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। গত বছর হটাত করেই হার্ট অ্যাটাক টা হল।

এরপর থেকেই শুরু হয়েছে দুনিয়ার সব বিধিনিষেধ। সিগারেট বন্ধ করতে হবে, গোশত খাওয়া যাবে না, তেল চর্বি খাওয়া যাবে না, আরো কত কি খাওয়া যাবে না! সব বন্ধ করুক ঠিক আছে, কিন্তু সিগারেট? সিগারেট ছাড়া তিনি কিভাবে থাকবেন? গরুর গোস্তও তার ভীষণ প্রিয়। গরুর গোস্ত না খেলে খাবারটা মনে হয় অসম্পূর্ণ থেকে গেল। তৃপ্তি পাওয়া যায় না। এক বছর ধরে তৃপ্তি ছাড়াই খেয়ে যাচ্ছেন। কি আর করবেন! কিন্তু সিগারেট খেতে হয়, লুকিয়ে লুকিয়ে এখনো অনেক সিগারেট খেয়ে যান। কেউ টের পায় না। গত বছর ইন্ডিয়ায় গিয়ে হার্ট এটাকটা হল। তখন মেয়ের অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তিনি ভাবলেন, সবাইকে নিয়ে একটু ইন্ডিয়ায় ঘুরে আসা যাক। ঘুরে আসাটা কাল হল।

কলকাতার নিউ মার্কেটে সন্ধ্যায় হটাত হার্টটা যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করল! হার্ট এটাকের সময়ও স্পষ্ট মনে আছে মেয়েটা চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলল,’বাবা! বাবা! বাবাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচব মা?’ আহা, মেয়েটা ধরেই নিয়েছিল তিনি আর বাঁচবেন না। কিন্তু বেঁচে গেলেন। আল্লহর অসীম দয়া। মেয়েটা তার ছোট থেকেই বড় বাবা পাগল হয়েছে। বাবাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। তিনি রিনার দৃষ্টি থেকে বাইরে গেলেই রিনা কেঁদেকেটে অস্থির হত! শরিফা হিমশিম খেত রিনাকে সা্মলাতে গিয়ে। অস্থির হয়ে বলতে থাকত, ‘মা আমি আছি না? আমি তো আছিই তোর পাশে!’ কিন্তু বাবা না আসা পর্যন্ত রিনার কান্না আর থামত না। একটাই মাত্র মেয়ে তার। মেয়েকে নিয়ে বড়ই দুশিন্তা হয় ইদানিং। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম পর্যন্ত আসে না। ঘুমালে দুঃস্বপ্ন দেখেন। দুঃস্বপ্নে প্রায়ই দেখেন রিনার সাথে এক খারাপ ছেলের বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা রাতে মদ টদ খেয়ে বাসায় ফিরে রিনাকে মারধর করছে! স্বপ্নের ভেতরেই তারঁ চোখে পানি এসে যায়। ‘কি ব্যাপার কথা বলছ না কেন? সিগারেট খাচ্ছ কেন?’

করিম সাহেব তার স্ত্রীর দিকে একটু হেসে বলেন, ‘আজ মনটা বড় খুশি শরিফা। তাই একটু খাচ্ছি। কিছু হবে না। শোন, একটা আনন্দের খবর আছে!’ -কি আনন্দের খবর? -মেয়েটার তো বিয়ে শাদী করাতে হবে, নাকি একটা ফাস্ট ক্লাস পাত্র দেখে এলাম।  জার্মানি থেকে পি এইচ ডি করা। দেখতেও রাজপুত্রের মত। রিনার ছবি থেকে ভীষন পছন্দ করেছে। বিয়েটা পাকা করে ফেলি, কি বল? শরিফা একটু ভেবে বলেন,’ এখনই পাকা করে ফেলবে কেন? রিনার তো একটা মতের ব্যাপার আছে।‘ -রিনার মত আবার কি? আমাদের মতই রিনার মত। এরকম ব্রাইট একটা ছেলে কি হাতছাড়া করা ঠিক হবে? তুমি গিয়ে রিনাকে ছেলের ছবি দেখাও। এই ছেলেকে পছন্দ না করার কিছু নেই। অকে বল বিয়ের জন্য তৈরি হতে!’ -আচ্ছা, রিনাকে বলছি ব্যাপারটা!

শরিফা চলে যাওয়ার সময় করিম সাহেব স্পষ্ট দেখলেন, শরিফার চোখে জল। কি আশ্চর্য! চোখে জল আসবে কেন? একটা আনন্দের সংবাদ দেয়া হল, এখানে চোখে জল আসার কি আছে? মেয়েমানুষদের নিয়ে এই হচ্ছে মুশকিল। কিছু একটা হলেই চোখে জল এনে ফেলবে! এটা কি আনন্দের জল ছিল নাকি অন্য কিছু? শরিফা পাত্রের ছবিটা মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকেন। আসলেই রাজপুত্রের মত ছেলে। এমন সুন্দর ছেলে খুব কমই দেখেছেন তিনি। কিন্তু রিনা কি এই ছেলেকে পছন্দ করবে? শরিফা উত্তরটা জানেন। রিনাকে তিনি খুব ভালমত চিনেন। ছোটবেলা থকেই রিনা কি চায় না চায় তা তিনি চট করে বুঝে ফেলতেন। আজও বুঝেন। রিনা প্রায়ই বাসায় বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা মারে। শরিফার বেশ ভালই লাগে। তারা হই চই করে বাসাটা মাতিয়ে রাখে। একসাথে সিনেমা দেখে, গান করে।

মাঝে মাঝে তো নাচতেও দেখা যায়। তাদের রান্না করে খাওয়াতে বড়ই ভাল লাগে। আত্মায় কেমন যেন একটা শান্তি এসে যায়। সুমন ছেলেটা তার রান্নার এত প্রশংসা করে, তিনি লজ্জায় মরে যান। প্রায়ই বলে, ‘আন্টি আপনার রান্নার হাতের তুলনা নেই!, ‘আন্টি ইচ্ছা করে দিনে চারবেলা করে আপনার হাতের রান্না খাই!’ সুমন ছেলেটা কি তাকে খুশি করার চেষ্টা করে? মনে হয় না। ছেলেটার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যায়, অত্যন্ত সরল একটি ছেলে। বেশ ভাল ছেলে। এই ছেলেটা বাসায় এলেই রিনার চোখ মুখ অন্যরকম হয়ে যায়। আনন্দে চোখ মুখ ঝলমল করে উঠে। অকারণেই হাসতে শুরু করে। কিছুই চোখ এড়ায় না শরিফার। একদিন তো দেখলেন, রিনা আর সুমন হাত ধরাধরি করে টিভি দেখছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। তিনি ইচ্ছা করেই দুকাপ চা বানিয়ে তাদের কাছে নিয়ে গেলেন।

রিনা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে বলল,’ মা দেখ, সুমনের হাতটা না একদম মেয়েদের মত। ছেলেদের হাত এরকম হলে মানায়? কে এমন মেয়েলি ছেলেকে পছন্দ করবে বল?’ শরিফা একটু হেসে বললেন,’ যার করার কথা, সে ঠিকই করবে। সুমন লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে বলল,’আন্টি বসেন না আমাদের সাথে। টিভি দেখি।‘ -না বাবা। তোমরা দেখ। আর চা টা গরম গরম খেয়ে নাও। শরিফার সুমন ছেলেটাকে খারাপ লাগে না। সহজ সরল ছেলে। রেজাল্টও নাকি খুব ভাল করে। আর তার সাথে কি সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলে! যেন আপন চাচির সাথে কথা বলছে। কথাবার্তার ধরনও বেশ মার্জিত। চেহারাটাও ভাল। এরকম একটা ছেলের সাথে যদি তার মেয়ে সম্পর্কে জড়ায়, তাতে দোষের কি?

কিন্তু এটা তো আর রিনার বাবা বুঝবে না। সে একরোখা ধরনের মানুষ। নিজে যা বুঝে তাই করে। তার উপর কোন কথাও বলা যায় না। তার মতের বাইরে গেলেই সে ভীষণ গম্ভীর হয়ে পড়ে। কারো সাথে কথা বলে না। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে না। একটু পর পর মেজাজ গরম করতে থাকে। একটা অসহ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। শরিফার তখন মনে হয়, দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে! শরিফার নিজের যৌবনের কথা মনে পড়ে গেল। সুমনের মত এরকম একটা ছেলেকেই কি তিনি ভালবাসতেন না? সব সময় মানুষটার চোখের কোণে পানি লেগে থাকত। মনে হত একটু বকা দিলেই বুঝি কেঁদে ফেলবে। কি নরম ছিল মানুষটার মন! একদম দীঘির জলের মত টলটলে। শরিফা কতই না ভালবাসতেন মানুষটাকে! মানুষটাকে ছাড়া জীবন কল্পনাও করতে পারতেন না। দিন রাত তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু শরিফার বাবা মানুষটাকে পছন্দ করলেন না। শরিফা পছন্দ করে জানতে পেরে একদিন বাসা থেকে অপমান করে বের করে দিলেন।

 

তিয়েন আন্দালিব
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top