ঘাটিয়াল (পর্ব এক): মহি মুহাম্মদ
প্রকাশিত:
২৭ জুন ২০১৮ ১৬:৫৩
আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ১৪:০৩

এমন সময় মেঘ! কল্পনাও করা যায় না। দুপুরেও রোদ ছিল। এ সময়টা মেঘের নয়। আকাশে ফিনফিনে মেঘ থাকতেই পারে। হাওয়াটা বেশ নরম হয়ে আসে। শিরশিরে ভাবটা এ সময় মন উচাটন করে। কিন্তু হালকা মেঘের ভাবটা বেশিক্ষণ রইল না। মেঘটা জমেই গেল। এখন আকাশে কোনো আলো নেই। ঠান্ডা বাতাস। গা-টা শিরশির করছে। নদীর পানিটা কমছেই না। এ বছর এত বৃষ্টি কেন? আকাশের হলটা কী? অভয়ের মাথাটা গরম হয়ে ওঠে। লোকজন যেন ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসছে! এই তো দেখেছিল রাস্তাটা ফাঁকা। সাপের মতো অনেক দূর এঁকেবেঁকে গেছে। এখনি কোত্থেকে দুজন এসে বকের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
থাক বেটা। পারব না। দড়ি টানতে টানতে হাতে ফোস্কা পড়েছে। হাতের মধ্যে চাট। খুব শক্ত। মাঝে মধ্যে অভয় নোখ দিয়ে খুঁটে। লাভ হয় না। চামড়া খুব কঠিন। চিমটি কেটেও ধরতে পারে না।
অভয়ের মেজাজ তেঁতে যাচ্ছে। হাতের তালু লাল হয়ে উঠেছে। একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু লোক দুটোর তর সইছে না। সমানে চিৎকার করছে।
মাঝি, ও মাঝি। মাঝি, ও মাঝি।
কিন্তু সে দক্ষিণে তাকিয়ে রইল। উত্তর দিকে হাওয়া দিচ্ছে। দক্ষিণে আকাশ ফ্যাকাশে। না বৃষ্টি মনে হয় আসবে না। বাজার বার। লোকজন একটু আসবে বই কি! কিন্তু বৃষ্টি হলে তো লোকজন তেমন হয় না। আজ হলো কি! আসছে তো আসছেই।
ঐ দেখ আরো দুজন এল। মর বেটা।
কেন অভয়ের মাথা গরম হল? ভাবতে থাকল সে। বুঝতে পারছে না। আকাশে মেঘ জমেছে তাই। মেঘ তো জমতেই পারে। জমুক। যতো ইচ্ছে জমুক। তার কি! সে আছে, আর এই ঘাট। লোকজন আছে। আর আছে নদীর জল। ¯্রােতের মধ্যে খেয়া নিয়ে পারাপার করাই তার কাজ। কি কারণে মনটা আইঢাই করছে। বাগ মানছে না।
এ কি! এ যে বৃষ্টির দিন! মাইরি এরকুম কইরে ঘিরে নিলি! আলোটা নিভে গেলে কেনে? মেঘগুলান কততুন আইসছে? দুমড়ে দুমড়ে আইসছে। ঐ দ্যাখ এক ভাতারখাকি কেমুন করে ছুটছে। ঢেঙ্গা একটা বড় মেঘের চাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল অভয়। উহু, তর সইছে না বেটির। যা যা খসা। জল খসা, জল খসা। বিশ্রি একটা গাল এল অভয়ের মুখে। এ ধরনের গাল দিয়ে ও আরাম পায়। মাথাটা বুঝি একটু হালকা লাগছে এবার!
কার উদ্দেশে এ কথা। কাছে কিনারে কেউ দাঁড়ালে বুঝতেই পারত না। এমন প্রায়ই হয়। সে আনমনে কথা বলে। বিড়বিড় করেই যাচ্ছিল অভয়। এমন সময় গালির শব্দটা কানে এল। টিংকু ত্রিপুরা। মেয়েটা কেমন বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে আরো দুটো মহিলা আছে। পুরুষ দুটো কারো ক্ষেতের কামলা। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে এলেও এখন শকুনের মতো চোখ করে মেয়ে দুটিকে দেখছে। মেয়ে দুটো নির্বিকার। অভয়ের চিৎকার দিতে ইচ্ছে করল।
আরে ও টিংকু তোর দিকে শকুন চাইয়ে আছে। সামলা নিজেকে সামলা। না শালার বিটি শুইনছে নাই। যা মরুক গে। উয়ে কি একলা সবাইকে বাঁচাইতে পারবে! টিংকুকে দেখে ভাবল সে, ওকে মজাতে পারলে লাভ হতো বেশি। তবে প্রথম জামেলাকেই পার করবে সে।
সে সামান্য ঘাটিয়াল। পশুদের সঙ্গে লড়ার করার মতো শক্তি তার নাই। থাকলে কবেই তো জামেলারে নিয়ে চলে যেত। যা হোক, ভেবেছিল ওপারে যাবে না। কিন্তু গেল। ওদের কথা চিন্তা করেই গেল। টিংকুর দিকে তাকিয়ে অভয় ওকে সাবধান করল।
টিংকু তুকে বইলেছি, উই যে বড়–য়া পাড়ার দামড়াটা থেকে সইরে থাকিস।
টিংকু হাসে। অভয় ওকে দেখতে পারে। বোঝে সে। আরো কিছু কথা ঘাটিয়ালের চোখে আছে। তার অনুবাদ করা হয় না টিংকুর।
কিল্লাই কি হইল?
আইজকেও উয়ে তুর কথা বইলে যাইচ্ছে।
কি বইলছে।
তুকে দেখে লিবে।
কি আর দেইখবে। শালার বেটা আমদের পাড়ায় গেলে তাক্কল দা দিয়ে কোপাব।
টিংকুর কথা ঘাটিয়ালের মুখ আলো উদ্ভাসিত হয়। টিংকু নেমে গেলেও পারে কড়ির জন্য কোনো তাড়া দেয় না ঘাটিয়াল। টিংকুর সঙ্গে থাকা মেয়েটি ডানা দিয়ে গুঁতো মারে। টিংকু দুষ্টু মার্কা হাসি হেসে খুঁটে টাকা দুটো লুকিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। টিংকুর পথের ওপর শুয়ে থাকে ঘাটিয়ালের চোখ। টিংকুর জন্যই যেন ঘাটিয়ালের টান। তাই পেছনের মানুষের ডাক তার কানে যায় না।
চলবে --
মহি মুহাম্মদ
বিষয়: ঘাটিয়াল মহি মুহাম্মদ গল্প
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: