দেনমোহরঃ নারীর অধিকার ও সামাজিক বাস্তবতা : মোঃ শামছুল আলম
প্রকাশিত:
১৯ আগস্ট ২০২০ ২২:৫৯
আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৮:৫০

প্রাক ইসলামী সকল সমাজে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ছিল নারী। আইয়্যামে জাহেলিয়াতে অর্থাৎ মূর্খ যুগে আরবেও ছিল নারী অত্যন্ত নিম্ন মানের পণ্য-সামগ্রী। কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ ছিল অত্যন্ত অপমানজনক, যার দরুন কোনো কারণ ছাড়াই অধিকাংশকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। যারা বেঁচে থাকত তাদেরও সহ্য করতে হতো বিভিন্ন রকমের জুলুম-নির্যাতন। স্বামীর মৃত্যুর পর পরিত্যক্ত সম্পত্তি পাওয়া তো দূরের কথা, অন্যান্য পণ্য-সামগ্রীর মতো মিরাসের সম্পত্তিরূপে উৎসর্গ ও আত্মত্যাগের উপমা নারীকেই চলে যেতে হতো অন্যের কাছে! পক্ষান্তরে ইসলাম নারীকে দিয়েছে যথাযোগ্য অধিকার এবং সম্মানজনক মর্যাদা। প্রতিহত করেছে জুলুম-অত্যাচার। মানুষ হিসেবে সম্মানের আসনে আসীন করেছে বংশের আধার ও গর্ভের ধারক নারীকে। সম্মান-মর্যাদার খাতিরে বানিয়েছে উভয় জায়গায় সম্পত্তির অধিকারী।
মুসলিম আইনের পরিভাষায় দেনমোহর হচ্ছে বিবাহবন্ধন উপলক্ষে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নগদ অর্থ, সোনা-রুপা বা স্থাবর সম্পত্তি প্রদান করা। এটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর করুণা নয়, স্ত্রীর অধিকার। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ এবং অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। বিয়ের সময় যদি দেনমোহর নির্ধারণ করা না হয় এমনকি স্ত্রী পরবর্তী সময়ে কোন দেনমোহর দাবি করবে না এ শর্তেও যদি বিয়ে হয় তাহলেও স্ত্রীকে উপযুক্ত দেনমোহর দিতে স্বামী আইনত বাধ্য।
মোহর ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরয, কিন্তু এ বিষয়ে সমাজে চরম অজ্ঞতা ও উদাসীনতা বিরাজমান। দ্বীন-ধর্মকে ভালবাসেন এবং নামায-রোযা করেন এমন অনেক মানুষও মোহরের বিষয়ে সচেতন নন। এ বিষয়ে উদাসীনতা এত প্রকট যে, অনেকে নফল নামায পড়াকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, মোহর আদায়কে তার সিকি ভাগও মনে করেন না!
অথচ তা একটি ফরয বিধান ও বান্দার হক, যা আদায় করা ছাড়া মানুষ প্রকৃত দ্বীনদার হতে পারে না। এজন্য প্রথমেই দরকার মোহরের গুরুত্ব উপলব্ধি করা। এরপর তা আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। ঈমানদার ভাইদের মাঝে যেন এই অবহেলিত ফরয বিধানটি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয়-এই শুভ কামনা থেকেই আজকের এই লিখা।
মোহরের অংকটা নির্ধারণ করা হয় পাত্রের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী এবং অবশ্যই পাত্রের সম্মতিক্রমে। পাত্রের নির্ধারিত সেই দেনমোহরে আবার পাত্রীর সম্মতি থাকতে হবে। তবেই পাত্র-পাত্রী একে অপরকে চিরসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হবে এবং কবুল বলবে, অন্যথায় নয়।
মোহরানা সম্পর্কিত কিছ ইতিহাস:
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, হযরত আলী (রা.) যখন মুহাম্মদ (স.) কন্যা ফাতিমা (র.) কে বিয়ে করেন। তখন মহরানা দেয়ার মতো আলীর কোনো নগদ অর্থ সম্পদ ছিল না। বিয়ের সময় তার মালিকানায় ছিল কেবলমাত্র উট, তরবারি আর বর্ম। উট তরবারি তার জীবন যাপনের জন্য অতি আবশ্যক ও জরুরী বলে নবীজী আলীকে উট তরবারি বাদ দিয়ে বিয়েতে তার বর্ম মোহরানা হিসাবে দেয়ার জন্য পরামর্শ দেন। পরামর্শ যথারীতি পালন করেন আলী।
নবী মুসা (আ.) যখন মিশর থেকে মদিনায় এসে সাফুরাকে বিয়ে করেন তখন তার মোহর দেওয়ার মতো কোন যোগ্যতাই ছিল না। সে কারনে সাফুরার পিতাকে তিনি কোন প্রকার মজুরি ছাড়াই দশ বছর সাফুরার বাবার গবাদি পশু চারণ ও পালন করে প্রতিদান হিসাবে তার শ্রম উপহার দেন।
বর্তমানে আমাদের সমাজে দেনমোহরের পরিমাণ একটি লোক দেখানো বিষয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দেনমোহর প্রদানকারীর সামর্থ্য হিসাব না করে লোকের কাছে দেনমোহরের অঙ্ক শোনানোর জন্য মোটা অংকের দেনমোহর ধার্য করা হয়। এই বড় অংকের দেনমোহর হয়তো আর কখনোই পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। বিষয়টি হালকাভাবে নিয়ে লোক দেখানো অধিক দেনমোহর ধার্য করাতে কোনো বরকত নেই। বরং তা অহংকারের পরিচয় বহন করে। দেনমোহর এমন একটি বিষয়, যা পরিশোধ করতেই হবে।
আমাদের সমাজে দেখা যায়, দেনমোহর কত টাকা হবে, তা নির্ধারণ করেন মুরব্বি বা অভিভাবকরা। পাত্রের সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক; তাতে কারও কিছু যায় আসে না। পাত্রীপক্ষ থেকে বিবেক-বিবেচনা ভুলে গিয়ে (বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে, কখনবা স্ট্যাটাস রক্ষার খাতিরে) ‘গাছে-মাছে’ একটা অংক নির্ধারণ করে সুইচ টিপে দেয়, ব্যস!
এ নিয়ে উভয়পক্ষে তর্ক-বিতর্কও হয়, দরকষাকষিও চলে; কখনও কখনও বিয়ে ভেঙেও যায়।
মোহর নিয়ে সমাজে প্রচলিত জঘণ্য কুপ্রথাটি হলো, বিয়ের প্রথম রাতেই স্ত্রীর কাছ থেকে ছলে-বলে-কৌশলে মোহর মাফ করিয়ে নেওয়া। বাসর রাতে যে কোনো নারীই মানসিকভাবে দুর্বল থাকেন। এছাড়া মোহরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানা না থাকায়; স্বামী যখন তার কাছে মোহর মাফ চান, তখন তাকে ‘না’ বলার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন না। মোহর নিয়ে এমন নাটক করতে পবিত্র কোরআন ও ইসলামি শরিয়ত কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
দেনমোহরের সর্বোচ্চ কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। ন্যূনতম পরিমান হানাফি মাজহাবের মতে ১০ দিরহাম। অর্থাৎ ৩০.৬১৮ গ্রাম রুপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য নির্ধারণ করা। এর চেয়ে কম পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা স্ত্রী রাজি হলেও তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হবে না।
এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ১০ দিরহামের কম কোনো মোহর নেই (বায়হাকি-৭/২৪০)।
কিন্তু এর উপরে যে কোনো পরিমাণকেই দেনমোহর নির্ধারণ করা যাবে। তবে স্বামী যেহেতু দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য- তাই তার পরিশোধের সামর্থ্য বিবেচনা করে তা নির্ধারণ করা উচিৎ। এমন কোনো সিদ্ধান্ত তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া আদৌ উচিৎ হবে না- যাতে সে তা পরিশোধ না করতে পেরে গুনাহগার হয়।
দেনমোহরের জন্য আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত পরিমান হল মোহরে ফাতেমি।
মোহরে ফাতেমি বলা হয় ঐ পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা, যা রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর মেয়ে হযরত ফাতেমা রাঃ-এর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। হযরত ফাতেমা রাঃ-এর মোহর ৫০০ দিরহাম নির্ধারণ করা হয়েছিল, ১৫৩০.৯ গ্রাম রুপা (জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া, ৪/৩৫০)।
হযরত উমর (রা.) এর খেলাফতকালে যখন মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে- তখন সাহাবারা (রাঃ) তাদের সন্তানদের বিয়েতে দেনমোহরে ফাতেমির চেয়ে অনেক গুণ বেশি দেনমোহর নির্ধারণ করতে শুরু করেন। হযরত উমর (রা.) দেনমোহরের ক্রমবৃদ্ধির গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি এত বেশি পরিমান দেনমহরের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু সূরা নিসার ৪ নম্বর আয়াত এর কারনে তা পারেননি।
সুরা নিসার ৪ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানিয়েছেন-
“তোমরা স্ত্রীদের তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে” (সূরা নিসা-৪)”।
এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় দেনমোহর অনেক বেশিও হতে পারে।
ঢালাওভাবে সবার জন্য দেনমোহরে ফাতেমি নির্ধারণ করলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে- যা ইসলাম আদৌ পছন্দ করে না।
আবার মোহরে ফাতেমির চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ দেনমোহর পরিশোধের সামর্থ্য যদি স্বামীর থাকে তবে সেক্ষেত্রে দেনমোহরে ফাতেমিকে দেনমোহর নির্ধারণ করার দ্বারা স্ত্রীকে ঠকানো হয় ও নারীত্বের অবমাননা করা হয়। তাই দেনমোহরে ফাতেমিকে নয়, বরং স্বামীর সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ পরিমাণকে দেনমোহর করা উচিৎ।
অন্যসব অধিকারের মতো স্বামীর কাছে দেনমোহর দাবি করা স্ত্রীর জন্য দোষের কিছু নয়। অনেকেই মনে করেন, দেনমোহরের টাকা স্ত্রীকে দিতে হয় শুধুমাত্র বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটলে। এটা অজ্ঞতা ও চরম ভুল ধারণা। বিয়ে বিচ্ছেদ না হলেও দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা ফরজ।
মোহরকে অবশ্য আদায়যোগ্য আর্থিক আমল মনে করলে সামর্থ সীমিত থাকলেও তা আদায়ের উপায় বের হয়ে আসবে। মোহর আদায়ের উদাসীনতা থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ও আমাদের সমাজকে রক্ষা করুন। আমীন।
মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও গবেষক
বিষয়: মোঃ শামছুল আলম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: