সিডনী সোমবার, ১৩ই মে ২০২৪, ২৯শে বৈশাখ ১৪৩১

বাজেট প্রণয়নের পদ্ধতিতেই গলদ আছে


প্রকাশিত:
৫ মে ২০২৩ ২৩:০০

আপডেট:
১৩ মে ২০২৪ ০৫:৩৩

 

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। আমাদের দেশের বাজেট আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত হয়।

একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজেট শেষও হয়। বাজেট সবসময় সরকারই প্রণয়ন করবে। সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রণয়ন করবে। এতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু যখন বাজেট প্রস্তাবনা তৈরি করা এবং পরে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়-সেখানেই আমাদের ব্যর্থতা সবচেয়ে বেশি।

সংসদে বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপিত হওয়ার পর তা খুব চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে সংসদের সেই সামর্থ্যও নেই। সংসদ সঠিকভাবে বাজেট বিশ্লেষণ করতে পারে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বাজেট প্রস্তাবনা বিশ্লেষণের জন্য সংসদীয় সাব-কমিটি থাকে। বাজেটবিষয়ক কমিটিও থাকে। তারা প্রস্তাবিত বাজেট পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে।

কিন্তু আমাদের এখানে সংশ্লিষ্ট কমিটি থাকা সত্ত্বেও সেভাবে বিশ্লেষণ করা হয় না। আমাদের দেশে প্রক্রিয়াটা গতানুগতিকভাবে নামমাত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে একদিনের মধ্যেই খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে অনুমোদন করা হয়। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করা হয় বলে সাব-কমিটির পক্ষে বাজেট প্রস্তাবনা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না।

উন্নত দেশগুলোয় দেখা যায়, যারা বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাদের এ সাব-কমিটির কাছে বিভিন্নভাবে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হয়। অংশীজনের পক্ষ থেকে তাদের নানাভাবে প্রশ্ন করা হয়। বাজেটে এটা কেন করা হচ্ছে, কেন এটা করা হবে না-এমন হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাদের।

ফলে প্রস্তাবিত বাজেট অনেক ক্ষেত্রেই বড় ধরনের সংশোধন করা হয়। এমনকি জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পরও প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন বিষয় পরিবর্তন বা সংশোধন করা হয়। কমিটি যদি প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন না করে, তাহলে তা সংসদে উপস্থাপিত হবে না।

এ ধরনের বিশ্লেষণ পদ্ধতি ও জবাবদিহিতা আমাদের দেশে বলতে গেলে প্রায় অনুপস্থিত। ফলে আমাদের এখানে যে বাজেট প্রণীত হয়, তা প্রক্রিয়াগতভাবেই অগণতান্ত্রিক এবং প্রচণ্ড আমলাতান্ত্রিক। বাজেট প্রস্তাবনা জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পর সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকে না। সংসদ সদস্যদের বাজেট নিয়ে আলোচনার জন্য যে সময় দেওয়া হয় তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। এ সামান্য সময়ে বাজেটের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিকভাবে আলোচনা এবং সুপারিশ প্রদান করা সম্ভব হয় না।

আবার কোনো কোনো সংসদ-সদস্য প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনার জন্য যে স্বল্প সময় পান, তা নানা রকম অপ্রাসঙ্গিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা ও প্রশংসা করার কাজে ব্যবহার করেন। অনেক সময় তাদের এলাকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। ফলে বাজেট নিয়ে আসলে তেমন কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা সংসদে হয় না। তাই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়, ঠিক সেভাবেই অনুমোদিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি সামান্য পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হলেও বাজেটের মূল সুর ও বিষয়বস্তু একই থাকে।

বাজেট প্রণয়নের এ গতানুগতিক প্রক্রিয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। যেহেতু সঠিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে বাজেট প্রণীত হয় না, তাই বাজেটে জনগণের চাওয়া-পাওয়া সেভাবে প্রতিফলিত হয় না। বস্তুত আমাদের দেশে যেভাবে বাজেট প্রণীত হয়, তাকে আমি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলে মনে করি না। বাজেট প্রণয়নের পদ্ধতি একটি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, আগের বছরের জন্য যে বাজেট প্রণীত হয়েছিল, এর সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে কোনো পর্যালোচনা সংসদে করা হয় না। কোন খাতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি, কেন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলো না, এজন্য কে বা কারা দায়ী-এসব নির্ধারণ করা হয় না। প্রতিবছর বাজেটে নানা ধরনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়; কিন্তু বছর শেষে তার অধিকাংশই অনার্জিত থেকে যায়। এ জন্য কাউকেই জবাবদিহি করতে হয় না।

আগের বছরের বাজেটে যে পরিবর্তনগুলো হয়, তা সংসদে ধ্বনি ভোটে পাশ হয়। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আগের বছরের বাজেট অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু আমি মনে করি, এখানেই বেশি সময় দেওয়া উচিত। কেন রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হলো না, কেন জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলো না, কেন সামাজিক বেষ্টনী খাতে আরও বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা গেল না-এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার কারণগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী বছরের জন্য বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আগের বছরের বাজেটের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো কেন অর্জিত হলো না, তা সাব-কমিটিতেও আলোচনা হয় না। পূর্ণাঙ্গ বাজেট অধিবেশনেও সঠিকভাবে আলোচিত হয় না। ভাবা হয়, যা হওয়ার হয়ে গেছে, যেভাবে সংশোধিত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়, তা পাশ করে দাও। প্রতিবছরই বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু পরবর্তী বছরের বাজেটে সেই ব্যর্থতা অতিক্রম করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। বরং আবারও ব্যর্থতার জন্যই যেন বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ বাজেট প্রক্রিয়া থেকে আমরা শিক্ষণীয় কোনো কিছু গ্রহণ করছি না। ফলে বাজেট প্রক্রিয়াটা উন্নত হচ্ছে না। বাজেটে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রার প্রক্ষেপণ উন্নয়ন ঘটছে না।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top