বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব, আমদানি-রফতানি বাধাগ্রস্ত
প্রকাশিত:
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২১:৫০
আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:৫৫
প্রভাত ফেরী ডেস্ক: বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। সঙ্কটে পড়েছে বিশ্ববাণিজ্য। যার বাইরে নেই বাংলাদেশও। কারণ দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য অনেকাংশই চীনের সঙ্গে জড়িত। মোট আমদানির ২৫-৩০ শতাংশ হয় চীন থেকে। দেশটি থেকে আমদানি করা হয় ১ হাজারের বেশি প্রকারের পণ্য। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে চীনে অসংখ্য পণ্য রফতানি হয়, সেটিও এখন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত। ইতোমধ্যেই চামড়া-পাটপণ্যসহ অনেক কিছুই রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে।
দেশের রফতানি বাণিজ্যে প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পেও ধাক্কা লেগেছে করোনার। তা ছাড়া দেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ যে ১০ মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে তার অনেকই চীনা নাগরিকরা কাজ করছে এবং তাদের প্রকৌশলগত ও টেকনিক্যাল অনেক সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। করোনার প্রভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এসব প্রকল্পের কাজ। এভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতির সব খাতেই বহুমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতে। করোনা সঙ্কট আরও দীর্ঘ হলে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের অর্থনীতি ধসে পড়তে পারে। যে জন্য আগে থেকে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য নৌপথে পরিবহন হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের ১০টি ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দরের সাতটিই রয়েছে চীনে। তার কাছাকাছি সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও একটি করে বড় বন্দর আছে। চীন থেকে বিশ্ব জুড়ে পণ্য বহনকারী শিপিং সংস্থাগুলোকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা সিএনএন বলছে, ধমনীর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে গেলে মানুষের যে অবস্থা হয়, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব বাণিজ্যেও সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ধাক্কা যে লেগেছে এবং সামনে সঙ্কট আরও বাড়তে পারে সে বিষয়ে সরকার সতর্ক। বিষয়টি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনিটরিং করছেন। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন এবং একটি ন্যাশনাল কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। তা ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো ইতোমধ্যেই তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি করোনার প্রভাব নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ধাক্কা
পণ্য উৎপাদনে চীন থেকে প্রচুর কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের একটি অংশ দেশে বিক্রি হয়, আরেকটি অংশ রফতানি হয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল যেমন- সুতা ও কাপড়ের উল্লেখযোগ্য অংশ আমদানি হয় চীন থেকে। সময়মতো কাঁচামাল আনতে পারছেন না অনেকেই। এর ফলে রফতানি পণ্য তৈরিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
চীন থেকে মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল, শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, পদ্মা সেতুসহ সরকারি প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, মসলা জাতীয় পণ্য আদা-রসুন, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যসহ আরও অনেক পণ্য আসে। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাকের কাঁচামাল ফেব্রিকস, রাসায়নিক পদার্থ, কারখানার যন্ত্রপাতির প্রধান উৎসও চীন। এসব দিক বিবেচনা করলে আমাদের দেশের আমদানির বড় বাজার হচ্ছে চীন। এ ছাড়া, দেশের পোশাক কারখানায় সুপারভাইজারি ও টেকনিক্যাল পদে অনেক চীনা নাগরিক কাজ করেন। নববর্ষের ছুটি কাটাতে তারা চীনে গেছেন। এখন তাদের আর বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে গার্মেন্টস কারখানার পণ্য উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
গত অর্থবছর বাংলাদেশ ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে চীন থেকেই আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকার পণ্য। অর্থাৎ মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি হয়েছে চীন থেকে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি কমেছে ৩ শতাংশ এবং রফতানি কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। চীনের এ সঙ্কটের কারণে আমদানি-রফতানি আরও কমবে। এতে দেশের রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেবে।
পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানিও ব্যাহত হচ্ছে। চামড়া ও পাট পণ্য রফতানি হচ্ছে না। বন্ধ হয়ে গেছে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি। তৈরি পোশাকেরও একই অবস্থা। উদ্যোক্তারা বলছেন, চীনের এ পরিস্থিতিতে পাট ও পাট পণ্য রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রভাব ইতোমধ্যে তা শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চীনে পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, কাঁকড়া, কুচে রফতানি হয়। গত বছর ১৬ কোটি ডলারের চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছিল। বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটের সুতার দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা চীন। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে চীন বাংলাদেশ থেকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের পাটের সুতা আমদানি করেছে। এ সময়ে ১ কোটি ১৬ লাখ ডলারের কাঁচাপাট রফতানি হয়েছে দেশটিতে।
আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনে বিপর্যয়
করোনাভাইরাস ছড়ানো রোধে চীন নৌযান চলাচল কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে তাদের পরিষেবার চাহিদা কমে গেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে বলে শিপিং কোম্পানিগুলোর তরফ থেকে বলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শিপিং অ্যাসোসিয়েশন বিআইএমকোর প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড সিএনএকে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্যের সংযোগস্থল চীনের বন্দরগুলোর কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হওয়ায় শিপিং ইন্ডাস্ট্রি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ আন্তঃএশীয় ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় চীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে অনেক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কন্টেইনারবোঝাই পণ্য পরিবহনের চাহিদা সংকুচিত হয়ে পড়বে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, চীন বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাংলাদেশও বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। দেশের আমদানি ও রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বাণিজ্য সচিব বৃহস্পতিবার একটি বৈঠক করেছেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ের ওপর নজর রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে এফবিসিসিআই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেবেন। এ প্রতিবেদনের ওপর সরকার পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে। গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সম্ভবত এ বিষয়ে একটি ন্যাশনাল কমিটিও করা হয়েছে। যদিও সে বৈঠকে আমি ছিলাম না তবে সেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজে ফলোআপ করছেন।
বিষয়: করোনা ভাইরাস
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: