সিডনী সোমবার, ১৩ই মে ২০২৪, ৩০শে বৈশাখ ১৪৩১

সমতলের চায়ের তীর্থক্ষেত্রে ৩য় নিলাম বাজার


প্রকাশিত:
৩০ আগস্ট ২০২৩ ২৩:২১

আপডেট:
১৩ মে ২০২৪ ১২:৪৬

 

সমতলের চায়ের ভূমি পঞ্চগড়ে গড়ে উঠছে দেশের তৃতীয় নিলাম বাজার। এরই মধ্যে সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চা বোর্ড। ২ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ে উদ্বোধন করা হবে দেশের তৃতীয় এই নিলাম বাজার। শুরুতে নিলাম হবে অনলাইনে।
এই নিলাম বাজার গড়ে উঠলে সমতলের চা কেন্দ্রিক অর্থনীতি পাবে নতুন মাত্রা। বাঁচবে কারখানা মালিক ও ব্যবসায়ীদের যাতায়াত খরচ। চাষিরাও কাঁচা চা পাতার ন্যায্য মূল্য পাবেন বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত দুই দশকে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের গোচারণভূমি চায়ের সবুজে ভরে গেছে।
বর্তমানে চা উৎপাদনে চট্টগ্রামকে ছাড়িয়ে গেছে প্রান্তিক এ জেলা। ২০২২ সালে উত্তরের সমতলের পাঁচ জেলায় ২৫টি কারখানায় তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৬ কেজি। যার মধ্যে পঞ্চগড়েই তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে প্রায় এক কোটি ৫২ লাখ কেজি। দেশের মোট উৎপাদিত তৈরি চায়ের প্রায় ১৯ শতাংশ আসছে সমতলের চা থেকে।
কিন্তু সমতলে কোনো নিলাম বাজার না থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হতো কারখানা মালিক ও চা ব্যবসায়ীদের। চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলে চায়ের নিলাম বাজারে যাতায়াতেই গুনতে হতো বড় খরচ। চায়ের দাম নিয়েও ধোঁয়াশায় থাকতেন প্রান্তিক চা চাষিরা।

তবে সমতলে চায়ের নিলাম বাজার স্থাপনের দীর্ঘদিনের দাবি এবার আলোর মুখ দেখছে। আগামী ২ সেপ্টেম্বর দেশের তৃতীয় চা নিলাম বাজার চালু হচ্ছে সমতলের চায়ের তীর্থক্ষেত্র পঞ্চগড়ে।
এরই মধ্যে পাঁচটি ব্রোকারস হাউস ও দুটি ওয়্যারহাউসকে অনুমোদন দিয়েছে চা বোর্ড। উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চা বোর্ড। ২ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয় চা নিলাম বাজারের উদ্বোধন করবেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। নিলামবাজার স্থাপনের খবরে খুশি চায়ের অংশীজনরা।

এদিকে নিলাম বাজার চালু উপলক্ষে এরই মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে চা বোর্ড। চা আইন না মানা, চাষিদের চায়ের যথাযথ মূল্য পরিশোধ না করা, কালোবাজারে চা বিক্রি এবং অনুমোদন ছাড়াই চা মোড়কজাত করায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও চা কারখানাকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ জরিমানা করা হয়েছে।

চাষিরা জানান, কয়েক বছর ধরে চায়ের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না তারা। কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটে পড়ে প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। অনেকেই চা বাগান উপড়ে ফেলেছেন। নিলাম বাজারে খারাপ মানের চা তুলে তার গড় করে দাম দেওয়া হতো চাষিদের। ভালো মানের চা পাতা কালোবাজারে চড়া দরে বিক্রির অভিযোগও করেন তারা। প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও চাষিদের দেওয়া হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ টাকা। তার মধ্য থেকে আবার ওজন থেকে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ দিয়ে দাম দেওয়া হয়। এতে প্রতি কেজি চা বিক্রি করে চাষিদের পকেটে ঢোকে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় টাকা। অথচ প্রতি কেজি চা উৎপাদন করতে তাদের খরচ পড়ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। তবে এই নিলাম বাজার চালু হলে ভালো দামের আশা চাষিদের। সেই সাথে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধে কঠোর নজরদারির দাবি করেন তারা।

২০০০ সালে পঞ্চগড়ের সমতলে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের গোড়াপত্তন হয়। এখন পঞ্চগড়ের পাশাপাশি সীমিত পরিসরে ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট জেলায় চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার একর জমিতে সাড়ে আট হাজার ছোট-বড় চা বাগান গড়ে উঠেছে। ধানি জমির মতো সারি সারি চা বাগান সমতলের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। সমতলে দেশের তৃতীয় নিলাম বাজার চালু হলে চা কেন্দ্রিক অর্থনীতি পাবে নতুন মাত্রা। বছরে অন্তত দুই থেকে তিন শ কোটি টাকার চা কেনাবেচা হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চা চাষি সায়েদ আলী বলেন, ‘কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে আমরা প্রতিনিয়ত লোকসান গুনছি। আমার চা বাগান টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকে বাগান ভেঙে ফেলছে।’

চা চাষি মো. শাহজালাল বলেন, ‘এই সিন্ডিকেটে কারখানা মালিকদের সাথে প্রশাসনের লোকজন, স্থানীয় প্রভাবশালীসহ অনেকেই জড়িত। কারখানা মালিকরা চাষিদের রক্ত চুষে নিজেরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের কারখানা পরিধি দ্বিগুণ হচ্ছে। আর চাষিরা বছরের পর বছর নির্যাতিত হচ্ছে। এই নিলাম বাজার হওয়ায় আমাদের মনে আশা জেগেছে। আমরা চাই এই নিলাম বাজারে যেন কোনোভাবেই কোনো সিন্ডিকেট প্রবেশ করতে না পারে।’

চা চাষি মানিক হোসেন বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি এবার পূরণ হতে চলেছে। তবে তার আগে নজর দিতে হবে কারখানাগুলোর প্রতি। তারা ভালো মানের চা কালোবাজারে চড়া দরে বিক্রি করে দিচ্ছে। সেই সাথে কারখানা মালিকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। প্রশাসন যদি কালোবাজারে চা বিক্রির বিষয়ে কঠোর হয় তবে আমরা চায়ের ন্যায্য মূল্য নিশ্চয়ই পাব।’

চা ব্যবসায়ী ফোরাত জাহান সাথী বলেন, ‘আগে আমাদের চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলের নিলাম বাজার থেকে চা ক্রয় করে মোড়কজাত করতে হতো। পরিবহনেই অনেক বড় অঙ্কের খরচ হতো। এখন আমরা পঞ্চগড় থেকেই চা কিনতে পারব।’

সাজেদা রফিক চা কারখানার পরিচালক আকতারুজ্জামান সুমন বলেন, ‘এখানে নিলাম কেন্দ্র চালু হলে আমাদের পথ খরচ বেঁচে যাবে। এতে আমরা যেমন লাভবান হব, তেমনি চাষিরাও লাভবান হবে। সেই সাথে চাষিরাও তাদের চা পাতা কী দরে বিক্রি হচ্ছে তা জানতে পারবে।’

ইন্ডিগো ব্রোকারস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা সব নিলামের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আমরা আশা করছি দেশি-বিদেশি বায়ারদের সাড়া পাব। আমাদের শুরুটা ভালো হবে। সেই সাথে এখানে চায়ের অর্থনীতি নতুন মাত্রা পাবে।’

চা বোর্ডের উপসচিব মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘আমরা পঞ্চগড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করেছি। এই ধারা অব্যাহত থাকবে। চা আইন না মানা, চাষিদের যথাযথ মূল্য পরিশোধ না করা, কালোবাজারে চা ক্রয়-বিক্রয় ও অনুমোদন ছাড়াই চা মোড়কজাত করায় আমরা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় জরিমানা করেছি। চাষিরা যেন ন্যায্য মূল্য পান, সেটিই আমাদের লক্ষ্য। এ জন্য প্রয়োজন হলে আমরা চাষিদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য চা আইন সংশোধনের প্রস্তাব রাখব।’

বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ড. এ কে এম রফিকুল হক বলেন, ২ সেপ্টেম্বর দেশের তৃতীয় নিলাম বাজার যাত্রা শুরু করছে। প্রথমে অনলাইনেই হবে নিলাম কার্যক্রম। এরই মধ্যে ব্রোকারস হাউস ও ওয়্যারহাউসের লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই নিলাম কেন্দ্র চালু হলে সমতলের চায়ের আরো বিকাশ ঘটবে। তবে ভালো মানের চা তৈরির ওপর জোর দিতে হবে।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top