সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১


বিশ্বজোড়া বন্ধুত্ব : মোঃ ইয়াকুব আলি


প্রকাশিত:
৮ আগস্ট ২০২৩ ২৩:৪৯

আপডেট:
৩১ আগস্ট ২০২৩ ২২:২৮

 ছবিঃ লেখকের সাথে বন্ধু পান্টু এবং মিকাইলা

 

প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে সমগ্র বিশ্বই এখন একটি গ্রামের রূপ নিয়েছে। এখন বিশ্বব্যাপি সবাইকে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্যই ভাবতে হয়। এক দেশের জন্য যেটা সমস্যা সময়ের পরিক্রমায় অন্য দেশগুলোও তাতে কমবেশি আক্রান্ত হয়। আবার যেকোন সুখবরও সবার জন্যই ভালো বার্তা হয়ে আনে। দেশ এবং জাতি আর এখন কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সীমাবদ্ধ নেয়। একটা দেশ থেকে মানুষ অন্য আরেকটা দেশে যেয়ে সেই দেশের ভেতরে আরেকটা ছোট দেশ তৈরি করে ফেলে। এটাকে আমি বলি দেশের ভেতর দেশ।

ছবিঃ লেখকের বন্ধু পান্টু এবং বন্ধু পত্নী মিকাইলা
মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকেই যাযাবর। বিভিন্ন প্রয়োজনে সে পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়। সেই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। এখনও মানুষ জীবিকার তাগিদে, কখনও বা বাড়তি সামাজিক নিরাপত্তার ভরসায় দেশান্তরিত হচ্ছে। আর যে দেশেই যাচ্ছে সেখানে নিজেরদের আরেকটা ছোট দেশ তৈরি করে নিচ্ছে। এই অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশিরাও এখন আর পিছিয়ে নেয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থানান্তর হচ্ছে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়েই মানুষ পাড়ি দিচ্ছে দেশের গন্ডি এবং সীমানা।


ছবিঃ স্বপরিবারে বর্ণি আপু
আমাদের কলেজ জীবনের বন্ধু পান্টু কলেজ জীবন শেষ করেই পাড়ি জমিয়েছিল সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ের দেশ আমেরিকাতে। পান্টুর সাথে আমার পরিচয় কলেজ জীবনের শেষের দিকে। মফস্বল শহর কুষ্টিয়াতে আমরা বিভিন্ন স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে সবাই ভর্তি হয়েছিলাম কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। গ্রামের একটা স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়া আমার সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছিল। বন্ধু সৌরভের মাধ্যমে একদিন গিয়েছিলাম পান্টুদের বাড়িতে। আমার এখনও দিব্যি মনে আছে একটা হ্যাংলা পাতলা তাল পাতার সেপাইয়ের মতো ছেলে উঠে আসলো বিছানা থেকে। তার মাথার কাছে ঝুলানো রয়েছে জিম মরিসনের সাদাকালো একটা লম্বা ছবি। এরপরের ঘটনা আর এতদিন পর মনে নেই আমার।
জীবনের পরিক্রমায় একসময় আমরা সপরিবারে এসে হাজির হলাম অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। আমাদের বসবাস শুরু হলো সিডনির দক্ষিণ পশ্চিমের সাবার্ব মিন্টোতে। অস্ট্রেলিয়া আসার প্রথম সপ্তাহহেই মেয়েকে স্কুলে দিতে যেয়ে গিন্নী খবর আনলো মেয়ের স্কুলের সপ্তাহান্তে বাংলা ভাষা শেখানোর ক্লাস করানো হয়। পরের রবিবার মেয়েকেসহ আমি যেয়ে হাজির হলাম সেই স্কুলে। জানলাম এটা অস্ট্রেলিয়া সরকারের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের অধীনে পরিচালিত 'কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজ' স্কুল। এখানে প্রবাসী প্রজন্মকে প্রতি রোববার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শিক্ষা দেয়া হয়। সেখানে উপস্থিত অভিভাবকদের সাথেও পরিচয় হলো। আমার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। যার সাথেই পরিচয় হয় তার সাথেই একটা আত্মীয়তার সম্মন্ধ তৈরি করে নিই ঠিক আবহমান গ্রাম বাংলার মানুষদের মতো।
সেখানে পরিচয় হলো ফয়সাল খালিদ শুভ ভাইয়ের সাথে। কথায় কথায় জানতে পারলাম উনার শ্বশুর বাড়ি কুষ্টিয়াতে। আমি সাথে সাথে বললাম তাহলে আপনি সম্পর্কে আমার দুলাভাই হচ্ছেন। কথা প্রসঙ্গে উনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের কোন ব্যাচের ছাত্র ছিলাম। উত্তর দেয়ার সাথে সাথে উন বললেন, আরে আমার শ্যালকও তো তোমাদের ব্যাচের ছাত্র ছিল। আমি বললাম ওর নাম কি? তখন শুভ ভাই বললেন তাসলিমুর। বলেই উনার মনেপড়ে গেলো ভঙ্গিতে বললেন কিন্তু ডাক নাম পান্টু। সাথে সাথে আমার পনের বছর আগের স্মৃতি মনেপড়ে গেলো। কারণ আমি জিম মরিসনের কথা একেবারে আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল।
এরপর থেকেই শুভ ভাই হয়ে গেলেন পাকাপোক্তভাবে আমাদের দুলাভাই, বর্ণি আপু আমার বড় বোন। আর উনাদের দুই মেয়ে অপলা এবং অরূপা আমার ভাগ্নি। এরপর শুভ ভাইকে দেখলেই কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক টানে 'দুলুভাই' বলে ডাক দিই। মাঝে মাঝে উনাকে দেখলে রাজশাহীর আঞ্চলিক টানে 'মামুর বিটা' বলেও সম্বোধন করি। শ্যালক এবং দুলাভাইয়ের এ এক মিষ্টি খুঁনসুটি। বিভিন্ন উপলক্ষে উনারা আসেন আমাদের বাড়িতে আবার আমরাও হাজির হই উনাদের ডেরাতে। বর্ণি আপু উনার মেয়েদের কাছে বলেছেন, সিডনিতে তোদের একমাত্র মামা হচ্ছে ইয়াকুব। মামা হওয়ার ব্যাপারটা যে এতো আনন্দের আগে জানতাম না।
এরপর একদিন শুভ ভাই বললেন, এই তোমার বন্ধু আসতেছে অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে। শুনে আমি খুবই খুশি হলাম। দীর্ঘ তেইশ বছর পর আবার পান্টুর সাথে দেখা হবে। অবশ্য পান্টু এতদিনে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। মিকাইলা নাম ওর একজন অতি সুন্দরী স্ত্রী আছে। পান্টু অস্ট্রেলিয়া এসেছিল অফিসের কাজে। তার ফাঁকে ফাঁকে শুভ ভাইদের বাসায় অবস্থান করছিল। এরমধ্যে একদিন আপু ফোন দিয়ে বললেন, তুই কালকে সপরিবারে চলে আয়। আমিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে গিন্নির ব্যস্ততার কারণে আর যেতে পারলো না। আমি একাই যেয়ে হাজির হলাম।
ছবিঃ চাঁদের আলোয় নৈশ ভ্রমণ

অবশ্য ওরা আসবে জানার পর থেকেই ওদেরকে কি দিয়ে স্বাগত জানানো যায় সেই পরিকল্পনা করতেছিলাম। তখন মনেহলো ওদেরকে ষোলআনা বাঙালিয়ানায় বরণ করে নিলে কেমন হয়। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক আমার বুয়েটের বন্ধু আসাদের বাসায় হাজির হলাম এক রাত্রে। আসাদের স্ত্রী কুমু ভাবি অনলাইনে একটা বুটিক শপ চালান 'ডি স্যাফায়ার' নামে। উনার শপের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো উনি শতকরা একশত ভাগ বাংলাদেশি পণ্য আমদানি ও বিক্রি করেন। আর এগুলোর বেশিরভাগেরই যোগানদাতা বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষ আরো নির্দিষ্ট করে বললে মেয়েরা। উনার এই উদ্যোগের উদ্দেশ্যই হলো একদিকে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রচার এবং প্রসার অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রান্তিক মেয়েদের ভাগ্যোন্নয়ন।
উনার কাছ থেকে আমরা বিভিন্ন সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পোশাক আবার কখনও বা পহেলা বৈশাখের পোশাক বা বিজয় দিবসের পোশাক কিনি। সিডনিতে খাঁটি বাংলাদেশি পণ্যের এক বিস্বস্ত নাম ডি স্যাফায়ার। কুমু ভাবিকে আমার পরিকল্পনার কথা বলতেই উনি বললেন তাহলে বাংলাদেশের গামছা প্রিন্টের সালোয়ার কামিজ এবং পাঞ্জাবি দিতে পারেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম না ওদের কোন সাইজটা মানানসই হবে। তখন বুদ্ধি করে একটা গামছা, একটা পাখা আর এক জোড়া হাতের বালা নিয়ে নিলাম। ভাবি বললেন, আমার পক্ষ থেকে নিয়ে যান একটা পার্স। এগুলো আগেই কিনে গুছিয়ে রেখেছিলাম।
নির্দিষ্ট দিনে যেয়ে আপুদের ওরান পার্কের বাড়িতে দেখা হলো পান্টুর সাথে। সময়ের পরিক্রমায় আমরা সবাই একটু মুটিয়ে গেছি, স্বভাবে এসেছে পরিবর্তন। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, পান্টু একটু বদলে যায়নি। না স্বভাবে, না গঠনে। এখনো সেই হ্যাংলা পাতালায় আছে। এরপর পরিচয় হলো মিকাইলার সাথে। মিকাইলা সদা হাসিখুশি আমেরিকান তরুণী। দুজনের জুটি একেবারে যেন হরিহর আত্মা। বর্ণি আপু যখন আমার সামান্য উপহারগুলো ওর হাতে তুলে দিল তখন সে বাংলাদেশের কিশোরী মেয়েদের মতো খুশি হয়ে গেলো এবং সাথে সাথে সেগুলো পরেও এলো। এরপর আমরা সবাই মিলে তাঁকে পাখার ব্যবহার শেখালাম। সে খুবই আগ্রহ নিয়ে আমাদের পাগলামিতে শামিল হলো। শুভ ভাইয়ের বুদ্ধিতে আমরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে পোজ দিয়ে ওদের একগাঁদা ছবি তুললাম।
এরপর দেশে বিদেশে অবস্থান করা সব বন্ধুর সাথে পান্টুর কথা বলিয়ে দিলাম। রাতের খাবার শেষে আমরা বেড়াতে বেড়িয়ে পড়লাম। সেদিন আকাশে ছিল উজ্জ্বল চাঁদ। ওরান পার্ক স্প্ল্যাশ পার্কে যেয়ে আমরা সবাই মিলে দোলনায় চড়ে বসলাম। এছাড়াও বিভিন্ন রাইডে চড়ে ছেলেমানুষী আনন্দে মেতে উঠলাম। এরপর বাকিদেরকে পার্কে রেখে আমি, পান্টু আর শুভ ভাই হেটে এগিয়ে গেলাম। ওরান পার্ক লাইব্রেরি ছাড়িয়ে আমরা হাজির হলাম জ্যাক ব্রাহাম রিজার্ভে। সেখানে একটা গরুর পালের আদলে অনেকগুলো লোহার গরুর মূর্তি দাঁড় করানো আছে। আমি আর পান্টু মিলে পাল্লা দিয়ে তাদের পিঠে চড়ে বসলাম। আর শুভ ভাই আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছিলেন সময়টাকে স্মৃতির খাতায় বন্দি করতে।
লেখাটা শুরু করেছিলাম ' বিশ্বজোড়া বাঙালিয়ানা' শিরোনাম মাথায় রেখে। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়ালো 'বিশ্বজোড়া বন্ধুত্ব' শিরোনামে। শিরোনাম যেটাই হোক দেশে দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালদেশীরা যেন সবাই একসূত্রেই গাঁথা। বাঙ্গালদেশিরা যেখানেই গেছেন সেখানেই একটা ছোট বাংলাদেশ গড়ে নিয়েছেন। আর আমাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য এতই বর্ণিল এবং আকর্ষণীয় যে সেটা নিমেষেই বিদেশের মুগ্ধ করে। যেমন আমেরিকার মিকাইলা বাংলাদেশের পোশাকে উচ্ছাস প্রকাশ করে তেমনি অস্ট্রেলিয়ানরাও বাংলদেশের পোশাকে মুগ্ধ হয়।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top