সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


সুরের আকাশে বিচিত্র ভুবনে আর দেখা যাবে না এন্ড্রু কিশোরকে : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
৮ জুলাই ২০২০ ২০:২১

আপডেট:
৮ জুলাই ২০২০ ২২:০৭

ছবিঃ এন্ড্রু কিশোর

 

প্রিয় মানুষগুলোর চির বিদায়ে আস্তে আস্তে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভীতটুকু ছোট হয়ে আসছে। যার গানগুলো মনকে ছুঁয়ে যেত তাঁর কন্ঠটি আর জাগরুক হয়ে থাকবে না। স্মৃতির পাতা স্মৃতিময় কাব্যের ধারায় আরো প্রসারিত হলো! চিরকাল নিস্তব্ধতায় রয়ে যাবে তাঁর নাম। কঠিন সময়ের মাঝে যার গানগুলো মনকে প্রশান্তি এনে দিত, যার গানগুলো অসীম মমত্ববোধে বারবার শুনার চেষ্টা করতাম তিনি আমাদের মাঝ থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন! সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে আরও এক নক্ষত্রের চলে যাওয়া মানে বিষণ্ন মনকে আরও বিষণ্নতায় নিমজ্জিত করে রাখা!

বরাবরই আমি গানপ্রিয় মানুষ। তাঁর গানগুলোর মাঝে এক ধরণের ভালা লাগার নান্দনিক অনুভূতি কাজ করতো। তাই, ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরে বিকালবেলা ঘুমাতে যাবার আগে 'রেডিও' নামক যন্ত্রটা সাথে রাখতাম। সকালবেলায় "অনুরোধের আসর গানের ডালি" আয়োজনেও তাঁর শ্রুতি মধুর কন্ঠে গান শুনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কোনদিন শুনতে না পেলে মনে আনন্দটুকু খোঁজে পেতাম না। এখন আর রেডিও নেই। তাই অনেক দিন যাবৎ শুনতে পাই না মধুমাখা কন্ঠের শ্রুতিমধুর গান। ছোটবেলার তালটুকু হারিয়ে ফেলি নি:শব্দতায়।

আমি কিছু লিখতে চাইনি। কিন্তু; বার বার ভেসে আসছিল চিরচেনা স্বরের সুন্দর মুহূর্তগুলি। তাই প্রিয় কন্ঠস্বরের নিবৃত্তি হওয়ায় কিছুটা লিখতে বসেছি।

শৈশবে যার গান না শুনলে সংস্কৃতিতে অভাবোধ থেকেই যেত, তাঁর লালিত্য কন্ঠে গান শুনতে মনটুকু ভরিয়ে রাখতো। বস্তুত সঙ্গীত প্রেমীদের হৃদয়ের অন্ত:স্থল চিরকালের জন্য স্থান করে রেখেছে তাঁর গাওয়া গানগুলো।

১৯৫৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। মা মিনু বাড়ৈ এবং বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র বাড়ৈ। মা মিনু বাড়ৈর গানের প্রিয় শিল্পী ছিলেন কিশোর কুমার। তাই মায়ের কোলে জন্ম নেওয়া ফুটফুটে শিশুটির নামকরন করা হয় প্রিয় শিল্পীর নামে অর্থাৎ কিশোর। মুল নাম এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। পরবর্তী সময়ে সঙ্গীত জগতে এন্ড্রু কিশোর নামেই পরিচিত লাভ করেন। মা স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন বিধায় মার সাথেই স্কুলে আসা যাওয়া। তারপর কলেজ জীবন রাজশাহীতে পড়াশুনা চালিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিজ শহর অর্থাৎ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। রাজশাহী সিটি কলেজে পড়ার সময়ই গান গেয়ে সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আস্তে আস্তে নিজের জীবনকে সঙ্গীতের সাথে নিবদ্ধ করেন। মহিমান্বিত হয়ে উঠে নিজের কন্ঠস্বরের গানগুলো গেয়ে। সঙ্গীত বিষয়ে হাতে খড়ি শুরু হয় রাজশাহীর আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। তারপর আস্তে আস্তে ক্লান্তিময় জীবনে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত কন্ঠশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বেতারে তালিকাভূক্তি শিল্পী হন। তখন থেকেই বিভিন্ন ধরণের গান গান গেয়ে যান। প্রকৃতপক্ষে সঙ্গীতের প্রতি মোহের নিবিষ্টতাই এন্ড্রু কিশোরের শিল্পীসত্ত্বার গুণাগুণ প্রকাশের ঐশ্বর্য বজায় থাকে। শিল্পীসত্ত্বার মাঝে নান্দনিকতার মিশেল ঘটিয়েছেন বলেই বিভিন্ন সময় রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, দেশাত্মবোধক, লোকগীতি আধুনিক গান গেয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন নিজেকে!

চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে দেশ বরেণ্য সুরস্রষ্টা ও সঙ্গীত পরিচালক আলম খানের হাতে ধরে "অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ" গানের মধ্য দিয়ে। তবে প্রথম দর্শক সকল যে গান শুনে জনপ্রিয়তা লাভ করেন সেটি হল "এক চোর যায় চলে"। সেখানে তার ক্যারিয়ারের বিশেষ মুহূর্তে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আধুনিক ও কালজয়ী অনেক গান গেয়ে বালাদেশের গানের জগৎ সমৃদ্ধ করে রেখেছেন। চলচ্চিত্রে প্রায় ১৫ হাজার গানে কন্ঠে দিয়েছেন। তিনি 'প্লেব্যাক সম্রাট' হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।

কতটুকু শিল্পীসত্ত্বার গুণাগুণ থাকলে একজন শিল্পী সকল ধরণের গান গেয়ে যেতে পারেন উনার কাছ থেকে বুঝতে পারি। সবক্ষেত্রেই বিচরণ করেন অতি সহজেই। রোমান্টিক থেকে বেদনার সব ধরণের গানের ক্ষেত্রেই বিচিত্রতায় ভরপুর হয়ে উঠে তাঁর কন্ঠস্বর। সেজন্যই তাঁর মধুমাখা কন্ঠের গান "ওগো বিদেশিনী তোমার চেরিফুল নাও" কিংবা " ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইব না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে" গানগুলো আজও মনকে মাতিয়ে রাখে।

বৈচিত্র্যের আভাস দেখতে পাওয়া যায় রোমান্টিক গানের মাঝেও যার ফলে শ্রুতাদের মন কেড়ে নেয় অতি সহজেই। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার মানুষদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠার একটি অন্যতম কারণ প্রেমের গানে রোমান্সের অবয়ব। তাইতো গ্রাম বাংলায় "কী যাদু করিল পিরীতি শিখাইলা থাকতে পারিনা ঘরেতে" গানটি সমভাবে সমাদৃত।

"আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান"- গানটির মধুময়তা ফিরে আসে সত্যকারের দ্যোতনায়। কিংবা "পরেনা চোখের পলক " গানটির রোমাান্স ধরা দেয় গ্রাম বাংলার মানুষের মাঝে। অন্যদিকে "কী যাদু করিরা পিরীতি শিখাইলা" এবং "ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে" প্রাণ সজনী চলচ্চিত্রে এক নতুন অবয়ব এনে দেয়। যার ফলে আমাদের প্রাণের অবারিত সৌন্দর্য্যে বার বার ধরা দেয় সুন্দর গানগুলির প্রিয় মুহূর্ত। গানগুলো শ্রুতাদের মাঝে বিপুলভাবে সাড়া ফেলে।

দীর্ঘদিন কন্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলায়ই গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে শ্রুতাদের মন কেড়ে নেন নিমিষেই।

সেজন্যই আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৮২ সালে "বড় ভাল লোক ছিল", ১৯৮৭ সালে সারেন্ডার, ১৯৮৯ সালে ক্ষতিপূরণ, ১৯৯১ সালে পদ্মা মেঘনা যমুনা, ১৯৯৬ সালে কবুল, ২০০০ সালে আজ গায়ে হলুদ, ২০০৭ সালে সাজঘর বিজয়ী, ২০০৮ সালে কি যাদু করিলা- সিনেমাগুলোর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরষ্কার লাভ করেন।

১৯৯৮ সালে "পদ্ম পাতার পানি" গানটির জন্য সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরষ্কার লাভ করেন।

অগণিত মানুষের ভালবাসার শিল্পী অসুস্থ হওয়ায় গত বছর ৯ সেপ্টম্বর উন্নত চিকিৎসার্থে সিঙ্গাপুর গমণ করেন। কিছুদিন পর জানা যায় তিনি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। সেখানে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছিলেন।

জীবনে অগণিত মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন। তাইতো চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গমণের পর গেটওয়ে থিয়েটার হলে আয়োজন করা হয় "এন্ড্রু কিশোরের জন্য ভালবাসা" শিরোনামে সঙ্গীতানুষ্ঠান। আয়োজন করে বাংলাদেশ চেম্বার এবং সিঙ্গাপুর বিজনেস সোসাইটি। কষ্টের সীমানা পেরিয়ে হুইল চেয়ারে বসেই গাইলেন ' জীবনের গল্প থাকে বাকি অল্প'। আবেগে ভাসিয়ে দিলেন দর্শক ও শ্রুতাদের। নিজ দেশের পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে অনেকেই আপ্লুত হয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি তিনি দেখতে পেয়েছেন তাঁর প্রতি মানুষের অগাধ ভালবাসাটুকুর বিস্তৃতি। আঁচ করতে পেরেছেন নিজের মমত্ববোধের জায়গাটুকু থেকে। তিনি আমাদের মাঝে কতটুকু জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তা আমরা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে কিংবা সিঙ্গাপুরের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমেই আঁচ করতে পারি।

শরীরের অবস্থা বেশি ভাল যাচ্ছিল না বলে ১১ জুন সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসেন দেশে। নিজ শহর রাজশাহীর মহিষবাথানে শেষ হলো তাঁর জীবনের গল্প! তাঁর বোন ডা: শিখা বিশ্বাসের বাড়ীতে গত ৬ জুন শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। রেখে গেছেন আরো অগণিত তাঁঁর গানের ভক্ত।

এ বিস্ময়কর কন্ঠরাজের জীবনাবসানে নেমে আসে শোক। গানের জলসাঘর থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। রেখে গেলে অজস্র সঙ্গীতপ্রেমীদের। যাদের জীবনের জলসাঘরে তাঁর স্থান থাকবে অমলিন। চির ভাস্বর হয়ে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।

প্রিয় শিল্পীর একেকটি গান স্মরণ করিয়ে দেয় প্রিয় বস্তুর সান্নিধ্য কিংবা প্রিয় কোন মুহূর্ত! তাঁর গান গুলোর মাঝেও খুঁজে ফিরিব স্মৃতির অগোচরে ফেলে আসা সুন্দর মুহূর্তগুলি! তাঁকে হারিয়ে অসীম শূন্যতার মাঝে সান্ত্বনা খুঁজে নিবে তাঁর গানগুলোর স্পর্শিত অনুভবে।

 

অনজন কুমার রায়
ব্যাংকার ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top