সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১


বাংলা সিনেমার পালে নতুন 'হাওয়া' : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০২২ ০২:১৬

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ১২:২১

 

আমাদের গ্রামের নাম বাড়াদি। কুষ্টিয়া শহরতলীর একটা গ্রাম। ঠিক পৌরসভার বাইরের একটা গ্রাম। তাই শহর এবং গ্রামের একটা দারুণ কন্ট্রাস্ট আছে সেখানে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে কোথাও পাকা রাস্তা আবার কোথাও হেরিং বন্ডের ইটের রাস্তা। আর বাড়িগুলোর পেছন থেকে অবারিত সবুজের সমারোহ। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। সেখানে বিভিন্ন মৌসুমে ফলে হরেক রকমের শস্য। গ্রামে বিদ্যুৎ তখনও সেইভাবে তার বিস্তার করতে পারেনি। কয়েকটা বাড়িতে সাদাকালো টেলিভিশন আর বেতারই বিনোদনের মাধ্যম। এর বাইরে সামান্য কিছু টাকা ভ্যান বা রিক্সা ভাড়া দিয়ে সিনেমা হলে যেয়ে বাংলাদেশের সিনেমা দেখা যায়। আর বছরে এক দুইবার জগতি রেলবাজারের একমাত্র ভিডিওর দোকান থেকে ভিসিআর ভাড়া করে এনে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি ছবি দেখা হয়।

কুষ্টিয়া শহরে তখন চারটি সিনেমা হল ছিলো। কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ রাস্তায় কুষ্টিয়া কোর্টের বিপরীতে বাণী, কুষ্টিয়ার তখনকার বাস স্ট্যান্ডের ভেতরে ছিলো বনানী, শহরের প্রাণকেন্দ্র নবাব সিরাজউদ্দোলা রাস্তায় কুষ্টিয়া মিউনিসিপালিটি মার্কেটের বিপরীতে ছিলো কেয়া আর কুষ্টিয়ার ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র বড় বাজারের ভেতরে ছিলো রক্সি সিনেমা হল। সিনেমার প্রকারভেদের দিক দিয়ে বিভিন্ন হলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিনেমা আসতো। দর্শকদের ধরে রাখতে সাধারণত প্রত্যেক সিনেমা হলে আলাদা আলাদা সিনেমা নিয়ে আসা হতো। তবে গুণগত মানের বিচারে বা জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বাণীতে সাধারণত একটু সস্তা সিনেমা, কেয়াতে বেশিরভাগ সময়ে ইংরেজি সিনেমা, রক্সিতেও একটু সস্তা বাংলা সিনেমা আর বনানীতে নিয়ে আসা হতো সবচেয়ে ভালো সিনেমা।

যাইহোক আব্বা মোটামুটি সব হলে যেয়েই সিনেমা দেখতেন। কিন্তু মায়েরা সবসময়ই বেছে নিতেন বাণী হল। কারণ বাণী হল ছিলো আমাদের গ্রাম থেকে সবচেয়ে কাছে। আশেপাশের কয়েক বাড়ির খালা, চাচিরা পরিকল্পনা করে একদিন সবাই মিলে সিনেমা হলে যেতেন সিনেমা দেখতে। আমরা ছোটরাও যেতাম মায়েদের সাথে। আমি এখনও চোখ বন্ধ করলে একটা দৃশ্য পরিষ্কার দেখতে পায়। মা'রা সাধারণত দিনের সব কাজ শেষ করে সিনেমা দেখতে যেতেন সন্ধ্যার শোতে। তাই সিনেমা হলে যেয়ে আমরা ছোটরা সাধারণত ঘুমিয়ে পড়তাম। সেদিনও যথারীতি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ বিকট গর্জনে ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলেই দেখি একটা বিশাল বাঘ গাছের উপর থেকে গড়াতে গড়াতে নামছে। দেখেই তারস্বরে এক চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম আর দুই হাত দিয়ে জোরে কান চেপে ধরলাম। সেটা ছিলো রূপবান সিনেমার একটা দৃশ্য। ছোট বেলার সিনেমা দেখার এই স্মৃতিটা সারাজীবন আমার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

যেকোনো হলে নতুন সিনেমা আসলেই গ্রামে গ্রামে মাইকিং করে বেড়াতো। একটা রিক্সার সামনে এবং পেছনে দুটো মাইক বসিয়ে দেয়া হতো। আর রিক্সাটা সেই সিনেমার পোস্টার দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হতো। আমাদের গ্রামে ঢুকলেই আমরা দলবেঁধে সেই রিক্সার পেছু নিতাম। এভাবে আমরা রিক্সার পেছনে পেছনে সারা গ্রাম চক্কর দিতাম। আর বাড়ি ফিরলেই মা জিজ্ঞেস করতেন সিনেমাটা কেমন, কে কে আছে, কোন হলে আসছে এইসব। আমরা সেগুলোর বিশদ বর্ণনা দিতাম। সিনেমা দেখে দেখে আমরা আমাদের দৈনিক খেলার মধ্যে সিনেমার প্লটকে কেন্দ্র করেও খেলাধুলা করতাম। কেউ ভিলেন, কেউ নায়ক, কেউ পুলিশ হতাম। তবে সবাই চাইতো পুলিশ হতে কারণ পুলিশই এসে ভিলেনকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায়। আর তখনকার সিনেমার মারামারির দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আমাদের খুব টানতো। সেই ঢিসটিক ঢিসটিক শব্দ আমাদের প্রজন্ম বোধহয় কখনওই ভুলতে পারবে না। আর মারের স্লো মোশনের দৃশ্যগুলোর অভিনয় করে আমরা খুবই আনন্দ পেতাম। আর গানগুলোও ফিরতো মুখে মুখে। এর বাইরে সিনেমার বিভিন্ন জুটি নিয়ে মুখে মুখে তৈরি হতো ছড়া। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো - 'রাজ্জাক শাবানা, ফুইরে গেলে পাবানা।' আর সিনেমার মাইকিং টা'তো এখনও আমাদের কানে বাজে - 'আসিতেছে আসিতেছে! হ্যাঁ ভাই, কুষ্টিয়ার বাণী সিনেমায়...'

বাংলা সিনেমার এইসব গল্প এখন ইতিহাস। একসময় বাংলা সিনেমা তার জৌলুষ হারিয়ে ফেললো। অন্যদিকে আকাশ সংস্কৃতি সবকিছুকে বোকা বাক্সের (টেলিভিশনের) মধ্যে এনে দিলো। আর দর্শক হারিয়ে হলগুলো একে একে বন্ধ হতে থাকলো। এখন কুষ্টিয়ার চারটি হলের চারটিই বন্ধ হয়ে গেছে। বানী হল এখন কুষ্টিয়া টাউন হল, বনানী বন্ধ, কেয়া হল ভেঙে বহুতল ইমারত বানানো হয়েছে। শুনেছি রক্সি হলেরও একই পরিণতি হয়েছে। আমাদের স্মৃতিতে শেষ দেখা সিনেমা হচ্ছে - টাইটানিক। বন্ধুরা মিলে বনানী হলে সিনেমা দেখে বাইরে এসে দেখি আমাদের কলেজের অনেক বান্ধবীই এসেছে তাদের পরিবারের সাথে। এমনকি ভীড়ের মধ্যে দেখি আমাদের কলেজের বায়োলজির এক স্যারও এসেছেন। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করে রাখা প্রয়োজন। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা ছিলো 'বেদের মেয়ে জোছনা'। আমার মনেহয় এই সিনেমা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের এক কিংবদন্তির নাম। কত গল্প, কত যে জনশ্রুতি তৈরি হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। কে কতবার দেখেছে এটা ছিলো আড্ডার অন্যতম বিষয়। যশোরের মনিহার সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেয়ে এক সন্তান সম্ভবা মহিলা একজন মেয়ের জন্ম দেন হলের মধ্যে। সিনেমার নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন এবং নায়িকা অঞ্জু ঘোষ না কি সেই মেয়েকে দেখতে এসে একটা গলার হার উপহার দিয়েছিলেন। আর সেই মেয়ের নামও না কি রাখা হয়েছিল জোছনা। এমন আরও কতশত গল্প মুখে মুখে ফিরতো।

এরপর অনেক সময় গড়িয়েছে কিন্তু সেইভাবে আর বাংলা সিনেমার খোঁজ রাখা হয়নি। অন্তর্জালের এই যুগে এখন সবকিছুই মুঠোফোনের মাধ্যমে আমাদের হাতের মুঠোয়। একদিন হঠাৎ ফেসবুকে হাওয়া সিনেমার পোস্টারটা দেখলাম। পোস্টারটা যথেষ্ট আগ্রহোদ্দীপক। এরপর ট্রেইলারটা দেখলাম। ট্রেইলারে যতটুকু দেখা গেলো বুঝা গেলো এটা একান্তই আমাদের সিনেমা। সিনেমার দৃশ্যায়ন, ভাষা, মেকআপ সবগুলো চরিত্রকে যেন একেবারে আসল জেলে বানিয়ে দিয়েছে। এরপর বেরহলো আমাদের সময়কার হাতে আঁকা পোস্টারের মতো সবগুলো চরিত্রের একটা পোস্টার। সিনেমার পোস্টারের এরপর মুক্তি পেল সেই বিখ্যাত গান - 'সাদা সাদা কালা কালা'। যা এখন বাংলাদেশের আবাল বৃদ্ধ বণিতার মুখে মুখে ফিরছে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের জীবনেও এই সিনেমার হাওয়া লেগেছে। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী মুক্তি পেয়েছে হাওয়া। সেই সুত্র ধরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এবং মেলবোর্নেও মুক্তি পেয়েছে হাওয়া এবং সবগুলো শো'র টিকেট আগাম বিক্রি হয়ে গেছে। সবাই বন্ধু বান্ধব নিয়ে দলে দলে সিনেমাটি দেখছে।

বাংলাদেশে তো এখন বাংলা সিনেমার সুবাতাস বইছে। আগেকার দিনের মতো রিক্সায় করে চলছে মাইকিং। ইতোমধ্যেই হাওয়া সিনেমার থিমকে কেন্দ্র করে বাজারে এসেছে টিশার্ট, শাড়ি এবং চশমা। হাওয়া সিনেমার গানকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে অনেক অনেক ভিডিও। বলতে গেলে এখন পুরো বাংলাদেশ হাওয়া জ্বরে আক্রান্ত। ছোটবেলায় দেখতাম কারো কোন ব্যাতিক্রম কাজ দাদি নানিরা বলতেন বদ হাওয়া লেগেছে। সেদিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশের গায়ে এখন ভালো হাওয়া লেগেছে বলা যায় নিঃসন্দেহে। কয়েক সপ্তাহ পার করে এখনো হলগুলো হাউসফুল যাচ্ছে। আগেকার দিনের মতো মানুষ টিকেট না পেয়ে ব্লাকে টিকেট কিনে পর্যন্ত হাওয়া দেখতে আসছে। ব্যাক্তিগতভাবে এই সিনেমাটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। একান্ত আমাদের কাহিনী। বঙ্গীয় ব-দ্বীপের অন্যতম অনুষঙ্গ বঙ্গোপসাগর। আর তাকে কেন্দ্র করেই জীবিকা নির্বাহ করেন বাংলাদেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর আছে নিজস্ব মিথ এবং বিশ্বাস যা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। নদী এবং সাগর কেন্দ্রিক আমাদের এই ব-দ্বীপের আছে নিজস্ব লোককথা ও বিশ্বাস। এইসব লোককথা এবং জীবনাচারকে একবিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত করে দুর্দান্ত চিত্রায়ণ করেছেন মেজবাউর রহমান তার প্রথম চলচ্চিত্র হাওয়া তে। চরিত্রগুলোর পোশাক পরিচ্ছদ এবং মুখের ভাষা শুনে মনেহয়েছে এরা আসলেই জেলে সম্প্রতি লোক। সিনেমার স্পেশাল ইফেক্ট এবং ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের কথা বলতে হয় আলাদা করে।

সিনেমাটা শেষ করে আমরা যখন সিডনির ম্যাকার্থার স্কোয়ারে অবস্থিত 'ইভেন্টস সিনেমা থেকে বের হলাম তখনও আমার মাথা পুরোপুরি হ্যাং হয়ে আছে। বাইরে দাড়ানো হাওয়া সিনেমার পরিবেশক এক ভাইকে পেয়ে ধন্যবাদ দিলাম। আমার অনুভূতি শুনে উনি বললেন ভালো না খারাপ হ্যাং ভাই। আমি বললাম, ভাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রত্যেকটা দৃশ্য গিলেছি। সিনেমা শেষ হবার পরও কিছুক্ষণ বসে ছিলাম যে আর কিছু দেখায় কি না। সবশেষে নিজেকে কক্সবাজারের জেলে পল্লী থেকে সিডনির ক্যাম্বেলটাউনে আবিষ্কার করলাম। এই সিনেমার একটা ডায়লগ দিয়ে লেখাটা শেষ করি - সমুদ্রে সাইন্স চলে না। হাওয়া যেভাবে বাংলা সিনেমার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনেছে আশা করবো সেটা চলচ্চিত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। মানুষ আবারও হল মুখি হবে। সুস্থ্য বিনোদন ধারায় ফিরবে বাংলা চলচ্চিত্র তথা সাংস্কৃতি। কারণ বলা হয়ে থাকে - চলচ্চিত্র সমাজের আয়না। পরিশেষে পুরো হাওয়া টিমের জন্য শুভকামনা ও অবিরাম ভালোবাসা। পথ প্রোডাকশনকে ধন্যবাদ অস্ট্রেলিয়ার দর্শকদেরকে হাওয়া সিনেমাটি উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top